E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই : সফলতা ও ব্যর্থতা

২০২১ ফেব্রুয়ারি ২১ ১৫:১২:৩৭
মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই : সফলতা ও ব্যর্থতা

আবীর আহাদ


জামুকার আয়োজনে সম্প্রতি সমাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কার্যক্রম চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে বলে অধিকাংশ প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ধারণা । অনেক স্থানে ২০১৭ সালের বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির সদস্যদের দিয়ে ২০২১ সালের যাচাই যাচাই কমিটি সাজানো হয়েছে । এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞ বাণিজ্যিক ধান্দাবাজদের পুনরায় ব্যবসা ফেঁদে অর্থ কামানোর সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে । যাচাই বাছাই কমিটি গঠনের পশ্চাতেও বাণিজ্য হয়েছে বলে যথেষ্ট সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে । এসব অপপ্রক্রিয়ায় হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় পুনর্বহাল করার অশুভ খেলার সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি, নেতাসহ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক নেতৃবৃন্দ জড়িত তাতে কোনোই সন্দেহ নেই । এ জঘন্যতম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কপালে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রশ্রয় দেয়ার কলঙ্ক তিলক পরিয়ে দিয়ে তাকে ইতিহাসে অমর করে রাখার আয়োজন করা হচ্ছে ! আর শেষমেশ এসবের দু:খজনক দায়দায়িত্ব গিয়ে পড়ছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনৈতিক দল বর্তমান আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর !

সরকারের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপিসহ হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকাররাও মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে অবস্থান করছে বলে সরকারের সর্বোচ্চ মহলসহ প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে । মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে এসব অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের জন্যে বহুকাল ধরে আমরা ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামসহ প্রচুর লেখালেখি করে আসছি । তারই ফলস্বরূপ সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ৩৩ তালিকার মধ্যে বেসামরিক গেজেট ও বাতিলকৃত বাহিনী গেজেটধারীদের ভেতর বেশিসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছে ধারণা করে কয়েক দফা তারিখ পরিবর্তন করে অবশেষে গত ৩০ জানুয়ারি সারা দেশের জেলা ও উপজেলায় একযোগে পুনরায় যাচাই বাছাইয়ের কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলো । বেসামরিক গেজেট ও বাতিলকৃত বাহিনী গেজেটধারীদের যাচাই বাছাই করার লক্ষ্যে নতুন করে যে কমিটি গঠন করা হচ্ছিলো, তা নিয়ে সারা দেশের প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা গভীর উৎকণ্ঠা ও হতাশা প্রকাশ করেছিলেন ।

বলা চলে, সবার অভিযোগ ছিলো এই যে, ২০১৭ সালের বাণিজ্যনির্ভর যাচাই বাছাই কমিটির সাথে যারা জড়িত ছিলেন, সেসব অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের দিয়ে ৩০ জানুয়ারির মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি গঠন করার পশ্চাতে ক্ষমতাসীন কতিপয় মন্ত্রী-এমপি-নেতা কলকাঠি নেড়েছেন ! এসবেরই ফলশ্রুতিতে যাচাই বাছাই কার্যক্রমটি যে ২০১৭ সালের মতো পুনরায় বাণিজ্যনির্ভর হয়ে নিষ্ঠুর প্রতারণা, ধাপ্পাবাজি ও তামাশায় পর্যবসিত হয়েছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই । এ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণীর প্রতারক ও স্বার্থান্ধ কুশীলবদের অনৈতিকতার যোগসাজশে ২০১৭ সালের মতো অমুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় পার পেয়ে গেছে বলে যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে । দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার অভাব ছিলো না যে, পুরোনো ধান্দাবাজদের দিয়েই নতুন করে যাচাই বাছাই কমিটি গঠন করার প্রয়োজন ছিলো ।

আমি তো বহুকাল ধরে বলেই আসছি, জামুকার যাচাই বাছাই পদ্ধতি ও কর্মসূচি মূলত: কোনোই সঠিক পদক্ষেপ নয় । এ পদ্ধতিতে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক সংযোগের কারণে সাক্ষ্যদাতা ও যাচাই বাছাই কমিটির সদস্যরাও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, তার কোনোই নিশ্চয়তা নেই । আমরা বলেছি, উচ্চপর্যায়ের বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে একটি মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিশনের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু সরকারের বাহাত্তর সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই করা হোক । আমাদের প্রস্তাব উপেক্ষা করে জামুকার মহাপণ্ডিত মহাশয়রা চলমান পদ্ধতিতেই যখন মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই করতে মনস্থির করেছেন তখন বাধ্য হয়েই আমরাও তাতে সমর্থন জানিয়ে ছিলাম ।

