E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সুব্রামনিয়মের বাংলাদেশকে দখলে নেয়ার হুমকির পরিবেশ কারা সৃষ্টি করেছে?

২০২১ অক্টোবর ২০ ১৪:৫৩:১০
সুব্রামনিয়মের বাংলাদেশকে দখলে নেয়ার হুমকির পরিবেশ কারা সৃষ্টি করেছে?

আবীর আহাদ


সম্প্রতি দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লার একটা পূজামণ্ডপে কোরআন রাখাকে কেন্দ্র করে মুসলমান নামধারী বর্বর ধর্মান্ধ অপশক্তি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দুদের ওপর হত্যা, ধর্ষণ, পূজামণ্ডপ জ্বালিয়ে দেয়া, ঘরবাড়ি লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাকার যেসব নৃশংস পৈশাচিক ও অমানবিক অত্যাচার করেছে তা কোনোক্রমেই মেনে নেয়া যায় না। পূজামণ্ডপে কোরআন রাখার দু:সাহস নিশ্চয়ই কোনো হিন্দু দেখায়নি। কোরআন ও ইসলাম নিয়ে যারা ব্যবসা করে বা যাদের কোনো দেশপ্রেম নেই, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি, তাদের কাছে আল্লাহ্ মুহম্মদ (দ:) ইসলাম ও কোরআন কোনো বিষয় নয়, তারা তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ধ্বংস করে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে যেকোনো অপকর্ম নির্দ্বিধায় করতে পারে। এজন্য তাদের কেউ হিন্দুদের পূজামণ্ডপে কোরআন রেখে মুসলমানদের সস্তা ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে দেশের বুকে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করে হিন্দু বিতাড়নের যে কুপরিকল্পনা এঁটে ঐসব জঘন্যতম অপকর্ম সংঘটিত করেছে, তাদের চিহ্নিত করে এমন দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে আগামী হাজার বছরের মধ্যে এধরনের হীন কার্যকলাপ কারো মনে উদয় না হয়। কিন্তু আমরা বিস্মিত হচ্ছি, সরকারের বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে অতীতের গতানুগতিকতার মতো গাছাড়া ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে! অতীতে নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জ, রামুসহ বিভিন্ন স্থানে যেসব সহিংস সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছিলো, সেসবের যথাযথ বিচার হতো তাহলে এধরনের ঘটনাবলী পুনরায় ঘটতো না। একটা কথা আমাদের বুঝে আসে না যে, দেশে বর্তমানে একমাত্র রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকলেও তাদের কর্মকাণ্ড তেমন দৃশ্যমান নয়। বিশেষ করে বিএনপি জামায়াত শিবির হেফাজত ফ্রিডমপার্টি প্রভৃতি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির মাঠ পর্যায়ের অনেকেই আওয়ামী লীগ নেতাদের বিপুল অর্থ উপঢৌকন দিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে স্থান করে নিয়েছে। হিন্দুদের পূজামণ্ডপ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হত্যা ও অন্যান্য অত্যাচারযজ্ঞ পরিচালনা করার সময় শত শত হাজার হাজার টুপিওয়ালাদের দেখা গেলো, তারা কারা? বিএনপি জামায়াত হেফাজতের ঐসব এলাকায় তেমন সাংগঠনিক অবস্থান আছে বলে মনে হয় না। তাহলে আবারো প্রশ্ন আসে, অত টুপিওয়ালা ওরা কারা? দেশের সর্বত্র আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিশাল অবকাঠামো থাকা অবস্থায় কারা জোট বেঁধে ঐসব ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটালো? এ প্রশ্ন উঠতেই থাকবে।

বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর এহেন বর্বর হামলার প্রতিক্রিয়ায় গোটা ভারতের হিন্দুরা প্রবল প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী হিন্দুদের ওপর মুসলমান নামধারী দুর্বৃত্তদের আক্রমণের মধ্যে দূর্গাপূজা উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে এক মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথা প্রসঙ্গে সংগতকারণে ভারতে যাতে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখার জন্যে ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যকে ভারতের অনেকেই ভালো দৃষ্টিতে দেখছেন না। তারা এটাকে তাদের দেশের প্রতি শেখ হাসিনার একধরনের হুমকির গন্ধ আবিষ্কার করে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন বলে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রকাশ।

বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার ও সে প্রেক্ষিতে ভারতবাসীর তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ায় ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির অন্যতম প্রধান ও প্রভাবশালী মন্ত্রী শ্রী সুব্রামনিয়ম স্বামী বাংলাদেশের প্রতি চরম এক হুমকি দিয়ে বসেছেন। তিনি হিন্দুদের ওপর হামলা বন্ধ করার জন্যে বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি বা অনুরোধ জানাতে পারতেন। সেটা হতো একটা স্বাধীন দেশ হিশেবে অপর একটা স্বাধীন দেশের প্রতি একটা শিষ্টাচারি আহ্বান। তা না করে তিনি যে ভাষায় বাংলাদেশকে দখলে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন, সেটা চরম শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্য যা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা-জনগণকে হতবাক ও ক্ষুব্ধ করেছে। পাশাপাশি এটাও আমাদের মনে হয়েছে যে, পাগলে কী না বলে! এর আগেও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ কয়েকবার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানান হুমকি-ধামকি দিয়ে বলেছেন, আসাম থেকে তথাকথিত বাংলাদেশি এককোটি লোককে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত ভারতকে ছেড়ে দিতে হবে। আরো কতো আবদার! ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রক্তের বন্ধু। বঙ্গবন্ধু ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সে বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ চিরদিনের জন্যে নির্মাণ করে দিয়ে গেছেন। সে বন্ধুত্বে কেউ ফাটল ধরাতে পারবে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তার অকৃপণ অবদানকে আমরা চিরকাল শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো। তবে স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। ফলে কোথাকার কোন সুব্রামনিয়ম ও অমিত শাহ কী বললো, তাতে আমরা বিস্মিত হলেও আমলে নিচ্ছি না। শুধু সুব্রামনিয়ম ও অমিত শাহ নন, বিশ্বের যেকোনো কাউকে আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই যে, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে পদানত করতে পারে, এমন শক্তি বিশ্বের কেউ রাখে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নির্জাস "জয়বাংলা-জয়বঙ্গবন্ধু"তে উজ্জীবিত হয়ে কোটি কোটি বাঙালি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যে প্রাণ বিসর্জন দিতে কোনো দ্বিধা করবে না। তবে এটাও সত্য এদেশের তথাকথিত ইসলামী বা ধর্মান্ধ মোল্লা সমাজকে এ কাজে পাওয়া যাবে না। তারা রাজাকারই থেকে যাবে। আমরা বাঙালি। আমরা মুক্তিযুদ্ধবিজয়ী জাতি। বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শৌর্য বীর্য ত্যাগ ও বীরত্বের যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন তা আমাদের মিত্রবাহিনী ভারতীয় সেনাধ্যক্ষবৃন্দ যেমন ফিল্ডমার্শাল ম্যানেক শাঁ, জেনারেল অরোরা ও জেনারেল জ্যাকব প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। শুধু তাই নয়, এ প্রবাদ বাক্যও এ উপমহাদেশের বুকে প্রচলিত রয়েছে যে, বাঙালিরা যা আজ ভাবে, সমগ্র ভারত ভাবে আগামীকাল! তবে আমরা কারো হুমকির মুখে পাল্টা হুমকি দিচ্ছি না। আমরা আমাদের দেশপ্রেম ও শৌর্যের কথা বলছি মাত্র।

তবে হ্যাঁ। আমরা শ্রী সুব্রামনিয়মের এধরনের হুমকি কী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হলো, এর অনুসন্ধান দাবি করছি আমাদের সরকারের কাছে। সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও দ্রব্যমূল্যের সিণ্ডিকেটীয় তাণ্ডবের ফলশ্রুতিতে সংঘটিতব্য গণবিস্ফোরণের পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে গা বাঁচানোর লক্ষ্যে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাঁধানোর ক্ষমতাসীন সরকারের মহলবিশেষের কুমিল্লা নাটক কিনা, অথবা সরকারের অভ্যন্তরে কোনো গোষ্ঠীর অপরাজনীতির ফায়দা লুটার কারসাজি কিনা, অথবা স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ বিএনপি জামায়াত হেফাজত জঙ্গিদের সাম্প্রদায়িকতাকে উষ্কে দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার কিনা, অথবা তালেবানি চেতনাকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে একদিকে বাংলাদেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগানো, অন্যদিকে দেশের মধ্যে গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করে সেই অজুহাতে বাংলাদেশের ওপর বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ডেকে আনার কোনো পাকি-চৈনিক চক্রান্ত কিনা তা সরকারকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যেকোনো কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোটি কোটি বাঙালির প্রাণের দেশ নিয়ে যদি কেউ কোনো ডার্টিগেম খেলতে চান, তাহলে দেশের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার সাথে নিজের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বল এখন শেখ হাসিনা সরকারের কোর্টে। কীভাবে তিনি খেলবেন সেটা তাঁর বিষয়। তবে তিনি যে টিম নিয়ে দেশ চালাচ্ছেন, তাদের নিয়ে তিনি কতোদূর এগোতে পারবেন, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ তাঁকে ছাড়া সবাইকে অর্থ দিয়ে কেনা যায়, ভয় দিয়ে বশ করা যায়।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test