E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দুর্নীতির রাঘবদের সর্বাগ্রে পাকড়াও করতে হবে 

২০২১ জুলাই ০৭ ১৫:০৮:১৯
দুর্নীতির রাঘবদের সর্বাগ্রে পাকড়াও করতে হবে 

আবীর আহাদ


মুজিব জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বভাবগত সংবেদনশীল হৃদয় দিয়ে হাজার হাজার ছিন্নমূল গৃহহীন মানুষের একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিচ্ছেন। 'আশ্রয়ণ' প্রকল্পের নামে সরকারি খাস জমিতে ব্যারাক জাতীয় গৃহ নির্মাণের কার্যক্রমে সারা দেশের বুকে এটা নিয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টিও হয়েছে। কিন্তু শুরুতেই তিনিসহ গোটা জাতি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। ছিন্নমূল মানুষেরা সাধের গৃহে প্রবেশের সাথে সাথেই সামান্য বৃষ্টিতে অধিকাংশ গৃহ ভেঙে পড়েছে। দালানগুলো চিৎপটাং খেয়ে হেলে ও খসে পড়েছে। যে বিপুল স্বপ্ন নিয়ে ছিন্নমূল মানুষেরা ইটের দালানে বসবাসের আনন্দ ও গৌবরবোধ নিয়ে নতুন গৃহে প্রবেশ করেছিলো, সেটি এখন এক ভীতিকর বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘরগুলো এখন তাদের কাছে মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়ে পড়েছে। এর মূলে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট। এ প্রকল্পের সাথে জড়িত আমলা, প্রকৌশলী, ঠিকাদার, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও স্থানীয় দলীয় নেতারা গৃহ নির্মাণের অর্থের ৯০% চেটে খেয়েছে বলেই ঘরগুলো ঠিকঠাক মতো নির্মিত হয়নি। সারা দেশে একযোগে এসব গৃহগুলোর দৈন্যদশা পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনসহ সামাজিক গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারিত হলেও, প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। শুধু শোনা যাচ্ছে যে, প্রধানমন্ত্রী নাকি এসব খবরে হতবাক হয়েছেন। এসব বলে বা শুনে দেশবাসীর লাভ নেই। কারণ দেশবাসী ভালো করেই জানে, দুর্নীতিবাজরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে। তারা কোনো বায়বীয় কথা শুনতে চায় না । তারা চায় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ। প্রয়োজনে প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলী করে দুর্নীতিবাজদের ভবলীলা সাঙ্গ করতে হবে।

এটা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ । ত্রিশ লক্ষ শহীদের পবিত্র রক্তভেজা বাংলাদেশ । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিসীম শৌর্য বীর্য ত্যাগ ও বীরত্বে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ । সেই বাংলাদেশ আজ সাগরসম দুর্নীতি লুটপাট ও মাফিয়াতন্ত্রে ডুবে হাবুডুবু খাচ্ছে । এদের কাছে দেশের সতেরো কোটি মানুষসহ সরকারও মনে হয় অসহায় ! জিম্মি । আসলে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিপুল অর্থের ভাগ পেয়ে যখন দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদেরকে আশ্রয় প্রশ্রয় ও নিরাপত্তা দেয়, তখন তাদের অপকর্ম অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলতেই থাকে । এ চলার পথেই সরকারও তাদের সহযাত্রায় সামিল হয়ে পড়ে ।

দুর্নীতি ও লুটপাটের কষাঘাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার হারিয়ে গেছে । সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র সীমাহীন অব্যবস্থা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে । মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক মূল্যবোধে চরম অবক্ষয় ঘটেছে । অনৈতিক আর্থসামাজিক ও দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অশুভতার ফলশ্রুতিতে সামাজিক ও মনোজগতে নির্দয় ও নিষ্ঠুর অপরাধ জেকে বসেছে । এর প্রভাবে পারিবারিক সামাজিক ও জাতিগত জীবনে অবিশ্বাস ও হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে । এর প্রভাবে পারিবারিক সামাজিক ও জাতিগত বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে । বিনষ্ট হচ্ছে দেশপ্রেম ও জাতীয় ঐক্য । বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মানুষের সুকুমার মনোবৃত্তির সব দুয়ার ।

জাতির নৈতিক চরিত্রের স্তর এতোটাই নিচে নেমে গেছে যে, স্বাধীনতার মাত্র কিছুকালের মধ্যেই দেশের তথাকথিত শিক্ষিত ও সুশীল সমাজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলে গেলো ! বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান শুধু তারা ভুলেই যায়নি, তাদের বীরত্বের অবদানকে অবমূল্যায়ন করে আসছে । তাদের প্রতি হিংসায় জ্বলে তাদের বীরত্বে ভাগ বসানোর জন্য দলে দলে রাজাকারসহ অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে । এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকার প্রচ্ছন্ন সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে ।

বঙ্গবন্ধু সরকারের বাহাত্তর সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার মধ্যেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নিহিত ছিলো । কিন্তু অতীতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং চলমান আওয়ামী লীগ সরকারের বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে গোঁজামিল সংজ্ঞায় অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর পশ্চাতে কাজ করেছে বিপুল অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক দলীয় স্বার্থ । মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গনে আজ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, ভুয়ার কারিগর ও হালের জামুকা একটি অভিশাপ হয়ে বিরাজ করছে ।

বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ না থাকার সুযোগে ইদানিং জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের কিছু কিছু কর্মকর্তা, যেমন সহকারী পরিচালক শাহ আলম ও আবদুল খালেক অর্থের বিনিময়ে যাকে তাকে এমনকি তাদের অমুক্তিযোদ্ধা বারা-শ্বশুরদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে ! জামুকা এখন নিজেই একটা মাফিয়াচক্র হিশেবে আবির্ভূত হয়েছে, যার চেয়ারম্যান স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী । এখানে এমপি নামধারী আরো কিছু রাঘব বোয়াল রয়েছে যারা নিজেদের এলাকার প্রভাবশালী কর্মীদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে চলেছেন !