জামুকার চলমান মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই যাতে দুর্নীতিমুক্ত হয়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়, সেজন্য আমি একটা পরামর্শ দিয়েছিলাম যে, যাচাই বাছাই কমিটির সদস্য, অমুক্তিযোদ্ধা ও সাক্ষ্যদাতাদের মধ্যকার বাণিজ্যিক ধান্দাবাজদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে যাচাই বাছাই এলাকায় এনএসআই এসবি ডিবি ডিজিএফআই ও দুদকের নিশ্ছিদ্র গোয়েন্দা জাল বিস্তারের পাশাপাশি যাচাই বাছাই স্থলে তারাসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ও কড়া নজরদারি ব্যবস্থা রাখা হোক । কেউ অনৈতিক লেনদেনে জড়িত হওয়াসহ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণিত হলে তৎক্ষণিক তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখুন । কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে অবস্থানকারী একশ্রেণীর ক্ষমতাবানরা তাদের স্থানীয় রাজনীতি, ব্যক্তিস্বার্থ, আত্মীয়তা প্রভৃতিতে তাড়িত হয়ে যাচাই বাছাই কার্যক্রমে নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছেন । অনেক স্থানে যাচাই বাছাই কার্যক্রমের সাথে জড়িত সরকারি প্রশাসন ও কমিটি অসহায় অবস্থায় থেকে নেতাদের হুকুম পালন করতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানা গেছে ।

যে পদ্ধতিই গ্রহণ করুন না কেনো, আমরা চাই, যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে যেনো কোনো প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা চক্রান্তের শিকার হয়ে অমুক্তিযোদ্ধা বলে গণ্য না হন----তদ্রুপ অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাবে যেনো কোনো অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ফিরে না আসেন । এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও সম্মানবোধের প্রশ্ন ।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, শুধুমাত্র বেসামরিক গেজেট ও বাতিলকৃত বাহিনী গেজেটধারীদের যাচাই বাছাই নয়----মনে রাখতে হবে, এ ধরনের যাচাই বাছাইয়ে ঐ তালিকার মধ্যে অবস্থানকারী প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে একটা অবমাননাকর পরিস্থিতি লুক্কায়িত ছিলো । সুতরাং পর্যায়ক্রমে অবশ্যই অন্যান্য তালিকা যেমন লাল মুক্তিবার্তা, যুদ্ধাহত, মুজিবনগর প্রভৃতি তালিকার মধ্যে অবস্থানকারী বিপুলসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে । কারণ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পবিত্র নামের জঘন্যতম কলঙ্ক । তাদের কারণে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা সমাজের চোখে হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন । মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ভুয়ারা বীরদর্পে মুক্তিযোদ্ধা সেজে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে ভাগ বসিয়ে তাদের সম্মানহানি করছে, জনগণ তথা প্রজাতন্ত্রের অর্থ ও অন্যান্য সুবিধাদি লুটপাট ও ভোগ করে চলেছে ! এটা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের জনগণ কোনো অবস্থাতেই মেনে নিতে পারেন না । অতএব বীর মুক্তিযোদ্ধারা ৩০ জানুয়ারিকে একটা টেস্টকেস হিশেবে দেখেছেন । যাচাই বাছাই সফল হলে আমরা যেমন জামুকাকে অভিনন্দন জানাবো, কিন্তু কোনোপ্রকার প্রতারণা ও তামাশা করা হলে আমরাও যেকোনো চরম পন্থা বেছে নিতে বাধ্য হবো ।

আমার ইতোপূর্বের দাবি, সুপারিশ ও ব্যক্তিগত অনুরোধের আলোকে সামরিক বাহিনী তাদের তালিকায় থাকা গেজেট ও লাল মুক্তিবার্তা তালিকার অমুক্তিযোদ্ধাদের বিতাড়িত করার লক্ষ্যে বিশেষ যাচাই বাছাই তথা আপীল বোর্ডের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করেছেন । এ প্রক্রিয়ায় আপীল বোর্ডের মাধ্যমে কয়েক হাজার অমুক্তিযোদ্ধাকে চিহ্নিত করে তাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিলও করা হয়েছে । এজন্য আমি সামরিক বাহিনীর আপীল বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই যে, তারা 'মুক্তিযোদ্ধা' শব্দটিকে পবিত্রতম জ্ঞান করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে তারা অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠতার সাথে তাদের জাতীয় দায়িত্ব পালন করছেন । পাশাপাশি আমি এও প্রত্যাশা করি যে, লাল মুক্তিবার্তা, যুদ্ধাহত, মুজিবনগরসহ বেসামরিক সব গেজেটের মধ্যে অবস্থানকারী অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের লক্ষ্যেও তারা যে কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছেন, সে-কার্যক্রমও অচিরেই সফলতা অর্জন করবে ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test