E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অন্ধকারে নিমজ্জিত বাংলাদেশ : উত্তরণের উপায়

২০২১ এপ্রিল ১৯ ১২:৫৮:১২
অন্ধকারে নিমজ্জিত বাংলাদেশ : উত্তরণের উপায়

আবীর আহাদ


চারদিকে দুর্নীতি ও লুটপাট । সভ্যতা ও ভব্যতার দলন । নৈতিকতা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিকৃতি । মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় । অসুন্দর নষ্টামি ভণ্ডামি ও নষ্টাচার-ভ্রষ্টাচারের হোলিখেলা । ইত্যাকার অশুভ কর্মযজ্ঞের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত বাংলাদেশ হাবুডুবু খাচ্ছে । সর্বত্র কেঁচো খুঁড়তে বড়ো বড়ো বিষধর সাপ বেরুচ্ছে । কালো টাকার প্রভাবে মাদক ও ব্যভিচারের করাল গ্রাসে বাঙালি সমাজ ডুবে যাচ্ছে । উন্নয়ন ও সরকারি কেনাকাটার অন্তরালে চলছে শতসহস্র কোটি টাকা লুটপাট । ব্যাংক ও পুঁজিবাজারে চলছে সাগর চুরি । হুণ্ডিসহ নানান উপায়ে দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে । জীবনঘাতী করোনার করুণ মৃত্যুর মিছিল দেখেও এসব অপকর্মের সাথে জড়িত কারো মনে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই । সবাই চাটাটাটি ও লুটপাটে বিভোর । বাংলাদেশ যেনো দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের অভয়ারণ্য । পাশাপাশি চলছে ধর্মীয় অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অর্ধশিক্ষিত কাঠমোল্লাদের রমরমা ব্যবসা । এদের অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বললেই আপনি আমি হয়ে যাচ্ছি নাস্তিক , মুরতাদ, ধর্মদ্রোহী !

প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের কোণঠাসা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী লোকদের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনকে রাজাকার চেতনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে । প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে, মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের বঞ্চিত করে প্রকারান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবজ্ঞা করা হয়েছে । বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দিয়ে রীতিমতো মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানিত করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না-----বিএনপি-জামায়াতের পথ অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে ভুয়া সংজ্ঞা সৃষ্টি করে হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বকে অপমানিত করা হচ্ছে । স্বাধীনতাতার সূর্যসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সিংহভাগ চরমতম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিনাতিপাত করে চলেছেন । অনেকের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই ।

অনেকে করোনা ভাইরাসসহ নানান জটিল রোগে আক্রান্ত । বলা চলে বিনা চিকিৎসায় প্রতিদিনই তারা জীবন থেকে ঝরে পড়ছেন । বর্তমানে তারা যে মাসিক ভাতাটা পান তা দিয়ে তাদের চিকিৎসা ও পেটের অভাব কোনোটাই মেটে না । অপরদিকে মাসিক ভাতাটাও যথাসময়ে পান না । মুক্তিযোদ্ধাদের দেখভাল করাসহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কার্যাবলি সম্পাদন করার লক্ষ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও, কী দুর্ভাগ্য, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে সমাজকল্যাণ বিভাগের এখতিয়ারে ! উপজেলা সমাজসেবা কেরানিদের মর্জির ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বিতরণের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়েছে ! অথচ প্রতিটি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স রয়েছে যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের এসব কাজ সম্পাদন করার লক্ষ্যে নিজস্ব দপ্তর স্থাপন করা যেতে পারে । এ প্রক্রিয়ায় কিছু লোকের কর্মসংস্থানসহ মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্ট লাঘব হতো । মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সচিব-কেরানিদের মাথায় এ প্রসঙ্গটি কেনো যে আসে না তা আমাদের বোধগম্য নয় ।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিকে পাশ কাটিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি হেফাজতে ইসলামকে মাথায় তোলা হয়েছে, ফলে তারা শক্তি সঞ্চয় করে এখন সরকারের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে ! মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এসব লম্পট ও ভণ্ড আল্লাহর এখতিয়ারটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে যাকে-তাকে কাফের, বিধর্মী, মুরতাদ ও নাস্তিক ঘোষণা করে চলেছে । এমনকি ধর্মীয় অঙ্গনে অত্যন্ত নিরীহ একটি সম্প্রদায় আহমদীয়া বা কাদিয়ানীদের কাফের ও অমুসলমান ঘোষণা করার জন্যে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে কিছুদিন পূর্বে ধমক দিয়েছে !

