E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বহিষ্কারে বিভেদ বাড়ছে আওয়ামী লীগে

২০২১ ফেব্রুয়ারি ২২ ১৫:০৭:২৪
বহিষ্কারে বিভেদ বাড়ছে আওয়ামী লীগে

প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার 


সম্প্রতি স্থানীয় সরকারের পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ীমীলীগে বহিষ্কারের হিড়িক পড়েছে। এসব ঘটনা বিগত উপজেলা নির্বাচনের সময়ও ঘটেছিল। পরবর্তী সময়ে এসব বিষয়ে দল আর কোন কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। যার ফলে অনেকটাই নিরব হয়েছিল এসব ব্যাপার। কিন্তু আবার এ পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বহিষ্কারের জেরে এখন আবার মাঠ পর্যায়ে এ নির্বাচনে বিরোধিতা চরম আকার ধারণ করেছে। বহু ভাগে বিভক্ত হচ্ছে দল। সবার একটাই চাওয়া আগে দলীয় মনোনয়ন চাই। এ যেন এক কঠিন লড়াই। এসব বিরোধিতা আগামী ইউপি নির্বাচনে আরো চরম আকার ধারণ করবে এটা অনিবার্য সত্য।

সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ ভোটাররা সরকারের সাথে মিলিয়ে দলীয় প্রতীকে ভোট দিচ্ছে। এতে করে স্থানীয় পর্যায়ে সব সময়ই যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হচ্ছে বলে মনে হয় না। কারণ দলীয় কার্যক্রমে সক্রিয় থাকা নেতা সবসময় সাধারণ মানুষের কাজে যোগ্যতা স্বাক্ষর রাখবে এরকম নয়। আবার যেসব এলাকায় দলীয় সাংগঠনিকভাবে শক্ত জাতীয় সংসদ সদস্য কিংবা উপজেলা পর্যায়ের নেতৃত্ব রয়েছেন সেসব এলাকায় এসব বিরোধিতা অনেকটাই কম বলে মনে হচ্ছে । আর এসব বহিষ্কারের ঘটনায় তৃণমূলে নেতাদের মাঝে একটা আতংক বিরাজ করছে। এর ফলে স্পষ্টতই তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হচ্ছে আওয়ামীলীগ।

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা তৃণমূলের এসব নেতারা দলের উপরের স্তরের নেতাদের আষ্করায় এসব বিরোধিতা করে আসছে। আবার এসব নির্বাচনে বিরোধী দল নির্বাচনে শক্ত অবস্থান না নেয়ার কারণে দলীয় বিরোধিতা কিংবা কোন্দাল চরম আকার ধারণ করছে। এসব ক্ষেত্রে এক পক্ষ বহিষ্কারে ব্যস্ত আবার অন্য একটা পক্ষ গোপনে বহিষ্কৃতদের সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ উঠছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামীলীগের তৃণমূল থেকে প্রার্থীদের তালিকা জেলা হয়ে কেন্দ্রে উপস্থাপনের পর দলীয় মনোনয়ন প্রদান করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার তৃণমূল থেকে নাম না গেলেও উপরে লবিং করে দলীয় প্রতীক নিয়ে আসছে অনেক প্রার্থী কিংবা নিচ থেকে নাম গেলেও জেলা পর্যায়ে আটকে যাচ্ছে অনেক নাম।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের আইন পাসের পর থেকে দলীয়ভাবে এ নিয়মটি চালু করা হয়। স্থানীয়ভাবে নেতাদের সম্মতিক্রমে এসব নাম কেন্দ্রে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। তবে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না হওয়ার ফলে এবং অনেক সদস্য বিভিন্ন কারণে বাদ হওয়ার ফলে উপজেলা কমিটিতে অনেক সমন্বয়হীনতা কাজ করছে। অনেক জায়গায় আবার এক দুজনের কথায় কমিটির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে যার ফলে কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এসব অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ফলে দল যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তেমনি কোন্দল বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে শক্তি হারাচ্ছে দল। উপরের স্তরের এসব কর্মকান্ডের ফলে তৃণমূল নেতাদের মাঝে হাতাশা বিরাজ করছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার কারণে স্থানীয় সরকার এমনকি জাতীয় নির্বাচনেও প্রার্থী ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যা একটু যাচাই করলেই দেখা যায়।

