E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ঘোড়া ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে সম্রাট হুমায়ূন, হিন্দুস্থানি বর্বরতা দর্শন! 

২০২১ আগস্ট ৩১ ১৩:২১:৩৫
ঘোড়া ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে সম্রাট হুমায়ূন, হিন্দুস্থানি বর্বরতা দর্শন! 

চৌধুরী আবদুল হান্নান


সম্রাট তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী জওহর আবতাবচিকে বললেন, “ আমি ছদ্মবেশে কিছুক্ষণের জন্যে শহর ঘুরতে বের হবো। হযরত ওমর রাজিআল্লাহতালা আনহু এই কাজ করতেন। উনি রাতে বের হতেন । রাতে তেমন কিছু দেখা যাবে না, আমি দিনের আলোয় ছদ্মবেশে বের হবো, সম্রাট হিসেবে নয়, যেন একজন সাধারণ নাগরিক । তুমি আমাকে ঘোড়া ব্যবসায়ীর মতো সাজিয়ে দাও ।” জী, আলামপানা ।

পাশাপাশি দু’টি ঘোড়া চলছে, একটিতে সম্রাট হুমায়ূন অন্যটিতে জওহর আবতাবচি। দূর থেকে তাদের অনুসরণ করছে সম্রাটের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বাহিনী। তেমন প্রয়োজনে নিমিশের মধ্যে ছুটে এসে তারা সম্রাটকে ঘিরে ফেলবে, সম্রাটের নিরাপত্তাজনিত কোনো সমস্যা নেই। শহর শান্ত, দোকান পাট খুলছে।শহরের কেন্দ্রে হরিসংকীর্তন হচ্ছে, সেখানে ছেলে বুড়ো ভিড় করছে। সম্রাট কিছুক্ষণ কীর্তন শুনলেন। পথে একজন নাগা সন্ন্যাসীকে দেখা গেল, গায়ে ছাই মেখে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্হায় ঘুরছে। তাকে ঘিরে একদল ছেলেমেয়ে।নাগা সন্ন্যাসীর সাধনদন্ডে কাঁসার একটি ঘন্টা ঝুলিয়ে দিয়েছে, যখন সে হাঁটছে ঘন্টায় ঢং ঢং শব্দ হচ্ছে। সম্রাট : আপনি নগ্ন ঘুরছেন কেন ? সন্ন্যাসী : আমি নাগা সন্ন্যাসী, সব কিছু বিসর্জন দিয়েছি বলেই নগ্ন। সম্রাট : আপনি তো লজ্জাও বিসর্জন দিয়েছেন। সন্ন্যাসী : আমাকে নিয়ে তুই মাথা ঘামাচ্ছিস কী জন্যে ? তুই ঘোড়া বেচতে এসেছিস, ঘোড়া বিক্রি কর। পুন্য কামাতে চাইলে আমাকে সেবা কর । তোর জ্ঞান কম, তুই অবুঝ ।

