E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

লুটপাট ও সাম্প্রদায়িকতা

২০২১ এপ্রিল ২৬ ১৩:৪৯:৫৫
লুটপাট ও সাম্প্রদায়িকতা

আবীর আহাদ


দেশের অর্থনীতি আজ এক অদ্ভুত গতির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে । সেই গতির ঘূর্ণাবর্তে একদিকে কিছু লোক হঠাত্ করে বিশাল বিশাল কোটিপতি বনে যাচ্ছে, অন্যদিকে একই গতিতে বিপুলসংখ্যক লোকজন দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্রতর হচ্ছে । মূলত: লুটপাটীয় আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ফলশ্রুতিতে অর্থনীতিতে এসব অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে । আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিভিন্ন ব্যাংক, লিজিং কোম্পানি, পুঁজিবাজার, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পসহ কেনাকাটা খাত থেকে শতসহস্র কোটি টাকা লুটপাট হয়ে গেলেও, এর সাথে জড়িত রাঘব বোয়ালদের বিচার বা শাস্তি হচ্ছে না । তা না-হওয়ার পশ্চাতে কী রহস্য লুকিয়ে আছে, সেগুলো দেখার কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা যেনো বাংলাদেশে নেই ! সেই লুটপাটের সিংহভাগ টাকা কীভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, সেসব বিষয়েও কেউ খতিয়ে দেখছে কিনা তাও জানা যাচ্ছে না । এসব লুটপাট বন্ধ ও এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কিছুই করণীয় আছে বলেও মনে হয় না । এর অর্থ কি এই যে, এসব অপরাধকর্মের সাথে রাষ্ট্রের বিভিন্ন উচ্চ স্তরের ক্ষমতাসীনরাও জড়িত ? তারাও কি ঘুষ বা একটা কমিশন খেয়ে ঐসব অপকর্মের হোতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না ? তারও উত্তর জানা থাকলেও বলার ক্ষমতা অনেকের নেই !

সতেরো কোটি মানুষের ছোট্ট একটি দেশ । এদেশ থেকে গুটিকতক দুর্নীতিবাজ-লুটেরা এভাবে লুটপাটের হোলিখেলায় দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে সীমাহীন সুখসাগরে জীবনযাপন করছে, অপরদিকে সাধারণ মানুষ দিনকে দিন আর্থিকভাবে চরম টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে । কয়েক কোটি শিক্ষিত বেকারসহ দেশের স্বাধীনতার অধিকাংশ সূর্যসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধারা চরম অনিশ্চয়তার আবর্তে পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে । বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদের অবস্থান, সমাজে মানবিক মর্যাদা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়, সভ্যতা ও ভব্যতায় পচন, ভিন্নমতের প্রতি আক্রোশ, নৈতিকতার নিম্নগামিতা, শিক্ষা ব্যবস্থায় ধস, মাদক অনাচার ও অন্যান্য অসামাজিক কর্মকাণ্ডের হলাহল ইত্যাদি চরমভাবে জেঁকে বসেছে ।

দেশের এমনসব আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দেউলিয়াপনাকে পুঁজি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের বিপক্ষ শক্তি হিশেবে ধর্মীয় জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির চরম উত্থান ঘটেছে । গ্রামেগঞ্জে হাটেমাঠে শহরেনগরে মাদ্রাসা-মসজিদে প্রচারমাধ্যমে ওয়াজ নসিহতের নামে চলছে অশিক্ষিত মূর্খ গোঁয়ার মোল্লাদের লাগামহীন সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ও উস্কানির বন্যা । এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি চরম বিষোদ্গার করে এগুলোকে কুফরি মতবাদ বলেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, ইসলামী ধর্মের মধ্যে থাকা আহমদীয়া সম্প্রদায়কে কাফের ঘোষণাসহ যাকে-তাকে অমুসলমান মুরতাদ নাস্তিক ও বিধর্মী বলে ফতোয়া দিচ্ছে । আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরম বন্ধু ভারতকে বাংলাদেশের শত্রু হিশেবে চিহ্নিত করে এদেশের মানুষকে ভারতবিরোধী করার লক্ষ্যে তারা আদাজল খেয়ে নেমেছে । ভারত বিরোধিতার নামে তারা ইসলাম ধর্মের আবরণে পাকিস্তানি প্রেমকে জাগ্রত করছে । মোট কথা বাংলাদেশকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ঐ গুটিকতক দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের সাথে গাটছড় বেঁধে দেশের রাজাকার মোল্লা সমাজ হেন কোনো কাজ নেই যা তারা সুচারু করে যাচ্ছে । সবকিছু পর্যালোচনা করে মনে হয় যেনো তাদের এসব অপকর্মের পশ্চাতে সরকারের মধ্যকার আরেকটি সরকারের ইন্দন কাজ করছে !