নির্বাচনের আগেই নেতাদের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে দলের নেতাদের কাছে। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠছে মনোনয়ন বাণিজ্যের। যার ফলে প্রতীক পেয়ে যাচ্ছে অনেক অচেনা নেতা যারা মাঠ পর্যায়ের রাজনীতির সাথে তেমন একটা সম্পৃক্ত নয় যে কারণে মাঠ পর্যায়ে যারা দীর্ঘদিন কাজ করে আসছে তারা মেনে নিতে পারছে না। মাঠ পর্যায়ে নেতারা ধরেই নিয়েছে দলের মনোনয়ন মানেই নির্বাচনে জয় লাভ। দলীয় মনোনয়ন মানেই প্রশাসনের সহযোগিতা এমন ধারণা জন্ম নেওয়ার কারণে মাঠ পর্যায়ে বাড়ছে প্রার্থীর সংখ্যা। তবে সম্প্রতি কয়েক ধাপে পৌর নির্বাচনের ফলে এ ধারণার অনেকটাই অবসানের পথেই এগোচ্ছে বলে মনে হয় এবং ভোটারদের মাঝে অনেকটা আশার আলো সঞ্চারিত হচ্ছে। নির্বাচনের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে ঘটছে সহিংসতা।

দলীয় মনোনয়ন একজন পাওয়ার পর অন্যসব মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে কেউ কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছে অথবা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনে কাজ করছে না বলে অভিযোগ উঠছে। আবার অনেকেই সমর্থন না করে নিরব রয়েছেন। কিন্তু মনোনয়ন প্রত্যাশীরা যেন ভুলেই গেছে প্রতীক বরাদ্ধ এক জনের জন্যই হবে। সবাইকেতো আর এক প্রতীক বরাদ্ধ করা যাবে না। দলের প্রতি কমিটমেন্ট ভুলে যাচ্ছে অনেকেই। কিন্তু বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কেন হচ্ছে এসব স্থানীয় নির্বাচনে ? বিদ্রোহী প্রার্থীদের অভিযোগ সঠিক যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। যে পেয়েছে তার চেয়ে আমিই যোগ্য ছিলাম। আর যারা পাচ্ছে তারাও দলীয় প্রতীক পেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভার হয়ে যাচ্ছে পাস সুনিশ্চত ভেবে।

আর অনেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতি অভিভাবকহীন হয়ে রয়েছে। কারো কথা কেউ শুনছে না। বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন উপদলে। হ্যাঁ এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে বড় রাজনৈতিক দলে মত পার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক তবে এতে যদি বিরোধ হয় তাহলে দলে বিশৃংখলা দেখা দিবে এটাই স্বাভাবিক। সম্প্রতি পৌর নির্বাচন ও এর আগে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী ও মদদদাতাদের বিভিন্ন স্তরে বহিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে আবার অনেক ক্ষেত্রে বহিষ্কার তোলে নিয়ে ক্ষমা ঘোষণা করে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

তবে ইতোমধ্যে যেসব বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগই গঠনতন্ত্র মোতাবেক হয়নি বলে দাবী করে আসছে বহিষ্কৃত নেতারা। এ বহিষ্কারের পর সঠিক ফলাফল অর্জন না হওয়ার পিছনের কারন খুঁজতে গেলে গুরুত্বপূর্ন দুটি কারন বের হয়ে আসবে। এক- বহিষ্কারের প্রক্রিয়া সঠিক না হওয়া। দুই- পূর্বে বহিষ্কার করেও সাধারণ ক্ষমা করে দলে ফিরিয়ে নেওয়া। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া দায়িত্বশীল নেতাদের মুখ থেকে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য প্রচার হওয়া দলের বহিষ্কারের ক্ষেত্রে চরম বিশৃংখলার সৃষ্টি করছে। উপজেলার বিভিন্ন দায়িত্বশীল নেতাদের জেলা থেকে জরুরি ভিত্তিতে তাড়াহুড়া করে বহিষ্কার করা হয়েছে।