সম্রাট তাকে দশটা তাম্রমুদ্রা দিয়ে শহরের বাইরে চলে গেলেন। নদীর পাড় ঘেঁসে ঘেঁসে যাচ্ছেন। তাঁর অদ্ভুত লাগছে, মধুর বাতাস। একটি তালগাছ বাঁকা হয়ে নদীর দিকে ঝুঁকে আছে। একদল শিশু তালগাছে উঠে সাবধানে মাথা পর্যন্ত যাচ্ছে, সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে নদীতে পড়ছে, তাদের কী আনন্দ ! সম্রাট বললেন, দেখো জওহর, ওদের কী আনন্দ ! সম্রাটের পুত্র-কন্যারা এই আনন্দ থেকে বন্চিত। কিছুদূর এগুবার পর দু’জনই থমকে দাঁড়ালো। সামনে নল খাগড়ায় ঢাকা শ্মশানঘাট। বৃষ্টির সময় আশ্রয় নেয়ার জন্য চারদিক খোলা ঘর। ঘরভর্তি নানান বয়সী নারী, তারা কলকল করে কথা বলছে। চারদিকে লোকে লোকারণ্য, ঢোল বজছে, কাঁসার ঘন্টা বাজছে।কিছুক্ষণ পর পর সবাই মিলে গগনবিদারী চিৎকার— সতী মাই কি জয় ! চারজন পুরোহিত আসন করে বসে আছে, মন্ত্রপাঠ চলছে। পুরোহিতদের দক্ষিণ দিকে নদীর কাছাকাছি ডোমরা বসেছে কলসভর্তি চোলাই মদ নিয়ে, তাদের চোখ রক্তবর্ণ। সম্রাট বিস্মিত হয়ে বললেন, কী হচ্ছে ? : সতীদাহ হবে আলামপানাহ্। মৃত স্বামীর সঙ্গে তার জীবিত স্ত্রীকে চিতায় পোড়ানো হবে। এই সেই সতীদাহ, আমি সতীদাহের কথা শুনেছি, আগে কখনো দেখিনি।

এটা দেখার জিনিস নয়, হিন্দুস্হানি বর্বরতা ! : যে মেয়েটিকে পুড়িয়ে মারা হবে তার সঙ্গে কি কথা বলা যাবে ? : আলামপানাহ্ । সে কথা বলার মতো অবস্হায় এখন থাকবে না, সবাই তাকে ঘিরে আছে । তাকে নিশ্চয়ই নেশা জাতীয় কিছু খাওয়ানো হয়েছে, সে এখন নেশাগ্রস্ত। : একদল মানুষ দেখছি লাঠিসোটা নিয় দাঁড়িয়ে, এরা কারা ? : সব সময় দেখা গেছে আগুন জালানোমাত্র সতী দৌড় দিয়ে চিতা থেকে পালাতে চায় , তখন লাঠী দিয়ে পিটিয়ে তাকে চিতায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং আগুনের উপর মেয়েটিকে চেপে ধরে রাখা হয়, নরকের বর্বরতা ! : আমি এই মুহূর্তে ফরমান জারি করে সতীদাহ বন্ধ করতে চাই। : আলামপানাহ্। গুস্তাকি মাফ, আপনার সমস্ত প্রজা হিন্দু। আপনি ওদের ধর্মীয় কর্মকান্ডে বাধা দিলে তারা বৈরী হয়ে উঠবে ; আপনার শাসন কার্য পরিচালনা দুষ্কর হবে। : আমি মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে চাই। : ঘোড়ার ব্যবসায়ী হিসেবে তারা আপনার সঙ্গে মেয়েটিকে কথা বলতে দেবে না। : তাদের তুমি বলো আমি মোঘল সম্রাট হুমায়ূন এবং আমার রক্ষীবাহিনীকে কাছে এগিয়ে আসতে বলো ।

