E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী কার্যক্রম  : কার দায় কতোটুকু

২০২১ মে ২১ ১৩:০০:১৫
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী কার্যক্রম  : কার দায় কতোটুকু

আবীর আহাদ


১৯৭৫ সাল । দেশী-বিদেশী স্বাধীনতাবিরোধী দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে । হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে । এরপর একইভাবে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে তারা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিলো । এসবের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার বিনাশের কার্যক্রম । তারই ধারাবাহিকতায় চলে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধ্বংস ও অবমূল্যায়নের প্রক্রিয়া । সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিশেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির ওপর চলে অত্যাচারের স্টিম রোলার । এ-লক্ষ্যেই জিয়া এরশাদ ও খালেদা-নিজামী সরকার বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে নানান মামলায় জড়িয়ে জেল খাটিয়েছে । অনেক নেতাকর্মীকে হত্যা ও নানাভাবে অত্যাচার করেছে । সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন থেকে শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও সৎ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করেছে । ঐসব শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা, লুটপাট ও তাদের রাজনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঐসব কাজগুলো অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছে । এসব বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে এক বিন্দুও ছাড় দেয়নি ।

কিন্তু আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জনগণের মঙ্গলের কথা বলে কী করে আসছে ? আগের একটার্ম ও চলমান তিনটার্ম একনাগাড়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেও জিয়া এরশাদ ও খালেদা-নিজামী অনুসারী তথা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অধিকাংশ দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের একটা কেশ স্পর্শ তো করেইনি----বরং তাদের কাছে থেকে মোটা অর্থ হাতিয়ে নিয়ে ও লুটপাটের ভাগাভাগির প্রক্রিয়ায় তাদের অনেককে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি দিয়েছে, লুটেরাদের অবাধে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে । বিএনপি-জামায়াতের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাদের নিজেদের বলয়ের মধ্যে কতিপয় শক্তিশালী মাফিয়া গ্রুপের জন্ম দিয়েছে । রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাসহ তাদের দলের বিশাল নিবেদিতপ্রাণ নেতা ও কর্মী বাহিনী থাকার পরও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ও বিএনপির অপরাধী, বিশেষ করে রাজাকার ও রাজাকার শাবকদের নিকট থেকে বিশাল অর্থ নিয়ে তাদেরকে মামলাসহ অন্যান্য ঝামেলা থেকে নিরাপত্তা দেয়ার পাশাপাশি তাদেরকেই দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ নিয়ে মূল আওয়ামী লীগারদের দূরে ঠেলে দিয়েছে ।

এ-সুযোগে রাজাকার শাবকরা আওয়ামী লীগের তকমা গায়ে জড়িয়ে তাদের রাজাকার বাপ-দাদাদেরকে যেসব মুক্তিযোদ্ধা জাতীয় স্বাধীনতার প্রয়োজনে হত্যাসহ নানান শাস্তি প্রদান করেছিলো, সেসবের প্রতিশোধ নিতে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, তাদের বাড়ি দখল, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ নানান অত্যাচার করে চলেছে । মুক্তিযোদ্ধারা আজ তাদেরই সৃষ্ট দেশে পরবাসী হয়ে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে । এ-ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কোনোই প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না ! অপরদিকে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিবাদী হেফাজতে ইসলামের সাথে রাজনৈতিক দহরম-মহরম করার ফলে ঐসব জঙ্গিরা দেশের সর্বত্র সাম্প্রদায়িকতার উন্মাদনা সৃষ্টি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে । জামায়াত-বিএনপি থেকে আগত ও হেফাজতী জঙ্গিরাই এখন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড়ো সমর্থক । মুক্তিযোদ্ধা ও বনেদি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এসব দেখে চরম হতাশা ও মনোবেদনায় নীরবে চোখের জল ফেলছে ।

জামায়াত-বিএনপির হাতে সৃষ্ট লুটেরা শ্রেণী আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর লোভী নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতা ও যোগসাজসে তারা আজ দেশের বড়ো বড়ো মাফিয়া । তারাই দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করছে, দেশের মধ্যে অতিবিলাসী জীবনযাপন করছে । আওয়ামী লীগের প্রশ্রয়ে বিএনপি-জামায়াতপন্হী আমলা ও ব্যবসায়ীরা দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে প্রায় ভেঙে দিয়েছে । আর হেফাজত ধ্বংস করছে আবহমানকালের বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য । এককথায় বিএনপি জামায়াত ও হেফাজত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী যে লুটেরা ধনবাদী রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ও অপসংস্কৃতির পথ রচনা করেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নামধারী আওয়ামী লীগ সার্থকভাবে সেই তাদের রচিত পথেই দ্বিধাহীন চিত্তে হেঁটে চলেছে । আর এর মাঝখানে চিপায় পড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বিশেষ করে বৃদ্ধ ও দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষীণকণ্ঠে আর্তনাদ করে চলেছেন ।

যে বিএনপি-জামায়াত সরকারের হাতে ৪০/৫০ হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে বলে আওয়ামী সরকারের কতিপয় মন্ত্রীসহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বক্তব্য বিবৃতি ও জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নানান উক্তি করেছিলেন, সেই আওয়ামী লীগ সরকার তাদেরকে বহাল রেখে গোঁজামিল মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞায় তাদেরই হাজার হাজার আত্মীয়স্বজন নেতানেত্রীকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন ! বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে ৮০/৮৫ হাজার অমুক্তিযোদ্ধা সগৌরবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছে । আমরা জানি যে, মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কোনো অবস্থাতেই ১লক্ষ ৫০ হাজারের বেশি হবে না, অথচ এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লক্ষ ৩৫ হাজারের মতো । এই ৮০/৮৫ হাজার অমুক্তিযোদ্ধা----এরা হলো সমাজের টাউট বাটপাঢ় ধান্দাবাজ এমনকি রাজাকার-আলবদর, যারা অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা বনে গিয়েছে ! বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নয়, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান অপমান ও অবমূল্যায়ন করবে, এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী লীগ কেনো তা করতে যাবে ? তাহলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় ?

যে বিএনপি-জামায়াত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ জামুকা সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে একটি গোঁজামিল সংজ্ঞায় তাদের দ্বি-দলীয় ক্যাডার এবং রাজাকার আলবদর আলশামস ও আলমুজাহিদের মধ্য থেকে প্রায় ৫০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টি করে গেছে, এসব জেনেও আওয়ামী লীগ সরকার সেই অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ না করে তারাও বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে বিএনপি-জামায়াত সরকারের অনুসৃত নীতিমালা অনুসরণ করে সেই পঞ্চাশ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বহাল রেখে তারাও তাদের প্রায় ৩০/৩৫ হাজার অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে ফেলেছে !

বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে কোনোই ভুল করেনি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে জেনে বা না-বুঝে বা তাদের অপরাজনৈতিক ও আর্থিক লাভের বেদীমূলে নিজেদের সমর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার যেসব ভুল করে আসছে তা কি তারা একবারও ভেবে দেখেছে ?

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখে দেশের রাজনৈতিক আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক ও জাতির নৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ যদি আত্মসমালোচনা আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযম না-করে তাহলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২১ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test