তবে এসব বহিষ্কার নির্বাচনের পলিসি কিনা তা বুঝা যাবে কয়েক দিনের মধ্যেই। সামনে আসছে ইউপি নির্বাচনে এ অবস্থা চরমভাবে বিস্তার করবে একেবারে ইউনিয়ন পর্যায়ে যেহেতু এবারও দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হবে। আগামী ইউপি নির্বাচনে প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে অনেক মনোনয়ন প্রত্যাশী ইতোমধ্যে মাঠে নেমে প্রচারণা চালাচ্ছেন যা অতীতের যে কোন নির্বাচনকে হার মানিয়েছে। যারা এ মনোনয়নের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে লবিং চালিয়ে যাচ্ছে। যেকোন মূল্যে দলীয় মনোনয়ন চাই। এটা স্বাভাবিক যে অনেক যোগ্য নেতাই বঞ্চিত হবেন দলীয় মনোনয়ন থেকে। যার ফলে আবারো বাড়বে বিদ্রোহী প্রাথীর সংখ্যা। তখন দলীয় শৃংখলা রক্ষার জন্য হয়তো বহিষ্কারের পাল্লাটা আরো ভারী হবে তৃণমূল পর্যায়ে। সৃষ্টি হবে দলীয় বিবাদ কোন্দল আর বিভিন্ন গ্রুপের রাজনীতি।

মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক অসন্তোষ বৃদ্ধি পেলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে আওয়ামীলীগের মতো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। এসব বহিষ্কারের ফলে দীর্ঘদিন ধরে যারা এ রাজনৈতিক দলটির সাথে জড়িয়ে রয়েছে তারা বহিষ্কারের তকমা গায়ে ঘুরছে। আর এসব বহিষ্কারের ফলে পার্টির কার্যক্রম স্থিমিত হয়ে পড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই। যারা বহিষ্কৃত হয়েছেন তারা রয়েছে অনিশ্চয়তায় কোন দিন এর একটি সুষ্ঠু সমাধান হবে।

গণতান্ত্রিক আর অগণতান্ত্রিক যেভাবেই বহিষ্কার হউক না কেন তা স্থানীয় নেতাদের রাজনৈতিক জীবনের চরম এক ধাক্কা যা সারা রাজনৈতিক জীবনের কলঙ্ক। এই বহিষ্কারের ফলে ত্যাগী নেতাকর্মীরা দল ছুট কিংবা নিষ্কিয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনও কোথাও কোথাও দেখা যাবে যে এসব নেতাকর্মী দ্বারা দলের বাইরে আরেকটি বলয় তৈরি হবে। আগামী ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে প্রার্থী হলে নিচের স্তর থেকে দলের নেতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসবে। কারন যারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবে তার বলয়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দল।

এছাড়াও এসব বড় দলে দীর্ঘদিন যাবত কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্বে পরিবর্তন না হওয়ার কারণে বিভিন্ন পদ পদবীতে যোগ্য তরুণ নেতাকর্মীরা স্থান পাচ্ছে না এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিতে রুপ পেয়েছে। সার্বিক বিচারে এসব বহিষ্কারাদেশ সঠিকভাবে না হলে দলে বিভেদ দিনের পর দিন বাড়তে থাকবে। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে আওয়ামীলীগের মতো একটি বড় দল। তাই কেবল মাত্র বহিষ্কার না করে দলীয় নেতাকর্মীদের একস্থানে এনে দলীয় আদর্শে উজ্জীবিত করে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

এটা কেবল মাত্র সম্ভব দলীয় রাজনীতির দলীয় দর্শন অনুযায়ী দলকে পরিচালনা করা। মতভেদ দূর করে দলীয় কার্যক্রম গতিশীল করা একান্ত অপরিহার্য। দলীয় রাজনীতি সঠিক হলে এবং এ দল দ্বারা দেশ পরিচালিত হলে জনগণ অবশ্যই সুফল ভোগ করবে। দলের মতভেদ দূর করতে হলে অবশ্যই উপরের পর্যায় থেকে এসব দিক নির্দেশনা প্রয়োগ জরুরি। সঠিকভাবে নির্দেশনা জারি করে এবং সঠিক নিয়মের প্রয়োগের মাধ্যমে এ মতভেদ দূর করা সম্ভব।

লেখক :শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test