E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্রোতের উজানে স্বামীর লাশ!

২০২১ জুলাই ১৪ ১৪:৫১:১১
স্রোতের উজানে স্বামীর লাশ!

রহিম আব্দুর রহিম


ছোট বেলায় একটি গল্প শুনেছিলাম বাবার মুখে, “গ্রামের এক ব্যক্তি প্রতিদিন তার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হতো, স্ত্রীকে কারণে-অকারণে বেধম মারধর করতো। স্ত্রীর কোন কথাই সে শুনতো না। স্ত্রী যদি তাকে ডানে যেতে বলতো, তবে বামে যেতো। এক দুপুরে এই ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বেধম মারধর করে নদীর ওপাড়ে গরু চড়াতে যায়। স্ত্রী এবার স্বামীর অনুপস্থিতিতে নদীর পাড়ের বট গাছের নিচে বসে কান্নাকাটি শুরু করে। দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা। স্বামী তার পালের গরু নিয়ে নদীর ওপাড়ে রকি নারায় হাজির। স্রোতস্বিনী ভরা নদী, ওপাড়ে দাঁড়িয়ে স্বামী মালকোচা দিচ্ছে। এই ঘটনা নজরে পরে স্ত্রীর। স্বল্প সময়ের মধ্যে ওই ব্যক্তি গরুটি নিয়ে নদীতে নামছে। এক সময় ভয়াবহ স্রোতের মাঝে এসে ওই ব্যক্তি নিরাপদে নদী পার হতে তার গরুর লেজ ধরে ফেলে। বিষয়টি এ পাড়ে বসা স্ত্রী দেখতে পেয়ে স্বামীর জন্য তার মায়া হয়। সে তার স্বামীকে উচ্চস্বরে বলতে থাকে, ‘লেজ কষে ধরো, স্রোত বইছে, ছেড়ে দিলেই মরে যাবে। কোনদিনই তো আমার কথা শোননি। আজ শোন।’ এই কথা শোনার পর একরোখা প্রকৃতির এই জেদি লোকটি যেইনা গরুর লেজটি ছেড়ে দিল, অমনি সে নদীর ভয়াবহ স্রোতের তোড়ে পরে সে মারা গেল। এবার তার স্ত্রী স্বামীর মৃতদেহ খুঁজতে নদীর পাড় ধরে উজানের দিকে হাঁটা শুরু করল। আর লোকজনকে জিজ্ঞেস করছে, তার স্বামীর লাশ কেউ দেখেছে কিনা। এক উৎসুক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে আপনার স্বামীর? মহিলা উত্তর দিলো, আমার স্বামী ভরা নদী গরুর লেজ ধরে পার হচ্ছিল, নদীর মাঝখানে এসে সে গরুর লেজ ছেড়ে দিলে স্রোতের তোড়ে আমার স্বামী মারা গেছে। ব্যক্তি তাকে বললো, তাহলে তো লাশ ভাটির দিকে গেছে। উজানে খুঁজছেন কেন? এবার ওই মহিলা চিৎকার করছে আর বলছে, আমার স্বামী বেঁচে থাকতে খালি উজান ধরছে, ডানে যেতে কইলে বায়ে গেছে, এবারও সেই উল্টো পথেই যেতে পারে।”

গল্প নয়। প্রাসঙ্গিক, সারা পৃথিবী জুড়ে করোনা মহামারি, মৃত্যুর মিছিলের সাথে ক্ষুধা মৃত্যুর হার বাড়ছে। ৯ জুলাইএকটিঅনলাইনেপ্রকাশিত এক রিপোর্টে বলাহয়েছে, ‘বিশ্বে করোনায় মিনিটে মারা যাচ্ছে ৭ জন। ক্ষুধায় মিনিটে মারা যাচ্ছে ১১ জন। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বিশ্বে দুর্ভিক্ষের মত পরিস্থিতি ৬ গুন বেড়েছে। ৯ জুলাইআন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম এক নতুনপ্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। বৈশ্বিক সমস্যা করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় পৃথিবীর অনেক দেশেই ‘লকডাউন’, ‘সাটডাউন’ এর মত বিধিনিষেধ প্রয়োগ করে সফলতার মুখ না দেখলেও জনভোগান্তি বাড়ানোর অভিযোগ কাঁধে নিয়েছে। যা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজছে। করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ননকমিউনিক্যাল ডিজিস কন্ট্রোল, এনসিডিসি পরিচালক ও অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদা আমিন সম্প্রতি কারফিউ জারির মতামত দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার অলরেডি প্রজ্ঞাপন জারি করে ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই ভোর ৬ টা পর্যন্ত বিধিনিষেধ শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছেন। সিদ্ধান্তটি সম্মানসূচক রাষ্ট্রীয় স্বার্থপন্থী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওই ব্যক্তির কথা অনুযায়ী কারফিউ জারি করলে কি হত তা হয়ত সুপারিশকারি বুঝতে পারেনি। বিধিনিষেধকালে পুলিশ রাস্তায় আটক রেখেছিল অক্সিজেন বহনকারি এক মোটরসাইকেল আরোহীকে। ফলে ওই ব্যক্তির বাবার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। কারফিউ হলে সৃষ্টি হত কলঙ্কের ইতিহাস।

