E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

১৫ আগস্ট নিরন্তর রক্তক্ষরণের আরও একটি নাম ‘শেখ আবু নাসের’

২০২১ আগস্ট ২৩ ১৪:১২:৩৭
১৫ আগস্ট নিরন্তর রক্তক্ষরণের আরও একটি নাম ‘শেখ আবু নাসের’

এম. আব্দুল হাকিম আহমেদ


ভারতীয় উপমহাদেশ তখনও ব্রিটিশ উপনিবেশ। সুদীর্ঘকালের শাসন-শোষণে নিষ্পেষিত ভারতবাসি পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলার জন্য সংগ্রাম রত। ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বাংলা প্রদেশের অধিবাসীরাও তখন সংগ্রাম মুখর। মুক্তি পাগল সেই বঙ্গভূমির পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর পলিমাটি বিধৌত শস্য শ্যামল তদানীন্তন ফরিদপুর জেলাধীন গোপালগঞ্জ মহকুমার বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সুন্দর একটি গ্রাম। সে গ্রামটির নাম টুঙ্গিপাড়া বাইগার নদী এঁকে বেকে গিয়ে মিসেছে মধুমতী নদীতে। এই মধুমতী নদীর অসংখ্য শাখা নদীর একটি নদী বাইগার নদী। নদীর দুপাশে তাল, তমাল, হিজ্বল গাছের সবুজ সমারোহ। ভাটিয়ালি গানের সুর ভেসে আসে হালধরা মাঝির কন্ঠ থেকে, পাখির গান আর নদীর কলকল ধ্বনি এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশ গড়ে তোলে। প্রায় দু’শত বছর পূর্বে মধুমতী নদী এই গ্রাম ঘেঁষে বয়ে যেত। এই নদীর তীর ঘেঁষেই গড়ে উঠে ছিল জনবসতি। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ধীরে ধীরে নদীটি দুরে সরে যায়। চর জেগে গড়ে ওঠে আরও অনেক গ্রাম। সেই দু’শত বছর আগে ইসলাম ধর্মপ্রচারের দায়িত্ব নিয়েই শেখ পরিবারের পূর্ব-পুরুষরা এসে এই নদী বিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুষমামন্ডিত ছোট্ট টুঙ্গিপাড়া গ্রামটিতে তাদের বসতি গড়ে তোলেন। শেখ পরিবারের ব্যবসা-বানিজ্য ছিল কলকাতা বন্দরকে কেন্দ্র করে। শেখ পরিবারের সদস্যগণ গ্রামের বসবাসকারী কৃষকদের সাথে নিয়ে অনাবাদী জমা-জমি চাষাবাদ করে টুঙ্গিপাড়াকে বর্ধিষ্ণু গ্রামরূপে গড়ে তোলেন। টুঙ্গিপাড়া গ্রামে যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল নৌকা নির্ভর। শেখ পরিবারের পূর্ব পুরুষরা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে কলকাতা থেকে কারিগর ও মিস্ত্রি এনে দালান বাড়ি তৈরি করেন। যা সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে। ১৯৭১ সালের যে দুটো দালানে বসতি ছিল পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী আগুন দিয়ে সে দুটোই জ্বালিয়ে দেয়।

