E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযুদ্ধের গণবিপ্লব সংঘটনে শুভশক্তির উত্থান জরুরি

২০২১ এপ্রিল ২৯ ১৪:০২:০৭
মুক্তিযুদ্ধের গণবিপ্লব সংঘটনে শুভশক্তির উত্থান জরুরি

আবীর আহাদ


এক খবরে প্রকাশ, বিগত একদশকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে আট/নয় লক্ষ কোটি টাকা । এসবই হলো বিভিন্ন প্রকল্পের বাড়তি মূল্য, সরকারি কেনাকাটা, ভুয়া প্রকল্প/শিল্পের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেয়া অর্থ । বেশকিছু কাল আগে সুইস ব্যাংক ও পানামা পেপার্সে বাংলাদেশের কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের খবর প্রচারিত হয়েছিল । এসব পাচারকৃত অর্থে আমেরিকা, লণ্ডন, কানাডা, পানামা, সুইজারল্যান্ড, দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালায়েশিয়া প্রভৃতি দেশে বিশাল অর্থ পাচারসহ সেসব দেশে অনেকেই সেকেণ্ড হোম গড়ে তুলেছে । এসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা গোষ্ঠী তাদের ভবিষ্যত বংশধরদের নিরাপদ জীবনের জন্য তাদেরকে ঐসব দেশে লেখাপড়া করাচ্ছে । অর্থাত্ এদেশের প্রতি তারা দায়বদ্ধ নয় । এদেশ থেকে নানান ছলেকলেকৌশলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিদেশের মাটিতে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে ।

আমি বাংলাদেশের একটি বহুমুখী বিশাল বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠানের খবর জানি । বিগত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনের তিন/চার মাস পূর্ব থেকেই সেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তাদের প্রধান কার্যালয় সিঙ্গাপুর ও মালায়েশিয়ায় স্থানান্তর করে পরিবার-পরিজনসহ সেখানে চলে যান । নির্বাচনের পর তার মনঃপূত রাজনৈতিক দলটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেই তিনি আবার প্রধান কার্যালয়সহ পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশে ফিরে আসেন । এভাবেই চলে আসছে দেশের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ লুটেরা রাজনীতিক আমলা ও ব্যবসায়ীদের এমনসব কায়কারবার ।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অঙ্গীকার ও দেশপ্রেমের প্রতি যারা দায়বদ্ধ নয় তাদের কাছে দুর্নীতি ও লুটপাটসহ নানান সমাজ ও দেশবিরোধী কার্যকলাপ হলো ভাত-মাছ । নিজেদের এবং তাদের গোষ্ঠীস্বার্থে তারা যেকোনো অন্যায় ও অপরাধ করতে তাদের বিবেকে বাঁধে না । দেশটা যে মুক্তিযুদ্ধের রক্তের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বে অর্জিত হয়েছে, এটা তাদের মনেই ধরে না । আজ যারা সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেসব রাজনীতিক, মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ী----এদের অধিকাংশের সাথে মুক্তিযুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই । যারা মুক্তিযুদ্ধের রক্ত ও কষ্ট দেখেছে, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করছে তারা দুর্নীতি ও লুটপাট করতে পারে না । আজকে দেশের মধ্যে যেসব মহাদুর্নীতিবাজ, লুটেরা ও মাফিয়াদের আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নয়-----যেমন বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, এস আলম, মেঘনাসহ বিভিন্ন মাফিয়াচক্র । এসব মাফিয়াচক্র গোটা দেশ এমনকি সরকার ও মিডিয়াকে জিম্মি করে ফেলেছে । এরা বিভিন্ন বাণিজ্যিক সিণ্ডিকেট সৃষ্টি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে সাধারণ মানুষকে শোষণ করছে, নিরীহ মানুষের জায়গাজমি দখল করছে, তাদের অপকর্মের বিরোধিতাকারীদের হত্যাসহ নানাভাবে অত্যাচার করছে । টাকার গরমে ব্যভিচার ধর্ষণ ও পাশবিকতা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে হেরেমখানার প্রচলন করছে ! কোনো সুন্দরী মেয়ে ও গৃহবধূ তাদের চোখে যদি পড়ে যায়, তাদের ভোগ করার লক্ষ্যে ছলেকলেকৌশলে তাদেরকে তাদের হেরেমখানায় রক্ষিতা করে রাখে । পরবর্তীতে তাদেরকে হত্যা বা গুম করা করে ফেলে । অর্থাত্ হেন কোনো অপকর্ম নেই যা এসব মাফিয়ারা সংঘটিত করে যাচ্ছে ।