চিতায় ঘিয়ের আগুন জ্বলে উঠেছে। সেখানে প্রায় ৭০ বছর বয়সী এক চুলপাকা বৃদ্ধের শবদেহ।তার চুলে আগুন ধরতেই নিমিশে সব চুল জ্বলে গেল, আগুন ভালো মতো জ্বলে উঠলে সতী স্বেচ্ছায় হেঁটে হেঁটে চিতায় উঠবে।তাকে ভাং এর শরবত খাওয়ানো হয়েছে , তার চিন্তা শক্তি কাজ করছে না।ঢোলের বাদ্য আকাশ স্পর্শ করছে, শ্মশান ঘরের তরুণীরা একে একে আসছে। সতী মেয়েটির কপালে সিঁদুর দিচ্ছে, সেই সিঁদুর নিজের কপালে ঘষছে এবং উপুর হয়ে সতীর পায়ে পড়ে তাকে প্রণাম করছে। বিশ্বাস—এই সতী নারীর অছিলায় তারাও একদিন ঘট ঘট করে সিড়ি বেয়ে স্বর্গে চলে যাবে। বাজনাদাররা পাগলের মতো নাচছে, হঠাৎ বাদ্যবাজনা থামলো। সম্রাট হুমায়ূন এগিয়ে এলেন, তাঁর ঘোড়া থামলো সতীদাহের মেয়েটির সামনে। ১২/১৩ বছর বয়সী একটি মেয়ে, পরণে লাল পেড়ে শাড়ি, গা-ভর্তি অলংকার, কী সুন্দর সরল মুখ, বড় বড় চোখ ! ভয়ে আতঙ্কে সে থর থর করে কাঁপছে। মেয়েটির সঙ্গে কোথায় যেন সম্রাটের কন্যা আকিকা বেগমের মিল আছে। : তোমার না কী ? নাম বলো । : অম্বা ! : তোমার স্বামী মারা গেছে, সে এখন চিতায় পুড়ে কয়লা হবে। তুমি তো বেঁচে আছ, তুমি কেন মরবে ? অম্বার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে।

সে ক্ষীণস্বরে বললো, আমি মরতে চাই না, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। সম্রাট ঘোড়া থেকে নামলেন, অম্বার কাছে এগিয়ে গেলেন। গলা নিচু করে বললেন, আমি নিজের হাতে পানি খেতে দেব , তুমি বিসমিল্লাহ বলে সেই পানি খাবে।মনে থাকবে ? অম্বা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো, সে খানিকটা হকচকিয়ে গেছে। মেয়েটির আত্মীয় স্বজন এবং জড়ো হওয়া লোকজন এগিয়ে আসতে চাচ্ছে কিন্ত সম্রাটের রক্ষীবাহিনীর কারণ আসতে পারছে না। তাদের মধ্যেও এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। হুমায়ূন তাদের দিকে তাকিয়ে গলা উঁচু করে বললেন, অম্বা নামের এই মেয়েটি এই মাত্র আমার হাতে বিসমিল্লাহ বলে পানি খেয়েছে। বিধর্মীর হাতে পানি খাওয়ার কারণে তার জাত গেছে। বিসমিল্লাহ বলায় মেয়েটি মুসলমান হয়ে গেছে। আমার আইনে কোনো মুসলমান মেয়েকে সতী হিসেবে দাহ করা যাবে না। সম্রাট হুমায়ূন অম্বাকে নিয়ে শিবিরের দিকে রওয়ানা হলেন।মাতাল ডোমের দল লাঠিসোটা নিয়ে পিছন পিছন ছুটলো। তাদের সঙ্গে পুরোহিতের দল, বাজনাদারদের দল, মহিলাদের দল। “সতী” কন্যাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে— এ হতে দেয়া যায় না। সম্রাটের নির্দেশে তীরন্দাজরা তীর ছুঁড়লো, অব্যর্থ তীরের আঘাতে ৪ জন পুরোহিতের ৩ জনই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। হতভম্ব দল উল্টোদিকে দৌড়াতে শুরু করলো। স্বর্গপ্রাপ্তির ধর্মীয় অন্ধ-বিশ্বাসে জীবন্ত মানুষ আগুনে পুড়িয়ে মারার বর্বর সতীদাহ প্রথা আইনে নিষিদ্ধ করতে তারপরও প্রায় তিন শত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।

ইতোমধ্যে কত শত সহস্র বিধবা নারীর জীবন আগুনে দগ্ধ হয়েছে সে হিসাব কেউ রাখে না । তথ্য-সূত্র : নানা নাটকীয় সব ঘটনায় পূর্ণ সম্রাট হুমায়ূনকে নিয়ে নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ রচিত উপন্যাস “ বাদশাহ নামদার “ থেকে মূল তথ্য সংগৃহীত ।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।

পাঠকের মতামত:

২৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test