E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে পরিচালিত করার একটি প্রস্তাবনা

২০২১ জুলাই ০৩ ১২:৪৫:০৯
মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে পরিচালিত করার একটি প্রস্তাবনা

আবীর আহাদ


মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন চলা উচিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে। এটা না হওয়ার কারণে প্রজাতন্ত্রের গোটা প্রশাসন চলে গেছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকার-আলবদরদের উত্তরাধিকারদের হাতে, যাদের এদেশটির প্রতি বিন্দুমাত্র আনুগত্য নেই। তাদের পূর্বসূরিদের মতো তারাও আদর্শিকভাবে এদেশের স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতির প্রতি আস্থাশীল নয়। আস্থাশীল নয় রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতি : গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি। এদেশের মানুষের সুখ শান্তি কল্যাণ ও সমৃদ্ধি তাদের কাম্যও নয় । তারা চায় এদেশ, এ-জাতি ধ্বংস হয়ে যাক। তাই তো তারা বাংলাদেশের প্রশাসনের সর্বোচ্চ আসনে বসে বসে দুর্নীতি ও লুটপাটের হোলিখেলা চালিয়ে আসছে।

এই স্বাধীনতাবিরোধী দুর্নীতিবাজরা এতোটি ধুরন্ধর যে, তারা অতি বিনয়ী আচরণ ও বিপুল অর্থ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একশ্রেণীর লোভী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বশে এনে প্রশাসনে অবস্থান করে পদোন্নতি ও ভালো ভালো লাভজনক স্থানে পোস্টিং, এমনকি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পর্যন্ত বাগিয়ে নেয় । তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ডা: আবুল কালাম আজাদ, যিনি প্রশাসনে বিএনপিপন্থী বলে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন, যার বাবা ছিলেন একাত্তরে উত্তরবঙ্গের একটি জেলার শান্তি কমিটির সভাপতি। শুধু আমলা নয়, বিপুল অর্থ ছিটিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতিক বা তাদের উত্তরসূরি রাজনীতিকরাও যেকোনো ক্ষমতাসীন দলের এমপি-মন্ত্রীও হন । এরও জ্বলন্ত উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে ।

আজ যদি আপনি আমাদের সচিবালয়, বিভিন্ন অধিদপ্তর, অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাঙ্ক-বীমাসহ সরকারি আরো আরো প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকান, দেখতে পাবেন, বড়ো বড়ো সব পদে বসে আছে স্বাধীনতাবিরোধী পরিবার থেকে আগত আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজরা। আরো আশ্চর্য হয়ে দেখতে পাবেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিএনপি-জামায়াত ঘরাণার এসব আমলারা (প্রশাসন, প্রকৌশল, চিকিত্সা প্রভৃতি ক্ষেত্রের কর্তাব্যক্তিরা) আওয়ামী লীগ সরকার ও দলের নেতৃবৃন্দের বিপুল পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা পেয়ে আসছে। আর এর অন্তরালে রয়েছে ঐসব ধুরন্ধরদের মধুর ব্যবহার ও বিপুল অর্থের কারসাজি।

এ-প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। আমি সাধারণত: কোনো মন্ত্রীর কাছে যাই না। অনেকদিন আগের কথা। তো একবার কী একটা জরুরী প্রয়োজনে একদিন রাতে আওয়ামী লীগ সরকারের এক ডাকসাইটে মন্ত্রীর বাসায় যাই। এ মন্ত্রী একদা ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন বলে কথিত আছে। পরবর্তীতে তিনি সুযোগ থাকলেও মুক্তিযুদ্ধে যোগদান না করে পাকিস্তানে পোস্টিং নেন! তিনি ছিলেন হানাদার বাহিনীর এক নামকরা দালালের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। অর্থাত্ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের এ-লোক রাতারাতি আওয়ামী লীগার বনে গিয়ে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন! মন্ত্রীর বাসায় যেয়ে দেখি, ভিজিটরদের অধিকাংশই সচিবালয়-কেন্দ্রিক বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আমলা। তারা মন্ত্রী সাহেবের চারপাশে ঘনিষ্ঠভাবে বসে-দাঁড়িয়ে তাঁর সাথে মধুর ও বিনয়ী আলাপচারিতায় মশগুল। একদা সাংবাদিকতাসূত্রে সচিবালয়ের অধিকাংশ উচ্চপদস্থ আমলাদের সাথে পরিচয় ছিলো বলে সেদিন মন্ত্রী মহোদয়ের পাশে অবস্থানকারী অনেককেই চিনলাম। তারাই আমাকে একটু খাতির করে মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিলেন। কাজটি সেরে বাইরে এসে হেঁটেছি আর ভেবেছি, আওয়ামী মন্ত্রী মহোদয়কে কী সুন্দরভাবে ঐসব ধান্দাবাজ দুর্নীতিবাজ আমলারা গিল খাচ্ছে!