এই দালান কোঠায় বসবাস শুরু হবার পর ধীরে ধীরে বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে আর আশপাশে বসতির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এই দালানেরই উত্তর-পূর্ব কোনে টিনের চৌচালা ঘর তোলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাদা শেখ আব্দুল হামিদ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা শেখ লুৎফর এই বাড়িতেই সংসার গড়ে তোলেন। শেখ লুৎফর রহমান পেশাগত জীবনে ছিলেন দেওয়ানী আদালতের একজন সেরেস্তাদার। পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত তাঁর জমি-জমাও ছিল প্রায় শতাধিক বিঘা। তাঁদের পরিবারে প্রাচুর্য ছিলো না, ছিল সচ্ছলতা। শেখ লুৎফর রহমানের নিজের জমির যে পরিমাণ ফসল তার গোলা ভরে উঠতো তা দিয়ে সারা বছরই স্বচ্ছন্দে চলে যেত। শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন খাঁটি বাঙালী, মুসলমান সুফি প্রকৃতি স্বভাবের। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের স্ত্রীর নাম ছিলো শেখ সায়রা খাতুন। শেখ লুৎফর রহমানের ছিল ছয় সন্তান। চার মেয়ে ও দুই ছেলে। ছয় সন্তানের নাম ছিল বড় মেয়ে ফাতেমা বেগম, মেজো মেয়ে আছিয়া বেগম, শেখ মুজিবুর রহমান, আমেনা বেগম হেলেন, খোদেজা বেগম লিলি ও শেখ আবু নাসের। শেখ লুৎফর রহমানের সন্তানদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয় সন্তান, কিন্তু পুত্র সন্তানদের মধ্যে প্রথম। দুজন কন্যা সন্তানের পর মুজিবকে পেয়ে সব বাবা মায়ের মতো শেখ লুৎফর রহমান ও তার স্ত্রী শেখ সায়রা খাতুন স্বভাবতই অত্যন্ত খুশী হয়েছিলেন এবং তার উপর আদর স্নেহের মাত্রাও একটু বেশি ছিলো। শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম পুত্র সন্তান হওয়ায় তাকে ঘিরেই মা-বাবার স্বপ্ন রচনা শুরু হয়। ছেলেদের মধ্যে বড় শেখ মুজিব এবং ছোট ছিলেন শেখ আবু নাসের। শেখ আবু নাসের ছোট বেলায় টাইফয়েড রোগে ভুগেছিলেন এবং তার একটি পা বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার একমাত্র ছোট ভাই শেখ আবু নাসের এই দুই ভাইয়ের গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ, আর শেখ আবু নাসেরের জন্ম ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। বড় ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে বয়সে সাড়ে আট বছরের ছোট ছিলেন শেখ আবু নাসের। তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের যে অটুট ও মধুর সম্পর্ক আমৃত্য ছিল তা পৃথিবীতে বিরল।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভয়াল কালো রাতে মানব ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকান্ডের শিকার হয়ে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভাবী বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব, ভ্রাতুষ্পুত্র স্নেহের শেখ কামাল, স্নেহের শেখ জামাল, সবার আদরের স্নেহের শিশু রাসেল, ভ্রাতুষ্পুত্র শেখ কামালের নব পরিনতা স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকু, ভ্রাতুষ্পুত্র শেখ জামালের নব পরিনতা স্ত্রী পারভীন জামাল রোজী সহ নির্মম ভাবে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে শাহাদৎ বরণ করেন শহীদ শেখ আবু নাসের।

১৫ই আগস্ট বাঙালি জাতির নিরন্তর রক্তক্ষরনের আরও একটি নাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ আবু নাসের। ১৯৭৫ সালের এই দিনে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবনে ঘটে যাওয়া পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ডের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী মহিতুল ইসলাম সরকারী কাজে ঝিনাইদহ সার্কিট হাউসে রাত্রি যাপন করলে আমরা ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের তরুন কর্মীরা তার মুখে ১৫ই আগস্টের বিয়োগদান্তক ঘটনার বিবরণ শুনে ছিলাম এবং আমি লিপিবদ্ধ করেছিলাম। সেখান থেকে নির্মমভাবে শেখ আবু নাসেরকে হত্যার কিছু অংশ তুলে ধরলাম। “ঘাতক মেজর নুর, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) ও ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা বঙ্গবন্ধু ও শেখ কামালকে হত্যা করে নিচে নেমে এসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এর পরপরই মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন তাদের সৈন্য সহ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসে। আজিজ পাশা তার সৈন্যদের নিয়ে দোতলায় চলে যায়। তারা বঙ্গবন্ধুর ঘরের দরজা ধাক্কা দিতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা দরজায় গুলি করে। তখন বেগম মুজিব দরজা খুলে দেয় এবং ঘরের মধ্যে যারা আছে তাদের না মারার জন্য অনুরোধ করেন। ঘাতকরা বেগম মুজিব, শেখ আবু নাসের, শেখ রাসেল ও রমাকে নিয়ে নিচে আসতে থাকে। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেই বেগম মুজিব কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘আমি যাবনা, আমাকে এখানেই মেরে ফেলো।’ বেগম মুজিব নিচে নামতে অস্বীকৃতি জানান। ঘাতকরা শেখ আবু নাসের, শেখ রাসেল ও রমাকে নিচে নিয়ে যায়। তাদের সবাইকে লাইনে দাড় করানো হয়। এসময় শেখ আবু নাসের ঘাতকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমিতো রাজনীতি করি না। কোন রকম ব্যবসা-বানিজ্য করে খাই। এসময় ঘাতকেরা শেখ আবু নাসেরকে বলে, ‘ঠিক আছে, আপনাকে কিছু বলব না। আপনি ওই ঘরে গিয়ে বসেন।’ এই বলে তাকে অফিসের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমে নিয়ে গুলি করে। এরপর শেখ আবু নাসের ‘পানি, পানি’ বলে গোঙাতে থাকেন। তখন শেখ নাসেরের উপর ঘাতকেরা আবারও গুলি বর্ষন করেন। এভাবে ঘাতকেরা পৃথিবীর সমস্ত বর্বরতাকে হার মানিয়ে বাঙালীর হাজার হাজার বছরের আরোধ্য পুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার ¯েœহের ছোট ভাই শেখ আবু নাসের সহ ১৫ই আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে অবস্থান কারি বঙ্গবন্ধু পরিবারের সকল সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ম শেখ হাসিনা তার ছোট বোন শেখ রেহেনাকে নিয়ে বিদেশে স্বামী পরমানু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়ার নিকট অবস্থান করার কারনে প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে টুঙ্গিপাড়া থেকে শেখ পরিবারের অনেকেই পূর্ব বাংলার দক্ষিনাঞ্চলীয় শিল্প ও বানিজ্য নগরী খুলনায় চলে আসেন। খুলনার খালিশপুর ও দৌলতপুরের জুট মিল গুলো তখন বিশ্বখ্যাত সোনালী আঁশ তথা পাট রপ্তানীর প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। পাটের সোনালী বন্দর উপমহাদেশে খুলনা সুপরিচিত ছিল। তাই ব্যবসা বানিজ্যের উপযুক্ত কেন্দ্র মনে করেই এখানে শেখ পরিবারের সদস্যদের আগমন ঘটে। সেই থেকে শেখ আবু নাসেরও খুলনায় গমন করে শিপিং বিজনেস শুরু করে খুলনায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ট ভ্রাতা শেখ আবু নাসেরের স্ত্রীর নাম রিজিয়া বেগম ডলি। শেখ আবু নাসের ও রিজিয়া বেগম ডলির সাত সন্তান। শেখ তাহমিনা খবির মিনা, শেখ হেলাল উদ্দিন, শেখ সালাউদ্দিন জুয়েল, শেখ ফারহানা শামস্ চৌধুরী লুনা, শেখ সোহেল, শেখ জালাল উদ্দিন রুবেল ও শেখ বেলাল হোসেন বাবু। শেখ আবু নাসের ও রিজিয়া বেগম ডলি দম্পতি সপরিবারে খুলনাতে বসবাসের কারনে তাদের বেশ কয়েকজন সন্তান এখানে জন্ম গ্রহণ করেন। শেখ আবু নাসেরের সন্তানেরা শৈশব ও কৈশোর কাল কাটিয়ে খুলনাতে বেড়ে ওঠে। শেখ পরিবারের অনেক স্মৃতি বিজড়িত খুলনা শহর। বাঙালী জাতিকে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে বারবার জেল যেতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার একমাত্র ভাই হিসেবে শেখ আবু নাসের তার পরিবারের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে বিন্দুমাত্র অবহেলা করতেন না।