মূলত: স্বাধীনতাবিরোধী হেফাজত পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ধর্মীয় উন্মাদনায় দেশের মধ্যে একটি অরাজকতা সৃষ্টি করে হানাহানি ও রক্তপাত ঘটিয়ে আমাদের বহু কষ্টার্জিত বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চায় । অপরদিকে প্রশাসনের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলারা নিচের শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে হেফাজতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক লেখনী সরিয়ে সাম্প্রদায়িক লেখনী সংযোজন করেছে । রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিটি ইউনিয়ন ও উপজেলায় নানান কিংভূতকিমাকার মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ধরনের ইসলামী ইন্সটিটিউট তৈরি করে রাজাকার ও জঙ্গি সৃষ্টির বীজ বপন করা হচ্ছে, যেসব মসজিদ মাদ্রাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে সেগুলোকে কুফরি মতবাদ আখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষের মনোজগতে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি অনুপ্রবেশ করানো হচ্ছে ।

কমিশন ও ঘুষ খেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাঙ্ক, বীমা, ঠিকাদারী মিডিয়াসহ সর্বত্রই বিএনপি-জামায়াত তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী লোকদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে । একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে বিভিন্ন সিণ্ডিকেটের হাতে তুলে দিয়ে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিসহ যন্ত্রণার মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে । এভাবে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গুটিকতক দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের আশা-আকাঙ্খাকে পদদলিত করা হয়েছে । আর তার বিষফল স্বরূপ দেশে কেসিনো সম্রাট, ব্যাংকিং দরবেশ, বিশাল বিশাল কালো টাকার মালিক ও গণিকা পাপিয়াদের জঘন্যতম উত্থান ঘটেছে ।

এতকিছুর পরেও দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষ বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিশেবে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর পরম আস্থা স্থাপন করে মুখ গুঁজে বসে আছে । তারা এও আশা করেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব থেকে মুক্তি দিতে জননেত্রী শেখ হাসিনার বিকল্প কোনো শক্তি নেই । বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও আদর্শের উত্তরাধিকারসহ সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ব্যক্তিগত সততা প্রজ্ঞা মেধা ও দূরদর্শিতা দিয়ে দেশকে সত্যিকারে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় পরিচালিত করতে পারেন । যদিও জননেত্রীর একটি কথা প্রায়ই আমাদের কানে ভাসে যে, তাঁকে ছাড়া আওয়ামী লীগের সবাইকে কেনা যায় । তাঁর একথার প্রতিবাদ করতে একজনও আওয়ামী নেতা-কর্মীকে দেখা গেলো না, যদিও তাঁর দলের বাইরে দেশের সব সেক্টরে এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের প্রচুর সৎ মেধাবী ও ত্যাগী মানুষ আছেন যাদেরকে দুর্নীতি ও লুটতন্ত্র মোটেই স্পর্শ করতে পারেনি । আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধুর কন্যা এবং একজন সৎ সাহসী প্রজ্ঞাবান নেতা হিশেবে শেখ হাসিনা যদি সেসব সৎ মেধাবী ও ত্যাগী মানুষদের খুঁজে তাঁর দল ও সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে অবস্থান দেন তাহলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ জাগ্রত হয়ে কাঙ্ক্ষিত পথে ধাবিত হবেই ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

১৯ মার্চ ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test