E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

মুশতাকের মৃত্যু : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন : বাংলাদেশ

২০২১ মার্চ ০৯ ১৬:০৩:৩৯
মুশতাকের মৃত্যু : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন : বাংলাদেশ

রণেশ মৈত্র


বাংলাদেশের পত্রিকাগুলি লেখক মুশতাকের খবরে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভর্তি। মূল খবর ছিল মুশতাকের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে তথাকথিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে। এই আইনের সমালোচনা বহুদিন থেকেই চলে আসছে। আবার এর প্রয়োগও চলছে সমানতালে। আইনের সর্বশেষ ও মর্মান্তিক শিকার লেখক মুশতাক। তাঁকে গ্রেফতার করাই হলো না শুধু-প্রায় এক বছর ঐ আইনে আটকই রাখা হলো না শুধু তার মৃত্যুও ঘটলো ঐ আটকের পরিণতিতেই আটকাবস্থায়ই।

মুশতাকের চিকিৎসা হয়েছে উপযুক্তভাবে সরকার এমন দাবী করলেও তা সত্যের অপলাপ মাত্র। মৃত্যুর পরে তাকে বাইরের হাসপাতালে নেওয়া হলো উন্নত চিকিৎসার জন্য। এ এক মর্মান্তিক পরিহাস একজন লেখকের জীবন নিয়ে। সমগ্র বাংলাদেশ এই মুশতাকের গ্রেফতার ও তার মৃত্যু ঘটানোর প্রতিবাদে সোচ্চার ছাত্র যুবদের উদ্যোগে শুরু-ক্রমে পথে নামছেন অন্যান্য পেশাজীবীরাও। কিন্তু সরকার এখনও নির্বিকার। গণ দাবির মুখে জেলা প্রশাসন একটি দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন করলেও লোকে কিন্তু এই পদক্ষেপকে ‘লোক দেখানো’ বলেই মন্তব্য করছেন। এ কথা জানা, এই তদন্তের রিপোর্ট কোনদিন জনসচক্ষে প্রকাশ করা হবে না যেমন করা হয় নি অতীতের কোন তদন্ত কমিশনের প্রদত্ত রিপোর্টও।

অভিজ্ঞতা আরও বলে, যদি বা কিছু ত্রুটি খুঁজে পায়ও কমিশন-তবে তা হবে একজন ডেপুটি জেলার বা জেলার বা সুপারিন্টেন্টের ‘গাফিলতি’। তার প্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ শাস্তিটা ও.এ.ডি করে অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাকে বা তাঁদেরকে অন্যত্র বদলি এবং কিছুকাল পর পদোন্নতি। এমনটাই দেখে আসছি সেই ইংরেজ আমল থেকে। কিন্তু মৃত্যু যখন ঘটেই গেল-যাকে নির্য্যাতনের চাইতে ‘ডিজিটাল হত্যা’ বলতেই সম্ভবত: মৃত্যুর চেহারাটি সবার সামনে খোলাসা হয়।

প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ মোশতাককে গ্রেফতার, কারাগারে তাকে হত্যা এবং ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইন নামক কুখ্যাত কালা কানুনটি বাতিলের দাবিতে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলে সমগ্র জাতির অকুণ্ঠ নৈতিক সমর্থন পেয়েছে। এ আন্দোলনের উত্তাপ, তার আগুন কখনো কখনো স্তিমিত মনে হলেও ধিকিধিকি তা জ্বলতেই থাকবে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণকারী ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত। তার আগে ঘটবে গণ-বিষ্ফারণ-অতীত সে শিক্ষাও দেয়।

বাংলাদেশের জন্ম কাহিনী অজানা নেই কারও। ২৩ বছর ধরে পাকিস্তান বাঙালিকে যেভাবে মূক ও বধির করে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, ১৪৪ ধারা, বারফিউ, জেল-জুলুম, চিস্বা-কর্ম-লেখা-মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে স্বৈরশাসন কায়েম করেছিল, শত নির্য্যাতন সহ্য করেও মানুষ ঐ কালা কানুন গুলিকে মেনে তো নেয়নি, কি আওয়ামী লীগ, কি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কি ছাত্র ইউনিয়ন, কি ছাত্রলীগ-সে সময়ের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ঐ কালা কানুনগুলির বাতিল দাবি করেছে-দাবি করেছে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার । সেই দাবিতে ধারাবাহিকতার সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মনোরঞ্জন ধর, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহম্মদ প্রমুখ। আরও অসংখ্য নেতা-কর্মীর নাম করা যাবে যাঁরা ঐ আন্দোলনে নির্ভীক ও বিপুল অবদান রেখেছিলেন।