ভীড় এড়িয়ে চলা নিশ্চিত করতে ‘লকডাউন’ বা ‘সাটডাউন’ কীভাবে যৌক্তিক হয় এই হিসেব মেলানো যাচ্ছে না। যেখানে ২৪ ঘন্টা দোকানপাট খোলা রাখলে ভীড় কমে না, সেখানে সময়সীমা কমিয়ে এনে ভীড় এড়ানোর অঙ্কটি কোন বিজ্ঞানী আবিস্কার করেছেন, তা এখনও জানা গেলনা। গণপরিবহন বন্ধ রেখে মানুষের চলাফেরায় ভোগান্তি বাড়ানো ছাড়া তেমন কিছু সুফল আসেনি। ভীড় এড়িয়ে চলতে হলে গণপরিবহন এর সংখ্যা পূর্বের তুলনায় বাড়িয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাফেরার ওপর গুরুত্ব বাড়ানোর পরামর্শ কোথায় পাওয়া না গেলেও, ‘বাংলাদেশের ওপর বিশ্বের রেড অ্যালার্টের’ খবর কিন্তু পাওয়া গেছে। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ওপর বিশ্বের রেড অ্যালার্ট দেওয়াটা উদ্দেশ্য প্রনোদিত, টিকা পাওয়া নিয়েও আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিকার হয়েছে বাংলাদেশ।’ তার এই মতামতের সত্যতা রয়েছে। ইতিহাস এমনটাই সাক্ষ্য দেয়। বিশ্বের মোড়লরা বাদে প্রায় দেশগুলোই এক বৈশ্বিক রাজনীতির মহাকবলের দিকে এগোচ্ছে।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষটি এসেছিল বিশ্ব রাজনৈতিক চক্রান্তেই। জাল পরা বাসন্তির আবির্ভাবও ঘটেছিল সেইকালে। ওই সময় বিশ্বের এক প্রান্তের ষড়যন্ত্রের শিকার হলেও অন্য প্রান্তের সহযোগিতা পাওয়া গেছে। বর্তমানে এ ধরনের কোন ষড়যন্ত্রের কবলে আমাদের বাংলাদেশের মত কোন দেশ যদি পড়ে, তবে বৈশ্বিক সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, ইস্যু সবার একটাই, ‘মহামারি করোনা’।

বাঙালি জাতি জন্মগত এবং প্রকৃতিগতভাব একরোখা। যাকে ভাল লাগবে না তার কথা যতই ভাল হোক না, তা শুনবে না, মানবে না। বহুদল, নানা গোষ্ঠীর মতের এই দেশের রাজনৈতিক ধারা অদ্ভুদ। এক দলের কথা অন্য দলের লোকজনরা শুনে না, মানে না। যতই স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হচ্ছে, ততই তা উল্টো রথে চলছে। এই মুহুর্তে দেশের সকল স্তরের রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত যারযার অবস্থান থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় করনীয় নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন।

আমাদের প্রচন্ড ভাবনার বিষয় মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০২০ সালের ৭ মার্চ এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘দেশের একটি মানুষও গৃহহীন বা ভূমিহীন থাকবে না।’ যেই কথা সেই কাজ। তাঁর স্বপ্নের আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে ১৮ হাজার ৩৮০টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। গরীবের জন্য প্রধানমন্ত্রীর এই উপহার ধসে পড়া শুরু হয়েছে। ২২ জেলায় এই দুর্নীতিবাজদের খোঁজ মিলেছে। আরেকটু এগোলেই সারাদেশের চিত্র উঠে আসতে পারে। দেশের প্রতিটি প্রকল্পেই গেড়ে বসেছে এই রথি-মহারথিরা।

বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী কাজ করছে। সম্প্রতি এক গরুর হাটে সেনাবাহিনী আসার খবর পেয়ে ক্রেতা-বিক্রেতারা তাদের পশু রেখেই দৌঁড়াদৌঁড়ি ছোটাছুটি করে পালিয়েছে। ভাগ্যিস, কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে হাট-বাজারে পাকবাহিনী আসার আতঙ্ক ছড়িয়ে দোকানপাট লুটতরাজ করেছে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিরা। ক্রান্তিকালে সেনাবাহিনীর আতঙ্ক ছড়িয়ে নতুন ঘটনার জন্ম দেওয়ার মত অনেকেই রয়েছে। আর্মিকে মানুষের মুখোমুখি নয়, পাশাপাশি রাখার মত কর্মকান্ডে নিয়োজিত রাখা হলে, বাহিনীটির ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে।

দুর্দিন-দুঃসময় বলে আসে না। তবে, অনুমান করা যায়। সকল রোগ-ব্যধি, দুঃখ-কষ্ট, দুর্যোগ-মহামারীর সাথে বসবাস করার পূর্ব অভিজ্ঞতাকে আরও শানিত করা যায় কিনা, এমনটি ভাবতে হবে সামষ্টিকভাবেই।


লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও নাট্যকার।

পাঠকের মতামত:

১৯ মার্চ ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test