দেশের এহেন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, দুর্নীতি লুটপাট ও মাফিয়াতন্ত্রসহ সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে যে নৈতিক আদর্শিক ও দেশপ্রেমমূলক ব্যবস্থা নিয়ে সরকার অগ্রসর হবে, তারও তেমন ন্যূনতম পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না । সরকার যেনো যখন যেমন তখন তেমন ধরনের অবস্থার মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে শুধু দিন পার করার নীতিতে চলছে । আদর্শ, চেতনা ও সুদূরপ্রসারী হিসেব না রেখে শুধুমাত্র ক্ষমতা ভোগ ও লুটপাটের সহযোগী বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অকারণ নীরব ভাগিদারের অপবাদ নিয়ে আর যা-ই হোক দেশের মানুষের কল্যাণ করা যায় না । দেশবাসীর মন জয় করা যায় না ।

মুক্তিযুদ্ধের সাগরসম রক্ত ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কি একটি দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতেই থাকবে ?

সাম্প্রতিক দেশের সবচেয়ে বড়ো জঙ্গি রাজাকার সংগঠন হেফাজতে ইসলাম নষ্টামি ভণ্ডামি গুণ্ডামি ও অরাজকতা সৃষ্টি করার একটা পর্যায় এসে চরমভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে । সরকার এ সুযোগে হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোকে আইন করে নিষিদ্ধসহ সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাষ্ট্রধর্ম ও বিসমিল্লা উঠিয়ে দিতে পারে । হেফাজতে ইসলাম তথা মোল্লাদের ধর্মব্যবসা ও নানান অনৈতিক কার্যকলাপের কারণে দেশের জনমত এখন তাদের বিপক্ষে অবস্থান করছে । মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে যদি সত্যিই আওয়ামী লীগ সরকারের দায়বদ্ধতা থাকে তাহলে তারা দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একই সঙ্গে দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারে । এদের বিরুদ্ধে জনমত বহু পূর্ব থেকে সংঘটিত হয়ে আছে । আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে, দুর্নীতিবাজ লুটেরা সাম্প্রদায়িক ও মাফিয়া চক্র এক ও অভিন্ন । একটির সাথে আরেকটির যোগসূত্র রয়েছে । সুতরাং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এক্ষুনি যা করার করতে হবে । আওয়ামী লীগের ক্ষমতার রাজনৈতিক জীবনে এমন সুবর্ণ সুযোগ কোনোদিন আসেনি । এখন এসেছে । এ সুযোগটি যদি তারা কাজে লাগাতে পারে, তাহলে দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ দেশবাসী আওয়ামী লীগের পেছনে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা দৃঢ়তা নিয়ে অবস্থান নেবে ।

আমাদের সন্দেহ হচ্ছে, আজ আওয়ামী লীগের ভেতরেই যে দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে, তাদের বাধা অতিক্রম করে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড দেশকে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের মূলধারায় ফিরিয়ে নিয়ে থেতে পারবেন কিনা ! তবে যদি তারা তার দল ও দলের বাইরের অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তর থেকে বেছে বেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সৎ মেধাবী ও ত্যাগী লোকদের সরকারের মধ্যে অবস্থান দেন, তাহলে তার দলের ভেতরের ও বাইরের দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি কিছুই করতে পারবে না । বল এখন আওয়ামী লীগের কোর্টে । কীভাবে খেলে তারা গোল দেবে, সেটি এখন তাদের এখতিয়ারে ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

১৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test