একনাগাড়ে দীর্ঘকাল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এভাবেই একশ্রেণীর আওয়ামী লীগ নেতা ও এমপি-মন্ত্রীদের হাত ধরে স্বাধীনতাবিরোধী পরিবার থেকে আগত আমলারা গোটা প্রশাসনকে তাদের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনে যেখানে থাকার কথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন, সেখানে আজ পুরোই অবস্থান করছে স্বাধীনতাবিরোধী দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা আমলাতন্ত্র ! আজ বাংলাদেশের সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, সরকারি কেনাকাটাসহ ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য আর্থিক খাতে যে সব সাগরচুরির ঘটনা ঘটছে, তার সাথে ঐসব ধুরন্ধর দুর্নীতিবাজ আমলারা জড়িত । আর একটা বিষয় লক্ষণীয় । ইদানিং বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের যে বিশাল ধনাঢ্য দশ লুটেরা ও মাফিয়ার কথা শোনা যায়, তাদের সবার অবস্থান মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ নেই! এমনকি বিভিন্ন স্তরের স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন দল, সংগঠন থেকে আগত অপরাধীচক্র আজ আওয়ামী লীগে ও সরকারের মধ্যে শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে। এতেই বুঝা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন, আর্থিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক খাত কাদের নিয়ন্ত্রণে সেখানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ঐতিহ্যের নামধারী আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘকাল ক্ষমতায় থেকেও যেনো শুধু ঘাস কেটেই চলেছে; ফসল তুলে খাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াচক্র !

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক আর্থসামাজিক প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সর্বত্রে জেঁকেবসা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তিসমূহকে নিয়ন্ত্রণ ও ধ্বংস করতে না পারলে, যে গতিতে তারা ছলেকলেকৌশলে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না। সুতরাং আর কোনো দ্বিধা নয়, আর কোনো দয়াদক্ষিণা নয়, আর কোনো বিবেচনা নয়, আর কোনো সংকীর্ণ আর্থিক লাভালাভ ও আত্মীয়তা নয় নয় কোনো আপোসকামিতা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে, তার চেতনাকে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এক্ষুণি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কী সেই ব্যবস্থা ?

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ-নির্দেশনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে, অন্যান্য কিছু রাজনৈতিক দলের সহযোগিতায় এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে। ফলে সংগত কারণে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে রক্ষা করা এবং মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে সরকার পরিচালিত হওয়া জাতীয় স্বার্থে একান্ত বাঞ্ছনীয়। সে-জন্যে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় পরিচালিত করার লক্ষ্যে আমি একটি প্রস্তাবনা পেশ করছি :

(১) আওয়ামী লীগ ও এর অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, কেন্দ্রীয় ও উপদেষ্টা পরিষদের সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সৎ, ত্যাগী ও মেধাবী লোকজনসহ মুক্তিযোদ্ধা/মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের নেতৃত্বের আসনে বসাতে হবে;

(২) ইউনিয়ন কাউন্সিল, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মূল দল ও সহযোগী সংগঠনসহ বাইরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যকার সৎ, ত্যাগী ও মেধাবীদের মনোনয়ন দিতে হবে;

(৩) নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং দল ও দলের বাইরে অবস্থানরত সৎ, ত্যাগী, অভিজ্ঞ ও মেধাবী লোকজনের সমন্বয়ে সরকারের মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে ;

(৪) প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে মন্ত্রী ও সচিবের মধ্যবর্তী একটি পদমর্যাদার তিন সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টামণ্ডলী থাকবে যারা মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম বিষয়ে পরামর্শ দেবেন;

(৫) সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কেনাকাটা সংক্রান্ত বিষয়াদিতে সরকারি আমলাদের পাশাপাশি একটি তিন সদস্য বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সংশ্লিষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে পরামর্শদাতা নিয়োগ করতে হবে;

(৬) বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফেরত আনতে হবে। অতীতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলাতন্ত্র ও পিএসসির বিমাতৃসুলভ আচরণের জন্যে এ কোটা প্রতিফলিত না হওয়ার ফলে প্রশাসনে মুক্তিযোদ্ধা/তাদের উত্তরসূরিরা প্রবেশ করতে পারেনি, ফলে প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরা জেঁকে বসেছে । মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাষ্ট্র কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি মর্যাদার প্রতীক ছিল। সেটি ফিরিয়ে এনে প্রজাতন্ত্রের সব সরকারি, আধা সরকারি ও সায়ত্তশাশিত সংস্থা, ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য সবস্তরে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৩০% কোটা কঠোরভাবে বলবৎ করতে হবে । পাবলিক সার্ভিস কমিশন তথা পিএসসিকে পরামর্শ দেয়ার লক্ষ্যে অভিজ্ঞ তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে পরামর্শদাতা নিয়োগ করতে হবে;

(৭) বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাঙ্ক, বীমা, অন্যান্য আর্থিক সংস্থা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে পৃথক পৃথকভাবে তিন সদস্য বিশিষ্ট সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে একটি পরামর্শদাতা নিয়োগ করতে হবে; এবং

(৮) জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (NSI), এসবি (SB), সিআইডি (CID) দুদক, বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি সংস্থায় এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ তিনজন মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে একটি করে পরামর্শদাতা নিয়োগ করতে হবে ।

দেশের একজন সচেতন নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে আমি দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় যেটা ভালো মনে করেছি, তারই আলোকে আমার এ প্রস্তাবনা জনসমক্ষে উত্থাপন করলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে পাথেয় জ্ঞান করেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের সুখ শান্তি কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করেন, যারা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনায় উদ্ভাসিত দেখতে চান, যারা দেশকে দুর্নীতি-সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসমুক্ত দেখতে চান তারা নিশ্চয়ই আমার এ-প্রস্তাবটিকে আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে তাদের বিজ্ঞ মতামত প্রদান করবেন ।


লেখক : লেখক-গবেষক, চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

০৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test