E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সর্বনাশের গহ্বর থেকে দেশকে উদ্ধার করা জরুরি

২০২১ অক্টোবর ২৯ ১৪:৪১:৪১
সর্বনাশের গহ্বর থেকে দেশকে উদ্ধার করা জরুরি

আবীর আহাদ


এ-কথা আজ নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, দেশের চালিকাশক্তি ‘রাজনীতি’ এখন আর রাজনীতিকদের কবলে নেই। প্রকৃত রাজনীতি না থাকার ফলে অর্থ আত্মীয়তা ও নিজ কোটারী স্বার্থে দলের নি:স্বার্থ ত্যাগী, মেধাবী, সৎ, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দু’পায়ে মাড়িয়ে রাজাকার, পাকিপ্রেমী, জামায়াতী, হেফাজতী, বিএনপি, শিবির, ছাত্রদলসহ সমাজবিরোধী দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের জামাই আদরে দল ও সরকারে ঠাঁই দেয়ার পরিণতি কী ভয়াবহ হতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ আজকে আমরা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছি! বিশেষ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখন আর আওয়ামী লীগের হাতে নেই।

চারদিকে আজ দুর্নীতি ও লুটপাট। সভ্যতা ও ভব্যতার দলন। নৈতিকতা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিকৃতি। মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক মূল্যবোধে চরম অবক্ষয়। অসুন্দর নষ্টামি ভণ্ডামি ও নষ্টাচার-ভ্রষ্টাচারের হোলিখেলা ইত্যাকার অশুভ কর্মযজ্ঞের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত বাংলাদেশ হাবুডুবু খাচ্ছে। সর্বত্র কেঁচো খুঁড়তে বড়ো বড়ো বিষধর সাপ বেরুচ্ছে। কালো টাকার প্রভাবে মাদক ও ব্যভিচারের করাল গ্রাসে বাঙালি সমাজ ডুবে যাচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সরকারি কেনাকাটার অন্তরালে চলছে শতসহস্র কোটি টাকা লুটপাট। ব্যাংক ও পুঁজিবাজারে চলছে সাগর চুরি! হুণ্ডিসহ নানান উপায়ে দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের কোণঠাসা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী লোকদের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনকে রাজাকার চেতনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের বঞ্চিত করে প্রকারান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবজ্ঞা করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দিয়ে রীতিমতো মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানিত করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না বিএনপি-জামায়াতের পথ অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে ভুয়া সংজ্ঞা সৃষ্টি করে হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য বীর্য ত্যাগ ও বীরত্বকে অপমানিত করা হচ্ছে। স্বাধীনতার সূর্যসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সিংহভাগ চরমতম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিনাতিপাত করে চলেছেন। ক্ষুধা দারিদ্র্য হতাশা ও চিকিৎসার অভাবে রোগেশোকে ধুকে ধুকে প্রতিদিন অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরপারে পাড়ি জমাচ্ছেন।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিকে পাশ কাটিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি হেফাজতে ইসলামকে মাথায় তোলা হয়েছে, ফলে তারা শক্তি সঞ্চয় করে হেফাজতের তেঁতুল হুজুর নামক দামড়া আহমদ শফিকে দেশের রাষ্ট্রপতি করার দাবী পর্যন্ত করে বসেছিলো! এই রাজাকার আহমদ শফির অনুসারীরা আল্লাহর এখতিয়ারটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে যাকে-তাকে কাফের, বিধর্মী, মুরতাদ ও নাস্তিক ঘোষণা করে চলেছেন। এমনকি ধর্মীয় অঙ্গনে অত্যন্ত নিরীহ একটি সম্প্রদায় আহমদীয়া বা কাদিয়ানীদের কাফের ও অমুসলমান ঘোষণা করার জন্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে ধমক দিয়েছে! মূলত: স্বাধীনতাবিরোধী হেফাজত দেশে ধর্মীয় উন্মাদনায় দেশের মধ্যে একটি অরাজকতা সৃষ্টি করে হানাহানি ও রক্তপাত ঘটিয়ে আমাদের বহু কষ্টার্জিত বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চায়। তারা ইরান ও আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশে ইসলামের নামে ‘রাজাকার বিপ্লব’ ঘটাতে তৎপর। তবে তাদের অন্যতম দিকপাল মামুনুল হকের অপকর্মের কারণে ইদানিং একটু কোণঠাসা হয়ে পড়লেও ভেতরে ভেতরে তারা তাদের তরবারি শান দিচ্ছে! অপরদিকে প্রশাসনের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলারা নিচের শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে হেফাজতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক লেখনী সরিয়ে সাম্প্রদায়িক লেখনী সংযোজন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে-দেশটি স্বাধীনতা লাভ করেছে, যে দেশের সর্বস্তরের প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রবাহিত করা হবে—–তা না করে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিটি ইউনিয়ন ও উপজেলায় নানান কিংভূতকিমাকার নামের মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ধরনের ইসলামী ইন্সটিটিউট তৈরির অন্তরালে রাজাকার ও জঙ্গি সৃষ্টির বীজ বপন করা হচ্ছে! এসব মসজিদ মাদ্রাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে সেগুলোকে কুফরি মতবাদ আখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষের মনোজগতে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি অনুপ্রবেশ করানো হচ্ছে।