আসছে আরেকটি প্রকল্প। বীরনিবাস। গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে সরকার বাহাদুর বড়ো দয়াপরবশ হয়ে এ বিশাল প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বলা বাহুল্য এ প্রকল্পটিও ছিন্নমূল মানুষের জন্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মতো হবে । এখানেও এ প্রকল্পের ৯০% ভাগ অর্থ চলে যাবে ঐ আমলা, প্রকৌশলী, ঠিকাদার, ইউপি চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক টাউটদের পেটে । একই দশা দাঁড়াবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মতো। বীরনিবাস হয়ে যাবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি মরণফাঁদ। এজন্য আমি অতীতে বহুবার এমনকি এখনো বলছি যে, সরকারি খরচে বীরনিবাস নয়, প্রত্যেক গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাকে মাসিক সম্মানী থেকে ৫ হাজার টাকা কেটে নেয়ার শর্তে সুদবিহীন বা নামমাত্র সুদে ২৫ লক্ষ টাকা ব্যাঙ্কঋণ হিশেবে বরাদ্দ দেয়া হোক । মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই সরকারের নকশা অনুসরণ করে বীরনিবাস তৈরি করে নেবে। এতে দুর্নীতিবাজদের কমিশন ও ঘুষের হাত থেকে প্রকল্পটি রক্ষা পাবে । মুক্তিযোদ্ধারা এ পদ্ধতিতে ঋণ খেলাপি হবেন না । কারণ তাদের মাসিক সম্মানী তো সরকারের হাতেই রয়েছে। ওখান থেকে সরকার ঋণের কিস্তি কেটে নিতে পারবেন। এ ধরনের পদ্ধতিতে যদি সরকার গররাজি হন, তাহলে বুঝে নিতে হবে যে, সরকার নিজেই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।

এসব অপরাধের মূলেই রয়েছে সমাজ-রাষ্ট্রে দুর্নীতিবাজ লুটেরা রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ও মাফিয়াচক্রের জঘন্যতম ক্রিয়াকলাপকে প্রশ্রয় দেয়ার ফলশ্রুতি । এসব চক্রকে উচ্ছেদ করতে না পারলে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মূল্যহীন হয়ে পড়বে এবং তিলে তিলে দেশটি ধ্বংসের অতলগহ্বরে হারিয়ে যাবে ।

আজকে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে সরকারের যে কিছু ঢিমেতাল পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেটিকেও সাধু জানিয়ে বলছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যখন অভিযান পরিচালনা করতে চান তখন দুর্নীতির নিচুস্তর শুধু নয়, উপরিস্তরেও সমানতালে চালাতে হবে । দুর্নীতি বলেন, লুটপাট বলেন, মাফিয়াতন্ত্র বলেন এসবের শুরু ওপর থেকেই হয়ে থাকে । এসবের গডফাদাররা ওপরেই অবস্থান করে । আর এসব গডফাদারদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে নিচের চুনোপুঁটিগুলোর জন্ম ।

বেশ কিছুদিন আগে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রয়াত ইব্রাহিম খালেদ একটা সুন্দর, তাৎপর্যপূর্ণ ও যুক্তিযুক্ত কথা বলেছিলেন । তিনি বলেছিলেন, ক্যাসিনো সম্রাট ধরেছেন, ব্যাংকিং সম্রাটকেও ধরুন ! এ কথার মধ্য দিয়ে তিনিও বুঝাতে চেয়েছেন যে, দুর্নীতি লুটপাট ও মাফিয়াতন্ত্রের চুনোপুঁটিদের পাশাপাশি এসবের মহাদানব রাঘব বোয়ালদেরও ধরতে হব বিনাশ করতে হবে ।

সুতরাং ঢাকঢোল পিটিয়ে দু'চারজন চুনোপুঁটিকে ধরা হলে রাঘব বোয়ালদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় । ইতিমধ্যে কিছু রাঘব বোয়াল করোনার অজুহাতে নিজেদের চার্টার্ড বিমানে করে বিদেশে পালিয়ে গেছে । পালিয়ে গেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কথিত মাফিয়া ডন মিঠুও । কিছু চুনোপুঁটি ধরার এ-সুযোগে মাফিয়া সম্রাটরা সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে নস্যাত্ বা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চক্রান্তের জাল বুনতে নানান তৎপরতা করছে তা বুঝা যাচ্ছে । ইতিমধ্যে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী ঢিলেঢালা অভিযানকে তথা চুনোপুঁটি ধরার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখার ফলে দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান নিয়ে জনমনে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, ফলশ্রুতিতে জনমত সরকারের বিপক্ষে প্রবাহিত হচ্ছে, যা সরকারের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না । এভাবে যদি সমাজ ও রাষ্ট্র চলতেই থাকে তাহলে ধেয়ে-আসা প্রলয়কে কোনোভাবেই সামাল দেয়া যাবে না ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test