E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ধর্মান্ধতা একটা বিভীষিকাময় অপদর্শন

২০২১ অক্টোবর ১৪ ১১:৫৪:৫৯
ধর্মান্ধতা একটা বিভীষিকাময় অপদর্শন

আবীর আহাদ


ধর্মান্ধতার জিগির তুলে মহাভারতের বিভক্তি ঘটেছে। ধর্মের অপব্যাখ্যার কারণে একই ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়েও মধ্যপ্রাচ্যে প্রচুর রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মান্ধতার কারণে বিশেষ করে খৃস্টান ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে নানান পরস্পরবিরোধী উপদল সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মান্ধতার জঙ্গিত্বের ওপর সওয়ার হয়ে তালেবান, আলকায়দা ও ইরাক-সিরিয়া ইসলামিক স্টেট (ISIS)সহ বহু ছোটো ছোটো জঙ্গি সংগঠন গড়ে উঠেছে। ধর্মান্ধতার বিষবাষ্পে ভাসছে পাকিস্তান ভারত ও বাংলাদেশ!

যুগে যুগে কালে কালে... বর্তমানেও এই ধর্মান্ধতার জঙ্গিত্বের করালগ্রাসে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ নিহত-আহত হয়েছে ও হচ্ছে ! ধর্ষণ ও বলৎকারের শিকার হয়েছে। লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে ও হচ্ছে। সহায়-সম্পদ হারিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশ-দেশান্তিত হয়েছে এবং হচ্ছে।

ধর্মান্ধতাও একটা দর্শন। এই দর্শনের বিষবাষ্পে সেই আদি থেকে অদ্যাবধি পৃথিবীতে যে রক্তপাত হিংসা সন্ত্রাস ও রেষারেষি সৃষ্টি হয়েছে, অন্য কোনো দর্শনে এ-ধরনের পৈশাচিক ও বীভৎস ক্রিয়াকলাপ তেমন দেখা যায় না। তাই এটাকে বিভীষিকাময় অপদর্শন বলাই শ্রেয়। এ অপদর্শনের চেতনা এতোটাই মারাতক যে, এর প্রভাবে এক মানুষ অন্য মানুষের ওপর জবরদস্তিমূলক তার চিন্তাভাবনা ও ধ্যানধারণা চাপিয়ে দেয়। অন্য মানুষেরও যে নিজস্ব বিশ্বাস ও চেতনা আছে তা সে গণ্য করে না। নিজের ধর্ম বা আদর্শকে শ্রেষ্ঠতম জ্ঞান করে অন্যর ধর্ম ও আদর্শকে টুটি চেপে হত্যা করতে চায়। এখানে পরমত সহিষ্ণুতা ও অপরের চিন্তা চেতনার মূল্যায়ন করা হয় না। এমনতর একপেশে অমানবিক ডগমাটিক মনোবৃত্তির কারণে মানুষ নৃশংস খুনী ও বর্বর নিপীড়করূপে আবির্ভূত হয়ে পড়ে।

মানুষে মানুষে, সমাজে সমাজে, দেশে দেশ, পৃথিবীর সর্বত্র শান্তি সৌহার্দ্য সম্প্রীতি মানবতা ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ধর্মান্ধতাই মূল বাধা। ধর্মান্ধতা একটা দানব। একটি অভিশাপ। মনে রাখতে হবে, ধর্মের জন্যে মানুষ নয়... মানুষের জন্যে ধর্ম। কে ধর্ম পালন করবে, কে করবে না... এটা ব্যক্তিমানুষের ইচ্ছে। জোর করে কোনো ধর্ম কারো ওপর চাপিয়ে দেয়ার কোনো অধিকার কারো নেই।

আমাদের এ পৃথিবীর বয়স পাঁচ কোটি বছর বলে বিজ্ঞান মতপ্রকাশ করেছে। মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে আনুমানিক ত্রিশ লক্ষ বছর পূর্বে। এর মধ্যে উনত্রিশ লক্ষ নব্বই হাজার বছর ছিলো ধর্মহীন তথা আদিম সাম্যবাদী সমাজ। আর আজ থেকে আট/দশ হাজার বছর পূর্ব থেকে সভ্যতা ও ধর্মীয় সমাজের গোড়াপত্তন ঘটে। আগের উনত্রিশ লক্ষ নব্বই হাজার বছরের মধ্যে সমাজে ব্যক্তিসত্তা ব্যক্তিস্বার্থ ও ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে তেমন কিছুই ছিলো না। মানুষ প্রাকৃতিক নানান দুর্যোগ, মহামারী ও ভয়ংকর জন্তুদানব থেকে নিজেদের অস্তিত্ব নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বা বড়ো বড়ো গোত্রে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে সমষ্টিগত স্বার্থে নিজেদের পরিচালিত করতো। খাদ্য অন্বেষণ ও বাঁচার তাগিদে একসঙ্গে আহার-বিহার, চলাফেরা, শিকার প্রভৃতি কর্মকাণ্ড করতো। সবাই সমভাবে একসঙ্গে আহারকার্য সমাপ্ত করতো। তখনো পর্যন্ত সমাজে বাড়তি সম্পদের অবকাশ ছিলো না।