শোষিত বঞ্চিত বাঙালী জাতির সেবায় আত্মাৎসর্গের প্রেরণা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিবার সব সময় তাকে সমর্থন ও উৎসাহ যুগিয়েছেন। সে সম্পর্কে শেখ আবু নাসেরের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ হেলাল উদ্দিন এমপি ‘বঙ্গবন্ধু গবেষণা ফাউন্ডেশন’র শেখ ওয়াদিজুমান আল ওয়াহিদ সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ’ গ্রন্থের ১ম খন্ডের ‘বঙ্গবন্ধু ও আমার পিতা: একটি গুরুত্ব পূর্ণ মূল্যায়ন’ নামক লেখনির ১৬১-১৬২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “ম্যাক্সিম গোর্কির বিশ্ববিখ্যাত ‘মা’ উপন্যাসে সন্তানের মানবতাবাদী সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে মা যেমন তার পক্ষে পতাকা বহন করে বিপ্লবীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বাস্তবিক পক্ষে ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর পিতা-মাতা ও স্ত্রী-ভ্রাতা নেপথ্যে তাঁকে এ মহান আত্মত্যাগের সংগ্রামে সব সময় পাশে থেকে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে তাকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। যার ফলে বঙ্গবন্ধু পাকিস্থানী দুঃশাসকদের জেল-জরিমানা নিপিড়নের কাছে কখনও মাথা নত করেননি, পরিবার পরিজনদের কথা চিন্তা করে কোন দূর্বলতা বা আপোষের মনোভাব দেখান নি। বরং গোটা বাঙালী জাতির পক্ষে একাই হাসি মুখে জেল-জুলুম সহ সব নিপিড়ন এমনকি মৃত্যুবরনেও সব সময় প্রস্তুত ছিলেন তিনি। পিতা-মাতার পাশাপাশি স্ত্রী বেগম ফজিলাতুননেছা ওরফে রেনু যেমন তাঁকে সব সময় সান্তনা দিয়ে পরিবারের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে আশ্বস্ত করতেন তেমনি আমার পিতা বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের তাঁর পরিবারের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে বিন্দু মাত্র অবহেলা করতেন না।” এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার “অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ২২১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “আমি এই সমস্ত জেলায়ও ঘুরে প্রতিষ্ঠানকে জোরদার করতে চেষ্টা করলাম। আগস্ট মাসের শেষের দিকে বরিশাল হয়ে বাড়ি যেতে হল, টাকা পয়সার খুব অভাব হয়ে পড়েছে। কিছুদিন বাড়িতে থাকলাম, তারপর ঢাকায় ফিরে এলাম আমার কিছু একটা করা দরকার। ছেলে মেয়ে হয়েছে, এভাবে কতদিন চলবে। রেনু কিছুই বলে না, নীরবে কষ্ট সহ্য করে চলেছে। আমি বাড়ি গেলেই কিছু টাকা পয়সা লাগবে তাই জোগাড় করার চেষ্টায় থাকত। শেষ পর্যন্ত আব্বা আমাকে টাকা দিলেন, খুব বেশি টাকা দিতে পারেন নাই, তবে আমার চলবার মত টাকা দিতে কোনদিন আপত্তি করেন নাই। আমার নিজের বেশি কোনো খরচ ছিল না; একমাত্র সিগারেটই বাজে খরচ বলা যেতে পারে। আমার ছোট ভাই নাসের ব্যবসা শুরু করেছে খুলনায়। সে আমার ছেলে মেয়েদের দেখাশোনা করে। বাড়ি থেকে তার কোন টাকা পয়সা নিতে হয় না। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে কিছু টাকা বাড়িতে দিতেও শুরু করেছে।” বঙ্গবন্ধুর এহেন লেখা থেকে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধুর পিতা-মাতা ও স্ত্রী-ভ্রাতা এই চার ব্যক্তির অবদান বঙ্গবন্ধুকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হতে কতখানী সহায়তা করেছে।

বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ আবু নাসেরের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ হেলাল উদ্দীন ১৯৯৬ সাল থেকে ৭ম, ৮ম, নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছেন। তার মেজো ছেলে শেখ সালাউদ্দিন জুয়েল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। শেখ আবু নাসেরের জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ হেলাল উদ্দিন এমপি. মহোদয়ের পুত্র শেখ সাহারান নাসের তন্ময় একাদশ সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। শেখ আবু নাসেরের তৃতীয় পুত্র শেখ সোহেল বাংলাদেশ আওয়ামী যুব লীগের প্রেসিডিয়ামের সদস্য, চতুর্থ ছেলে শেখ জালাল উদ্দিন রুবেল ও কনিষ্ঠ পুত্র শেখ বেলাল হোসেন বাবু পারিবারিক ও পৈত্রিক ব্যবসার সাথে জড়িত।

‘বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ’ গ্রন্থের ১৬২ পৃষ্ঠায় শেখ হেলাল উদ্দিন এমপি. মহোদয় আরও লিখেছেন, “আমরা ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি ও জেনেছি বঙ্গবন্ধু নিজের ব্যক্তিগত কোন কারনে বা তাঁর পরিবার পরিজনের কারনে কখনই কোন জেল-জরিমানার শিকার হননি। জীবনে যতবার জেল খেটেছেন, কষ্ট নির্যাতন-নিপিড়ন সহ্য করেছেন তা গোটা বাঙালী জাতির ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে শোষিত-নির্যাতিত বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত করার জন্যই তার জীবনের যৌবন কালের অধিকাংশ সময়ই কারাগারের লৌহ কপাটের অন্ধকারে বন্দী থেকেছেন। তাঁর মত এত নির্যাতন, নিপীড়ন ও জেল-জুলুমের শিকার পৃথিবীতে খুব কম রাজনীতিবিদকে হতে হয়েছে। এ বিষয়ে বলা যায় বঙ্গবন্ধুর তুলনা পৃথিবীতে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই, আর কেউ নন। আমার পিতা আমাকে যতখানি স্নেহ-মমতা দিয়েছেন আমার চাচা বঙ্গবন্ধুও আমাকে খুব স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। তাই তো তাঁর আদর্শ ও চেতনার পথ অনুসরণ করেই তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তেই বাংলাদেশের আপামর বাঙালির সেবা করতে তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে শেখ পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে পদার্পন। শৈশব থেকে আজও তাই নানাভাবে নানা মাধ্যমে দেশ ও জনগনের কল্যাণে প্রকাশ্যে ও নির্ভৃতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য নতুন প্রজন্মকে তাদের গন্তব্য নির্ধারণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অটল বিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে যেতে প্রাণীত করবে বলে তাদের প্রতি আমাদের ঐকান্তিক প্রত্যাশা।”

লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ।

পাঠকের মতামত:

২৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test