E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা, সরকার ও হাইকোর্ট

২০২১ জুলাই ২১ ১৫:১১:৫৮
বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা, সরকার ও হাইকোর্ট

আবীর আহাদ


সম্প্রতি বাংলাদেশের হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ একটি রীটের প্রেক্ষিতে সরকারের ওপর রুল জারি করেছেন। রুলে হাইকোর্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাকে মৌলিক সংজ্ঞা গণ্য করে এর সাথে সাংঘর্ষিক অন্যান্য সংজ্ঞা, লাল মুক্তিবার্তা ও নির্দেশনাকে কেনো বেআইনি ও অকার্যকর ঘোষণা করা হবে না, সে-বিষয়ে সরকারকে চার সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে বলেছেন। এ অবস্থায় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও উচ্চ আদালতের অবস্থান কী হবে সেটা ভবিষ্যত বিচার্য বিষয়। তবে হাইকোর্টের এ রুলটি প্রচারিত হওয়ায় বিশেষ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা মহলে চেতনার একটি দারুণ উজ্জীবন পরিলক্ষিত হয়েছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের রক্তাক্ত প্রান্তরের সাথে সরাসরি জড়িত বীর মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেন যে, বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে প্রণীত মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞাটির মধ্যে কোন প্রক্রিয়ায় একজন মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে গণ্য হবেন, সে বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তো এ বিষয়ের গভীরে যেতে হলে আমাদেরকে ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে।

বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে সবচে' বড়ো গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আর মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানী যাদের সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বে মুক্তিযুদ্ধে আমরা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় লাভ করেছি, ইতিহাসে তারা "বীর মুক্তিযোদ্ধা" নামে পরিচিত। আর "মুক্তিযোদ্ধা" শব্দটি যুদ্ধের মাঠ থেকে মুখে মুখে প্রচলিত হলেও এর পশ্চাতে একটি আইনী ভিত্তি বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি একান্ত আবশ্যকীয় ছিলো।

সে-নিরিখেই স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই অর্থাত্ ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংজ্ঞা দিয়ে বলেছিলেন। সেটি হলো : মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যেকোনো সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য হিশেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন----যেটির মূল ঘোষণা নিম্নরূপ : (1972) : Freedom Fighters (FF) means any person who had served as member of any force engaged in the War of Liberation।

এ সংজ্ঞাটি রাষ্ট্রপতির আদেশে সরকারি গেজেট দ্বারা অনুমোদিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সঠিক সংজ্ঞা বলে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। এ মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা দ্বারা কেবলমাত্র সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারাই 'মুক্তিযোদ্ধা' বলে গণ্য হবেন। এ সংজ্ঞার আলোকে মুজিবনগর সরকারের নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডের অধীনস্থ সেনা-বিমান-নৌ বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, এফএফ-গণবাহিনী, বিএলএফসহ দেশের অভ্যন্তরে গড়েওঠা কাদেরীয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, হালিম বাহিনী, আবসার বাহিনী ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য সবাই বঙ্গবন্ধুর সংজ্ঞার মুক্তিযোদ্ধা বলে গণ্য হবেন।

তবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, তৎকালীন এমসিএ, কূটনীতিকবৃন্দ, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, স্বাধীনবাংলা বেতারের কলাকুশলী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিত্সক, ফুটবলার প্রভৃতি অ-সশস্ত্র ব্যক্তিবর্গও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। তাঁদের অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি দেয়া হোক তা আমরাও চাই। তবে সবাইকে গড়ে "বীর মুক্তিযোদ্ধা" বলে দেয়া হবে চরম ইতিহাস বিকৃতি। মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্মপ্রক্রিয়ার নিরিখে যার যার ভূমিকার স্বীকৃতি দিতে হবে। একজন বাঁশিবাদক বা একটি গানের দোহাড় মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে অবগাহন করে শত্রুকে মেরে, নিজে মরে বা বুলেট ও গ্রেনেডে হাত পা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া কোনো ব্যক্তির সমান্তরাল নন। যার যার কর্মপ্রক্রিয়া বিচার-বিবেচনা করা হলে যার যার অবদানকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়; কারো সঙ্গে কারো সংঘর্ষ বাঁধার অবকাশ থাকে না। সুতরাং সশস্ত্র বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একদিকে রেখে, অন্যান্যদের যার যার কর্মপ্রক্রিয়া অনুযায়ী অন্য যেকোনো ঐতিহাসিক অভিধায় স্বীকৃতি দেয়া যেতেই পারে।

সরকারি গেজেট দ্বারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা যা অদ্যাবধি কোনো সরকার স্থগিত বা বাতিল করেছে বলে জানা যায়নি। অপরদিকে উক্ত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা বহাল থাকা অবস্থায়, সেটিকে বাইপাস করে অতীতে বিএনপি-জামায়াত সরকার ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত কোনো প্রকার সংজ্ঞা বা নির্দেশিকা প্রণয়ন না করেই, বলা চলে, গায়ের জোরে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন প্রায় ৪০/৫০ হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকার আলবদর ও আলশামসদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে ফেলে! এ-বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী-এমপি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একাধিকবার এ-অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। তারা ঘোষণাও করেছিলেন যে, তারা ক্ষমতায় এলে এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ করবেন। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অদ্যাবধি তারা ঐসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ দূরের কথা, তারাও বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে বরং ২০১৬ সালে আরেকটি সংজ্ঞা প্রণয়ন করে। তারা বিএনপি আমলের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল তথা জামুকা নামক একটি কর্তৃপক্ষের অনুকরণে সেই গোঁজামিলের সংজ্ঞায় অর্থের বিনিময়ে, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায়, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এমন সব অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার সর্বনাশা অপকর্মে এখনো লিপ্ত রয়েছে!

