E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গৃহহীনদের জরাজীর্ণ বাড়ির মতো মুক্তিযোদ্ধাদের বীরনিবাস নিয়ে ভয়, গৃহঋণ দিন

২০২১ জুলাই ০৪ ১৫:০৭:০৫
গৃহহীনদের জরাজীর্ণ বাড়ির মতো মুক্তিযোদ্ধাদের বীরনিবাস নিয়ে ভয়, গৃহঋণ দিন

আবীর আহাদ


মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের জন্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের সদ্যনির্মিত বাড়িগুলো বসবাসের আগেই ভেঙে পড়ছে ! সম্প্রতি বিভিন্ন জাতীয় প্রচার মাধ্যমে এতদসংক্রান্ত সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে দেশব্যাপী জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় গৃহহীনরা এখন ইটের দালানে বসবাসের স্বপ্ন পরিত্যাগ করে আকাশের দিকে হা করে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন ! যেসব আমলা, প্রকৌলী, ঠিকাদার ও স্থানীয় দলীয় নেতা এ প্রকল্পের সাথে জড়িত ছিলেন, তারা ঠিকই তাদের কমিশন ও মুনাফা ষোল আনা বগলদাবা করেছেন, কিন্তু বাড়ি পেয়েও গৃহহীনরা সে বাড়ি ব্যবহার করতে রীতিমতো ভয় পাচ্ছেন কখন জানি সাধের দালান মাথায় ভেঙে পড়ে অক্কা যান! আর মাঝখান দিয়ে সরকার তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা ধুলায় লুণ্ঠিত হয়ে পড়েছে! এ অবস্থায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে নির্মিতব্য একই প্রক্রিয়ার বীর নিবাস প্রকল্পটিও যে একই জরাজীর্ণ ও দৈন্যদশায় পর্যবসিত হবে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। ফলে গৃহহীন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে তৈরিকৃত বীর নিবাস তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। কারণ মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে যে এসব নিবাসগুলো গৃহহীনদের বাড়ির মতো মুক্তিযোদ্ধাদের মাথায় বাজ হয়ে আছাড় খেয়ে পড়বে না তা কেউ আর হলফ করে বলতে পারছে না। স্থানীয়ভিত্তিতে যেসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা আমলা, প্রকৌশলী, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক পুচকে নেতা প্রধানমন্ত্রী উপহারের বাড়ি নির্মাণ কাজে জড়িত ছিলেন, বীর নিবাস প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বও সেই তাদের ওপরই ন্যস্ত হবে। ফলশ্রুতিতে গৃহহীনদের বাড়ির মতো যে লাউ সেই কদুতে বীরনিবাসও পরিণত হবে বলে প্রবল আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গত আর্থিক বছরের গোড়ার দিকে সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্যে বিনামূল্যে যে "বীর নিবাস" প্রকল্প অনুমোদন করেছিলেন, মাঝখানে একটি বছর অতিবাহিত হলেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অদূরদর্শিতা, অযোগ্যতা ও হীনম্মন্যতার কারণে কোনো কার্যকারিতা আজ পর্যন্ত আলোর মুখ না-দেখায় তা ভেস্তে গেছে। তাই এখন কথা উঠেছে, বিনামূল্যের করুণানির্ভর এবং আমলা, ঠিকাদার ও প্রকৌশলীদের জোড়াতালির বীর নিবাস নয় প্রত্যেক গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের ভাতা থেকে মাসিক ৫ হাজার টাকা কেটে নেয়ার শর্তে স্বল্প অথবা বিনাসুদে ২৫ লক্ষ টাকার গৃহঋণ প্রদান করুন । মুক্তিযোদ্ধারা সরকারের বীর নিবাস প্রকল্পের নকশা অনুসরণ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে ও দেখভালে নিজেরাই বাড়ি নির্মাণ করে নেবেন। এতে যেমন গৃহগুলো টেকসই হবে, অপরদিকে দুর্নীতিও বন্ধ হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধালরা ঋণ খেলাপিও হবেন না; সরকারি ঋণের অর্থ পর্যায়ক্রমে উঠে আসবে। এমন একটি সর্বজনগ্রাহ্য প্রস্তাব অনুমোদন করতে কোনো বিবেকবান মানুষ নীরব থাকতে পারেন না।

উল্লেখ্য যে,গত বছর ১৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে বাড়ি করে দেয়া হবে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বাহাদুর ঘোষণা দেয়ার পর উপজেলায় উপজেলায় যে বাণিজ্যিক ধান্দা শুরু হয়েছিলো, সেটাও ছিলো মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইয়ের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নির্মম এক তামাশা ! দেশের সিংহভাগ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলা চলে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করে চলেছেন । এ অবস্থায় ঐ তথাকথিত ১৪/৩০ হাজার তথাকথিত বীর নিবাস কারা কীভাবে কখন পাবেন তা আমাদের কাছে একেবারেই বোধগম্য নয় । তাছাড়া এই বিরাট সংখ্যক গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাকে পর্যায়ক্রমে বাড়ি করে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হলে সেজন্য কতোটি বছর অতিবাহিত হবে এবং ততোদিন মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকবেন কিনা তা কি কেউ বলতে পারবেন ? এ-ব্যতীত প্রত্যেক উপজেলায় প্রকৃতই গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি খরচে নির্মিত বাড়ি পাবেন তারও কী কোনো নিশ্চয়তা আছে ?

অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, উপজেলা পর্যায়ে একশ্রেণীর প্রতারকচক্র স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে পর্দার অন্তরালে সর্বোচ্চ ঘুষদাতা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অগ্রিমও গ্রহণ করেছে ! এ-প্রক্রিয়ায় আর্থিক প্রতিযোগিতায় কোনো প্রকৃতই গৃহহীন দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিবাসগুলো পাবে টাকাওয়ালা ও রাজনৈতিক যোগাযোগের অবস্থাসম্পন্ন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন উপজেলা থেকে তথাকথিত সরকারি বীর নিবাস প্রাপকদের যে তালিকা সুপারিশ আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠনো হয়েছিলো তার মধ্যে উপরোক্ত আশংকার সত্যতা পাওয়া গেছে । সুতরাং বিনামূল্যের তথাকথিত বীরনিবাস প্রকল্প বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গৃহঋণের অর্থ বরাদ্দ করুন ।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীবাহাদুর এ পর্যন্ত যতোগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার কী পরিমাণ বাস্তবায়ন ঘটেছে তা তিনি না জানলেও আমরা জানি । তাঁর কোনো প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়িত হয়নি । তাঁর প্রতিটি বক্তব্য ফাঁপা বুলিতে পরিণত হয়েছে । মুক্তিযোদ্ধারদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বে দেশটি স্বাধীন হয়েছে বলেই যিনি জীবনে যা কল্পনাও করেননি তিনি তাই হয়েছেন, হচ্ছেন এবং হতেই থাকবেন । অতএব জাতীয় দায়িত্ববোধ থেকেই সরকারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে ভুয়াদের উচ্ছেদ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে ; সামাজিক নিরাপত্তাসহ তাদের ন্যূনতম আর্থসামাজিক উন্নত জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে তাদের জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে ।

এছাড়া দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের বেকার সন্তানদের বিশেষ নিয়োগের মাধ্যমে সরকারি চাকরি প্রদানসহ বাজার মূল্যের সাথে সংগতি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী বর্তমানের বাজার পরিস্হিতির আলোকে বৃদ্ধিসহ প্রত্যেক গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের ভাতা থেকে মাসিক ৫০০০|= টাকা কেটে নেয়ার শর্তে এককালীন সুদবিহীন ২৫ লক্ষ টাকার গৃহঋণ প্রদান করুন । যা করার তা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবিতকালের মধ্যেই করতে হবে । কারণ মুক্তিযোদ্ধারা পৃথিবীতে আর তেমন বেশি দিন বাঁচবেন বলে মনে হয় না । এছাড়া তথাকথিত ৩০/১৪ হাজার বাড়ি বরাদ্দকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে টানাপোড়েনের মাধ্যমে একে অপরের সাথে চরম রেষারেষি ও হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে । কারণ সব মুক্তিযোদ্ধাই তো এ-সুযোগ পাওয়ার সমান অধিকারী । সবাই মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিতে গিয়েছিলো । মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কেউ ছোটো বা কেউ বড়ো মুক্তিযোদ্ধা বলতে কিছু নেই । সবাই মুক্তিযোদ্ধা । বাড়ি দিতে হলে সবাইকে একসাথে দিন, অন্যথায় এ অবাস্তব জগাখিচুড়ি ও হানাহানিপূর্ণ পরিকল্পনা বাদ দিন । তারচে' ভালো, সবাইকে গৃহঋণের আওতায় ছেড়ে দিন । যার প্রয়োজন সে ঋণ নেবে অথবা নেবে না । এতে সবাই একটি সান্ত্বনা পাবে । কোনো মন খারাপের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না, হবে না কোনো হানাহানি । অপরদিকে এ ঋণের বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঋণখেলাপীও হবে না । কারণ তারা ঋণ নেবে তাদের ভাতার বিপরীতে যে ভাতাটি সরকারেরই হাতের মুঠোয় ভাতাটিই তাদের ঋণের নিরাপত্তা কো-লেটারাল সিকিউরিটি হিসেবে গণ্য হবে ।

সুতরাং সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি না করে, তাদের মনে ব্যথা না দিয়ে অবিলম্বে বিনামূল্যের জরাজীর্ণ বীর নিবাস প্রকল্প বাদ দিয়ে বীর নিবাস নির্মাণের নকশা অনুসরণ সাপেক্ষে সব মুক্তিযোদ্ধার জন্য স্বল্প অথবা বিনাসুদে গৃহঋণের ব্যবস্থা করুন। বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে এটাই সব বীর মুক্তিযোদ্ধার একান্ত চাওয়া।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২৮ মার্চ ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test