কমিশন ও ঘুষ খেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাঙ্ক, বীমা, ঠিকাদারী মিডিয়াসহ সর্বত্রই বিএনপি-জামায়াত তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী লোকদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে বিভিন্ন সিণ্ডিকেটের হাতে তুলে দিয়ে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিসহ যন্ত্রণার মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এভাবে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গুটিকতক দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের আশা-আকাঙ্খাকে পদদলিত করা হয়েছে। আর তার বিষফল স্বরূপ দেশে কেসিনো সম্রাট, ব্যাংকিং দরবেশ, করোনা কীট সাহেদসহ বিশাল বিশাল মাফিয়া গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে যারা লুটপাটের পাশাপাশি খুন, ব্যভিচার, প্রতারণা ও দখলীয় অপকর্ম করে চলেছে! তাদের নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে কমিশন বাণিজ্যের লালসায় তাদেরকে যাবতীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে! এভাবে দেশটি এখন সর্বনাশের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে।

এতকিছুর পরেও দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষ বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিশেবে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর পরম আস্থা স্থাপন করে মুখ গুঁজে বসে আছে। তারা এও আশা করেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব থেকে মুক্তি দিতে জননেত্রী শেখ হাসিনার বিকল্প কোনো শক্তি নেই। বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও আদর্শের উত্তরাধিকারসহ সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ব্যক্তিগত সততা প্রজ্ঞা মেধা ও দূরদর্শিতা দিয়ে দেশকে সত্যিকারে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় পরিচালিত করতে পারেন। যদিও জননেত্রীর একটি কথা দু:খজনকভাবে প্রায়ই আমাদের কানে ভাসে যে, তাঁকে ছাড়া আওয়ামী লীগের সবাইকে কেনা যায়। তাঁর একথার প্রতিবাদ করতে একজনও আওয়ামী নেতা-কর্মীকে দেখা গেলো না, যদিও তাঁর দলের বাইরে দেশের সব সেক্টরে এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের প্রচুর সৎ মেধাবী ও ত্যাগী মানুষ আছেন যাদেরকে দুর্নীতি ও লুটতন্ত্র মোটেই স্পর্শ করতে পারেনি, যাদের খবর শেখ হাসিনা হয়তো জানেনই না। আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধুর কন্যা এবং একজন সৎ সাহসী প্রজ্ঞাবান নেতা হিশেবে শেখ হাসিনা যদি সেসব সৎ মেধাবী ও ত্যাগী মানুষদের খুঁজে তাঁর দল ও সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে অবস্থান দেন তাহলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ জাগ্রত হয়ে কাঙ্ক্ষিত পথে ধাবিত হবেই। কিন্তু শেখ হাসিনার একটি দুর্বলতম দিক এই যে, তিনি এতো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হয়েও কা’দের দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিতে হবে কাকে এমপি, উপদেষ্টা ও মন্ত্রী করতে হবে কা’দেরকে দল ও দেশের স্বার্থে দূরে রাখতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে তিনি সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারছেন বলে মনে হয় না! বিশেষ করে দুর্নীতি ও লুটপাটের সাথে জড়িত মাস্টারমাইণ্ড তথা গডফাদারদের নাম প্রকাশ হওয়ার পরও তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ত্যাগী, সৎ, মেধাবী ও দেশপ্রেমিক লোকদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও তিনি সজাগ নন বলে মনে হয়।

সুতরাং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে অতীতের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের হাতে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি লুটপাট ও মাফিয়াতন্ত্রের যে সর্বনাশা উত্থান ঘটেছে, সেসব আবর্জনা কঠোর হস্তে পরিষ্কার করে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সৎ, ত্যাগী ও মেধাবী লোকগুলোকে সাথে নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনাই দেশকে রক্ষা করতে পারেন বলে এখনো দেশবাসীর বিশ্বাস ও আস্থা তাঁর ওপর রয়েছে। সহসাই যদি তিনি দেশকে চলমান সর্বনাশের গহ্বর থেকে উদ্ধারের কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন, তাহলে সহসাই দেশ অন্ধকারে তলিয়ে যাবে, যেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া সত্যিই দুরূহ হবে।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

১২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test