কালক্রমে সমাজ যখন কিছুটা অনুকূলে আসে, আগুন ও নানান হাতিয়ার আবিষ্কার ও তার ব্যবহার শেখে এবং সমাজে বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদনের পরিবেশ সহজতর হতে থাকে, বাড়তি খাদ্যদ্রব্য ও সম্পদের অবকাশ সৃষ্টি হয়... তখনি এ সমাজের মধ্যকার শক্তিশালী ও ধুর্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সমাজের বাড়তি সম্পদকে ব্যক্তিসম্পদে ভোগদখলের মানসপ্রবৃতির উদ্ভব ঘটে। এভাবেই পর্যায়ক্রমে ব্যক্তিসত্তা ব্যক্তিস্বার্থ ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিসম্পদের লোভ-লালসার যূপকাষ্ঠে আদিম সাম্যবাদী সমাজের বুকে ধস নেমে আসে।

এরই ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে বিশেষ করে ব্যক্তিসম্পদকে ভোগদখল ও সামাজিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজের অগ্রসরমান শক্তিশালী ও জ্ঞানী লোকজনের চিন্তাচেতনায় তাদের পক্ষে একটা ঐশ্বরিক ধাণা দাঁড় করতে থাকে। সমাজের ব্যাপক মানুষ যাতে ক্ষুদ্র এ মানবগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে না পারে সেজন্য তারা একটি অদৃশ্য শক্তির প্রভাবকে নানান টোটেমে তথা মূর্তিতে এনে মানুষের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত যে তার এখতিয়ারে, সমাজে ধনী-দরিদ্র তাঁর সৃষ্টি, তার সন্তুষ্টি আদায় করার লক্ষ্যে, এসবের পশ্চাতে এক মহাপরাক্রমশালী মহাজাগ্রত 'ঈশ্বর'কে এনে দাঁড় করিয়ে নানান পূজাপার্বণ আচার অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির প্রচলন ঘটায়। আর এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সমাজের ব্যাপক অশিক্ষিত অজ্ঞ মানুষকে সেই অদৃশ্য শক্তির মনোরঞ্জনে লিপ্ত রাখার লক্ষ্যে কিছু শ্লক, কিছু গল্প, কিছু নীতিকথার আড়ালে নানান কলাকৌশল, নিয়মনীতি প্রচলন করে প্রচ্ছন্নভাবে একটা অতীন্দ্রিয় চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটায়, যার মধ্য দিয়ে কালক্রমে মানবসমাজের বুকে ধর্মের সূত্রপাত ঘটে। এককথায় বলা যায়, ধর্ম হলো ধনবাদী ধুরন্ধর শাসক-শোষক সমাজের ইহজাগতিক সুখ ও সমৃদ্ধি গড়ার হাতিয়ার, অপরদিকে সমাজের ব্যাপক অজ্ঞ দুর্বল দরিদ্র মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের পারলৌলিক শান্তির সান্ত্বনা!

সমাজ বিবর্তনের একটি স্তরে এসে বিভিন্ন ভাষাভিত্তিক নামের নানান ঈশ্বর ও দেবদেবীর আগমন ঘটানো হয়। সভ্যতার একটি চরম স্তরে এসে শ্রমজীবী ব্যাপক সাধারণ মানুষকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত ও শোষক-প্রতারক সমাজের শাসন শোষণ ও প্রভাবপ্রতিপত্তি বজায় রাখার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে দেশে সমাজে সমাজে শাসক-শোষক ও ধর্মীয় পরজীবীগোষ্ঠী ধর্মকে একটি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে যা এখন সর্বত্র একটি নেশা ও পেশা হিশেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ নেশা ও পেশার স্বার্থ ব্যক্তি ও সম্প্রদায়গত ক্ষেত্রে একীভূত হয়েই কালক্রমে ধর্ম ব্যবহারিকতায় ধর্মান্ধতায় পর্যবসিত হয়ে পড়েছে। আর এই ধর্মান্ধতার কবলে পড়ে সামাজিক রাষ্ট্রিক ও বৈষয়িক শান্তি সম্প্রীতি সৌহার্দ্য ও সমৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংঘটিত হয়ে চলেছে হিংসা দ্বন্দ্ব রক্তপাত ও জীবন সংহারের পৈশাচিক ক্রিয়াকলাপ। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে মুসলমান সম্প্রদায় হামলে পড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর, অপরদিকে ভারতের হিন্দু সম্প্রদায় হামলে পড়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর। আর এসব সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার মধ্যে যতোটা না ধর্মীয় চেতনা কাজ করে, তার চে বহুগুণে কাজ করে জায়গাজমি ও অর্থসম্পত্তি দখলের চেতনা!

আসুন, আমরা ধর্মান্ধতা তথা সাম্প্রদায়িকতাকে বর্জন করি। ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধজাত মানবিক সমাজ গড়ে তুলি।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test