E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে আগাছা উপড়ে ফেলতে হবে

২০২১ এপ্রিল ১৩ ১৫:১৮:০৪
মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে আগাছা উপড়ে ফেলতে হবে

আবীর আহাদ


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুঃখ করে বলেছেন :"আগাছাগুলিকে আমার বড় ভয় । এগুলি না তুললে আসল গাছগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে । যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবিদ, যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে এবং করতে চেষ্টা করে ।" কারাগারের রোজনামচা : শেখ মুজিবুর রহমান । পৃষ্ঠা- ১১৭

জাতির পিতার কথার সূত্র ধরে আমিও একথা বলতে চাই যে, মুক্তিযোদ্ধা অঙ্গন থেকে অ-মুক্তিযোদ্ধা নামক আগাছাগুলো উৎপাটিত করতে না পারলে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস চেতনা শৌর্য ত্যাগ বীরত্ব ও মর্যাদা ধ্বংস হয়ে যাবে । মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অপমৃত্যু ঘটবে । আর এভাবেই এতো রক্তমূল্যে কেনা আমাদের স্বাধীনতা মূল্যহীন হয়ে পড়বে ।

এ-পরিপ্রেক্ষিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক অবদানের মূল্যায়ন ও অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে আমরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গোড়াপত্তন করে 'বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা'র দাবিতে আজ প্রায় চার বছর যাবত মাঠে, ময়দানে, প্রেসক্লাবে, পদযাত্রায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্মারকলিপি পেশসহ ধারাবাহিক লেখা ও বিবৃতির মাধ্যমে এক অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে আসছি ।

আমাদের এসব দাবির ন্যায্যতা অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু-কন্যার সরকার ও আওয়ামী লীগ গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তাদের দলীয় ইস্তাহারে 'মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদা পুন:প্রতিষ্ঠা'র অঙ্গীকার করেন । সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কোনোই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না । উপরন্তু জামুকা নামক সংস্থাটি একটি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার ওপর নির্ভর করে যাকে-তাকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েই চলেছে ।

আমরা আগেই বলেছি, " মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি যেকোনো একটি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন"----- বঙ্গবন্ধু সরকারের বাহাত্তর সালের এই মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে একটি উচ্চপর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই যাচাই কমিশন গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা উচিত ছিলো । এ সংজ্ঞা ব্যবহৃত হয়নি বলেই অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় গোঁজামিল সংজ্ঞা ও নির্দেশিকায় মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধার অনুপ্রবেশ ঘটার ফলে তালিকা বৃদ্ধি পেয়েছে । এ প্রক্রিয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে । যারা মুক্তিযোদ্ধা নয়, তারা আজ মুক্তিযোদ্ধা সেজে মুক্তিযোদ্ধার গৌরব ও রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি ভোগ করে আসছে ।

আমরা অতিসম্প্রতি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের ১ম পর্ব নামক যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, সেই তালিকার মধ্যে বিশেষ করে লাল মুক্তিবার্তার হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশিত হয়েছে, অথচ যে তালিকাটি বিতর্কের ঊর্ধে সেই ভারতীয় তালিকার হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ পড়ে গেছে ! তথাকথিত ২য় বা শেষ তালিকায় তাদের নাম আসবে কিনা সে-বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নন ।

অপরদিকে অতীতের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অবস্থানরত হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদের কী হবে, তারা কি বাদ যাবে , না সগৌরবে বহাল থাকবে----সেটাও কেউ বলতে পারছে না । তথাকথিত ১ম পর্বের তালিকাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অতীতের সব ভুয়ারা তালিকায় থেকেই যাবে ! এই যদি হয় অবস্থা তাহলে বারবার কোটি কোটি টাকা খরচ করে ঢাকঢোল পিটিয়ে যে যাচাই বাছাই করা হলো, সেসবই হয়ে যাবে আইওয়াশী তামাশা ! এতোদিন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মন্ত্রী এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বলেছিলেন যে, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ৪০/৫০/৬০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে----তাহল সেসব কথা ও ভুয়াদের অবস্থান কী হবে ?

মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে । সেই মেঘ আকাশে রয়েই গেছে । সেই মেঘ ঠেলে আরো না হয় কিছু সময় যাক----মেঘ সরে গিয়ে সূর্য দেখা দিক----তেমনি মুক্তিযোদ্ধা তালিকাটা শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হিশেবে পরিগণিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আরো কিছু সময় নিয়ে হলেও অস্বচ্ছতাকে ঝেড়ে ফেলে একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার তালিকা প্রণয়ন করা যেতে পারে । সেই স্বচ্ছ প্রক্রিয়াটি আমরা অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছি । সেটি হলো, বঙ্গবন্ধুর সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে উচ্চতার আদালতের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধকালীন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে একটি স্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিশন গঠন করা । আমার বদ্ধমূল ধারণা, কোনোপ্রকার প্রভাব ছাড়া এ স্বাধীন কমিশনকে দায়িত্ব অর্পণ করা হলে ৩ থেকে ৫ মাসের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারদের একটি স্বচ্ছ তালিকা উঠে আসবে । যেখানে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা করতে কয়েক যুগ অতিবাহিত হচ্ছে, সেখানে এ সময়টি কোনো বিষয়ই নয় ।

কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, এমন একজন লোককে আমরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিশেবে পেয়েছি, যিনি এ-বিষয়ে কীভাবে কী করতে হবে, তার কিছুই বোঝেন বলে মোটেও মনে হয় না ! অপরদিকে তাঁরই নেতৃত্বে জামুকা নামক যে সংস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে, তার কর্মকর্তাদেরও এ-বিষয়ে কোনো ধারণা ও মাথা ব্যথা আছে বলেও মনে হয় না । অ-মুক্তিযোদ্ধা বিতাড়নের বিষয়ে দেশে যে একটা প্রবল দাবি উঠেছে, সে-ব্যাপারে তাদের কোনো চৈতন্য নেই । প্রায় আশি / পঁচাশি হাজার অ-মুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় রেখে দেয়ায় তারা যে সরকার তথা রাষ্ট্রের অর্থ ও অন্যান্য সুবিধাদি হাতিয়ে নিচ্ছে, অকারণে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে ভাগ বসিয়ে চলেছে----এসব বিষয়ে তাদের কোনোই বিবেচনা নেই । তাদের বিবেকেও বাধে না ।

এসব বিষয়ে যারা সঠিক পরামর্শ দিতে পারে, তাদের সহযোগিতা নিতেও তাদের দেখা যাচ্ছে না । মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে ভুয়ামুক্ত করবে কি, তারা বরং নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞা আবিষ্কার করে ভুয়াদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেছেন । এর মূলে রয়েছে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনা । বলা চলে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একটি নপুংসক স্বার্থান্ধ আত্ববিনাশী গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছি । অপরদিকে রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরাও এ-ব্যাপারে একেবারেই নির্লিপ্ত ! মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়ে তাদের কোনোই মাথাব্যথা নেই । তারা আছে, কীভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় সেটা নিয়েই বিভোর । ফলে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তাদের মনে কোনো আবেদন সৃষ্টি হয় না !

বীর মুক্তিযোদ্ধারা আজ জীবনের শেষপ্রান্তে অবস্থান করছেন । অবহেলায় অনাদরে ও মর্যাদাহীন অবস্থায় প্রতিদিন পাঁচ/ছ'জন করে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছেন । অধিকাংশই রোগে শোকে বয়সের ভারে নুয়ে থেকে চরমতম মানবেতর জীবনযাপন করছেন । স্বাধীনতার সুফল ভোগকারীরা কি একটিবার ভেবে দেখেছেন, মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জীবনের বিনিময়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলো বলেই যিনি জীবনে যা কল্পনাও করেননি, তিনি তাই হয়েছেন, হচ্ছেন ও হবেন ! অথচ সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নূন্যতম মৌলিক অধিকার ও তাদের জাতীয় মর্যাদা নিশ্চিত করতে কারো কোনো মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না । এতোটা অবিবেচক ও অকৃতজ্ঞ কি কোনো মানুষ হতে পারে ?

আসলে যে জাতি বা যারা তাদের জাতীয় বীরদের মর্যাদা ও অবদানের বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকে, সেই জাতি বা তারা ভবিষ্যতে কোনো জাতীয় বীরদের আগমন আশা করতে পারে না । বঙ্গবন্ধু ঠিকই বলে গেছেন, আগাছা-পরগাছাগুলো দেশকে ধ্বংস করে দেয় । আমাদের দেশের আগাছা নামক অ-মুক্তিযোদ্ধা ও পরগাছা নামক ক্ষমতাবান ও লুটেরা অমানুষগুলো দেশ ও জাতির ইতিহাস চেতনা ও মর্যাদাকে ধ্বংস করে চলেছে ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test