আওয়ামী লীগ সরকারের ২০১৬ সালে প্রণীত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞায় বলা হয়েছে : "যে সমস্ত ব্যক্তি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন" তারা মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিগণিত হবেন যেটির মূল ঘোষণা নিম্নরূপ (2016) : The people who were involved in the liberation war in response to the call of the Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman in between March 26 and December 16, 1971.

এ সংজ্ঞার বদৌলতে "মুক্তিযোদ্ধা"র বাইরে অন্য যেকোনো ব্যক্তিরাও মুক্তিযোদ্ধা বলে বিবেচিত হবেন যা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চরম অবমূল্যায়ন করার একটি অমার্জনীয় অপরাধ। এ মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার নামে যেটা করা হয়েছে, আসলে তা মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা নয়, মুক্তিকামী জনগণের কথা বলা হয়েছে। এ সংজ্ঞা দিয়ে আসলে যাকে তাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর একটা ফরমুলা বের করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, ফোর্স ও যুদ্ধ জড়িত যেটি ৭২ সালে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার 'ফোর্স' শব্দিটির মধ্যে মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে, কিন্তু ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রণীত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার মধ্যে ঐ প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, ফোর্স ও যুদ্ধের কথা নেই। সুতরাং এটা মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নয়, এটা মুক্তিকামী জনগণের সংজ্ঞা ।

পূর্ববর্তী কোনো একটি সরকারের কোনো একটি গেজেটীয় আদেশ পরবর্তীকালীন কোনো একটি সরকার বহাল রেখে, সেটিকে বাইপাস করে একই প্রসঙ্গে নিশ্চয়ই আরেকটি গেজেট জারি করতে পারেন না! এমনটি করা হলে সেখানে সরকার বা শাসকগোষ্ঠীর সংকীর্ণ ব্যক্তি ও রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থের করার সুযোগ থাকে বলে প্রতীয়মান হয় যা রাষ্ট্রীয় লুকোচুরির সামিল। তাছাড়া একই বিষয়ের ওপরে দু'টি রাষ্ট্রীয় গেজেট আইনসম্মত নয় বলেও মনে হয়।

আরেকটি বিষয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সেটি হলো, সরকারের ভেতরে অবস্থানকারী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো একটি অদৃশ্য অপশক্তি বাবা-মেয়ের ( বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা ) সরকারকে মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা নিয়ে জনসমক্ষে ও ইতিহাসের গতিপথে বিতর্কিত ও হেয়প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে এমন একটি সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি করেছে বলে আমাদের মনে হয়, যা হয়তো বঙ্গবন্ধু-কন্যা খতিয়ে দেখছেন না বা বুঝতে চেষ্টা করছেন না ! পরিতাপের সাথে বলতে হয়, অন্তরালে এমনই খেলা চলছে যে, বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটাটি বাতিল করতে হয় তাঁর কন্যার হাত দিয়ে! অনুরূপ বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাটিও অবমূল্যায়ন বা বাতিল করতে হয় তার কন্যার মাধ্যমে! বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাত দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আর কী কী বাদ দেয়া হবে, কে জানে! মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে এসব কী হচ্ছে? কারা এসব করাচ্ছে? কেনো কেউ বুঝতে পারছেন না? কেনো এতোসব রাষ্ট্রীয় লুকোচুরি সংঘটিত হচ্ছে?

সুতরাং মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা নিয়ে যা হচ্ছে তাকে রাষ্ট্রীয় জোচ্চুরিও বলা যেতে পারে। এটা রাষ্ট্রীয় বিভ্রান্তিও বটে । কোনো সভ্য সরকার বা রাষ্ট্র তার জন্মদাতাদের সংজ্ঞা ও মর্যাদাকে অবমূল্যায়ন করার এমন ন্যক্কারজনক অপকর্ম করতে পারে, তা ভাবনার অতীত। জাতীয় মর্যাদা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা ও ভব্যতার স্বার্থে এ লুকোচুরির অবসান একান্ত জরুরি। হাইকোর্ট সংগতকারণে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে এনে সরকারের কাছে তাদের মনোভাব বা ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন। জাতীয় ইতিহাসের পবিত্রতা তথা বঙ্গবন্ধু ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সংরক্ষণ ও সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সরকার ঐতিহাসিক সত্য প্রতিষ্ঠার এ মাহেন্দ্রক্ষণে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

১৯ মার্চ ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test