আজ দু:খের সঙ্গে বলতে হয়, যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই দলটির পকেটে দেশের সিংহভাগ দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া এবং স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ঢুকে গেছে ! আওয়ামী নেতৃত্ব তাদের অর্থের কাছে আত্মসমর্পণ করে তাদের অনেককেই দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছে ! বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের মধ্যে নেই, ফলে তাদের প্রতি আমাদের কোন অনুযোগ নেই । আছে শুধু ধিক্কার । আমাদের আদর্শ, আমাদের চেতনা, আমাদের আশা-আকাঙ্খা, আমাদের মান-অভিমান-অনুযোগ সবকিছুই আওয়ামী লীগকে ঘিরে । আজ আওয়ামী লীগও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে যোজন মাইল দূরে অবস্থান করছে । তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দূরে ঠেলে দিয়ে রাজাকারদের কাছে টেনে নিচ্ছে !

আওয়ামী লীগের গর্ভ থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের আবির্ভাব । বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ----এই তিন মিলেই আওয়ামী লীগ । সেই আওয়ামী লীগের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার দাবিতে গোটা মুক্তিযোদ্ধা সমাজ চেয়ে আছে । কিন্তু তাদের কোনোই প্রতিক্রিয়া নেই । মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থসামাজিক উন্নতজীবনের আকাঙ্খা আজ মানবেতর জীবনে পর্যবসিত হয়ে গেছে । তারা বিনা চিকিৎসায় ও দারিদ্রের মধ্যে ধুকে ধুকে মরছে । অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার মাথা গোঁজার ঠাই নেই । সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে তাদের কোনো মর্যাদা নেই ।

এইতো গত বছর, ওমরা হজ্বে ষাটজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী হেফাজতি মোল্লাকে নেয়া হলো, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও নেয়া হলো না । সরকার প্রধানের বিদেশ সফরের সময় সমাজের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতিবাজ অনেকেই জামাই আদরে সফরসঙ্গী হয়, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও সে-সফরে নেয়া হয় না ! যে যৎকিঞ্চিত ভাতা দেয়া হয়, তাতে তাদের চিকিত্সা নিতেই তা খরচ হয়ে যায় । তার ওপর আছে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি । ইদানীং রাজাকারগোষ্ষ্ঠী তাদের ওপর একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে । বলা চলে তারা (রাজাকাররা) প্রায় সবাই এখন আওয়ামী লীগ করে এবং আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় এসব অপকর্ম করা হচ্ছে । গ্রামেগঞ্জে কিংবা শহরের সর্বত্র চলছে মুক্তিযোদ্ধা উৎপাটনের কার্যক্রম ।

এটাই হলো আজ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের অবস্থা । চারদিকে দুর্নীতি ও লুটপাটের হলাহলের ফলে সামাজিক মূল্যবোধে চরমতম ধস নেমেছে । মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা ও সৌজন্যবোধ হারিয়ে গেছে । সবকিছুই মূল্যায়িত হচ্ছে আর্থিক মাপকাঠিতে । সমাজের সৎ মেধাবী, ত্যাগী মানুষেরা অবমূল্যায়নের চরম শিকার হচ্ছে । দেশের প্রতি মমত্ববোধ আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে । মনে হয় যেন, বেছে বেছে খারাপ মানুষগুলোকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে বসিয়ে দেয়া হয়েছে । বেকারত্বের অভিশাপে বিশাল শিক্ষিত যুবসমাজ দিশেহারা । দেশের ভবিষ্যত নিয়ে কারো মাথা ব্যথা আছে বলেও মনে হয় না । সবাই আজ বিভ্রান্ত । সবাই আজ মরীচিকার পানে অন্ধের মতো ছুটে চলেছে । আর এই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ জঙ্গি অপশক্তির নিরব উত্থান ঘটছে । যেকোনো সময় তার মহাবিস্ফোরণ ঘটা অস্বাভাবিক নয় ।

দেশের চলমান সার্বিক রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারে উদ্বুদ্ধ শুভশক্তি তথা দেশপ্রেমিক সৎ মেধাবী ও সাহসী মানুষগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে অশুভ শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে । এর বিকল্প পথ খোলা নেই । মুক্তিযুদ্ধের গণবিপ্লবের ধারা যে অশুভশক্তি ও প্রতিবিপ্লবীচক্রের অপচেতনায় কলুষিত হয়েছে, সেই হারিয়ে যাওয়া বিপ্লবকে আবার টেনে আনতে হবে । নইলে বাঙালি জাতি, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাংলাদেশ চিরতরে হারিয়ে যাবে ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

১৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test