সবারই জানা এবং অতীত ইতিহাস বলে ঐ ধারাবাহিক আন্দোলনের পথ ধরেই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্রভাবে সামিল হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। কোটি কোটি বাঙালির সক্রিয় সমর্থনে, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনাহুতির বিনিময়ে এক সমুদ্র রক্ত ঢেলে দিয়ে কঠিন মূল্য দিয়ে দেশ-বিদেশের নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থনে অর্জিত এই সাফল্য-এই স্বপ্নের বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশে ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনের নামে মানুষের কণ্ঠ রোধ করা আইন? কখনোই তা এদেশের মানুষ মেনে নেবে না। সরকারকে ভুল বার্তা দিচ্ছে এই কালো আইনের সমর্থকেরা।

অবশ্যই সকলের কাম্য, রাষ্ট্র দ্রোহীদেরকে শাস্তি দিতে হবে। তার জন্যে প্রচলিত আইনগুলিই যথেষ্ট। তারপরেও এই আইন। কেন? কার স্বার্থে?কার বিরুদ্ধে? বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহী কারা? সবাই জানি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম প্রমুখ ধর্মের নামে রাজনীতি করছে যারা। জানি বাংলাদেশের শত্রু তারা-যারা সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতা প্রচার করে, যারা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান-আদিবাসী-নারী পুরুষের বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টি করে-তারা।

বাংলাদেশের শত্রুর তালিকায় আরও রয়েছে যারা মন্দির ভাঙ্গে, মূর্তি ভাঙ্গে, মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সৃষ্টি করে-সংঘাত সৃষ্টি করে, নারী-পযুরুষের সম-অধিকারের বিরোধিতা করে, নানাবিধ শিল্পকর্ম-ভাস্কর্য্য ভাঙ্গে তার নির্মাণের বিরোধিতা করে, যারা বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরোধিতা করে-দাবী করে সাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থার-যারা বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধানে বর্ণিত চায় রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে বিকলাঙ্গ করে “বিসমিল্লাহ্” রাষ্ট্রধর্ম সংযোজনকে সমর্থন করে- তারা।

কিন্তু এই যে অপরাধ ও অপরাধীদের তালিকা উপরে দেওয়া হলো সেই তালিকার ভিত্তিতে এযাবত কারও বিরুদ্ধে কি ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করা হয়েছে? পরিসংখ্যান বলে, একটিও না। কোন মিথ্যা গুজন সৃষ্টিকারীদেরকে কি এ যাবত ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা, বিচার করা, শাস্তি দেওয়া হয়েছে? হয়নি-এটাই সত্য। বরং এ যাবত যাঁরা ঐ আইনে গ্রেফতার হয়েছেন তাঁরা লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক প্রমুখ। আর গ্রেফতার করা হয়েছে যারা সাম্প্রদায়িকতার শিকার যাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা গুজব রটনা হয়েছে তারা। মিথ্যা গুজব রটিয়ে যাদের বাড়ী পোড়ানো হয়েছে সেই অগ্নিসংযোগ কারীরা নয় বরং যারা ক্ষতিগ্রস্ত নিরীহ নিরপরাধ মানুষ তারাই।

মসজিদ থেকে মাইকে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে যাদেরকে ফেইসবুকে মিথ্যা পোষ্ট দেওয়ার প্রচার করে লাখো লোক নিমেষে সমবেত করে যার বিরুদ্ধে গুজব ছড়ালো তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বহু ক্ষেত্রে কিন্তু একটি ঘটনাও নেই ঐ মিথ্যা গুজব রটনাকারী কাউকে গ্রেফতারের। ঐ গুজব প্রচারকরে যারা অজস্র মানুষের অবৈধ জমায়েত সৃস্টি করে গ্রামের নিরীহ মানুষদের বাড়ীঘর লুটপাট করালো, যারা নিরীহ মানুষের বাড়ীঘর ভাংচুর বা তাতে অগ্নিসংযোগ করলো-সেই প্রকৃত অপরাধীদের কারও গায়ে এতটুকুও কাঁটার আঁচড় লাগেনি আজতক।

আইনটি এবং তার প্রয়োগ দেখতে দেখতে আতংকিত হয়ে পড়েছে দেশের সকল গণমাধ্যম। একচেটিয়া সরকারি প্রচার-প্রচারনাই হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁদের প্রতি অঘোষিতভাবে বাধ্যতামূলক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, বঙ্গবন্ধুর চেতনা-বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বলে দিবারাত্র মুখে ফেনা তুলে ফেললেও বাস্তবে প্রদর্শিত কার্য্যকলাপ তার ধারেকাছেও নেই।

কথা না বাড়িয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে, সমস্ত চেতনা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আশু বাতিল চাই। একই সাথে এই আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে এ যাবত যাঁরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন-তাঁদের সকলকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। আটকাবস্থায় মৃত্যুর দায় পুরাপুরি সরকারের। তাই তাঁর পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে এবং আইনটি বাতিল করে যাত্রা শুরু হোক।

লেখক : সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test