E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বাংলাদেশ কোন পথে? সতর্কতা জরুরি

২০২১ নভেম্বর ১৫ ১৪:৫৬:১০
বাংলাদেশ কোন পথে? সতর্কতা জরুরি

রণেশ মৈত্র


বাংলাদেশ তার মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে। আমরা যারা ভাষা আন্দোলন, অপরাপর গণতান্ত্রিক আন্দোলন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছি ও সংগঠিত করেছি এবং আজও বেঁচে আছি তাঁদের জন্য এই সুবর্ণ জয়ন্তী অত্যন্ত গৌরবের। যে কোটি কোটি বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিলেও, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন, দেশের বা পৃথিবীর নানা দেশে অবস্থান করা সত্বেও উদারহস্তে সহযোগিতা করেছেন-তাঁরাও নিজ নিজ সাধ্য শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী সীমাহীন গর্ব ও উদ্দীপনার সাথে বছরটি উদযাপন করছেন। পঞ্চাশতম বছরটি দেখে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ায় তাঁরা বিশেষভাবে আনন্দিত।

করোনা অবশ্য এখনও পৃথিবীর মানুষের পিছু ছাড়ে নি। এক বছরের ও বেশী সময় পেরিয়ে গেলেও সমগ্র ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও দূর প্রাচ্যের কতিপয় দেশে তার তা-ব আজও বেড়েই চলেছে। সে সব দেশগুলিতে করোনা ভাইরাস আবার নতুন নতুন ভাইরাসের জন্ম দিয়ে এক ভীতিকর পরিবেশ গড়ে তুলেছে। অপরপক্ষে বাংলাদেশ, ভারত, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে করোনার প্রকোপ ক্রমশ কমে আসায় এই এবং ব্যাপক হারে ভ্যাকসিন দেওয়ায় অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেলা যাচ্ছে। তবু নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বেগ হওযার সময় এখনও আসে নি। পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হতে আরও তিন থেকে ছয় মাস সময় লেগে যেতে পারে যদি নতুন কোন উপদ্রবের সৃষ্টি না হয়।

বাংলাদেশে করোনা কমছে তা-ই নয়-ভ্যাকসিন নিতে মানুষ ব্যাপক হারে এগিয়ে আসছেন বলে আশাবাদেরও সৃষ্টি হয়েছে। তবে ইউরোপের, মধ্যপ্রাচ্যের এবং দূর প্রাচ্যের দেশগুলিতে বিমান চলাচল কিছুকালের জন্য স্থগিত রাখার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার।

এই মুহুর্তে তবুও করোনা ভাইরাস ইউরোপের দেশগুলির মত বিপজ্জনক কিছু নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে একের পর ঘটে যাওয়া বহু ঘটনাই মানুষের মনে নানা সংশয়, সন্দেহ, উদ্বেগ ও আশংকার সৃষ্টি করে চলেছে।

সর্বশেষ কাতার সরকার পরিচালিত আন্তর্জাতিক টেলিভিশন চ্যানেল আর জাজিরায় প্রকাশিত “অল আর প্রাইম মিনিষ্টার মেন” শীর্ষক দীর্ঘ ‘অনুসন্ধানী’ প্রতিবেদন প্রচার করায় দেশে-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের কোন টিভি চ্যানেলে বা কোন পত্রিকায় ঐ প্রতিবেদন প্রকাশ না পাওয়ায় এবং তার বিরুদ্ধে পরিচালিত একতরফা প্রতিবাদও সমালোচনা প্রকাশ করায় অনেক গুজব সৃষ্টির সুযোগ হয়েছে।

নানা জায়গা টুকরা টুকরা যেটুকু প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে বুঝা যায়, আল জাজিরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ও সেনাবাহিনী প্রধানের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কাহিনী প্রচার করেছে। কিন্তু ভাল হতো যদি সকল পত্রিকায় অবিকল পূর্ণ প্রতিবেদনটি প্রকাশ হতো এবং সংক্ষুব্ধ সকলে প্রতিবেদনটির নানা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ খ-নের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রতিবাদ দফাওয়ারীভাবে জনগণকে জানাতেন সেটি সর্বোত্তম হতো।

যা হোক, বাংলাদেশে নিত্যদিন ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীও উদ্বেগ সৃষ্টি করে চলেছে মানুষের মনে। সরকারি দলে ন্যূনতম সাংগঠনিক শৃংখলা না থাকা, প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও দলটির নানা গ্রুপের মধ্যে ঘটে যাওয়া সংঘাত, অস্ত্রবাজি কোন দলের উচ্চ মহলের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না-সেটা এক বিস্ময় এবং মারাত্মকভাবে হতাশা ব্যঞ্জক।

এই ঘটনাবলী দেশের মানুষকে একদিকে রাজনীতি বিমুখ করে তুলছে অপরদিকে যুব তরুণ সমাজের মধ্যে সন্ত্রাসী প্রবণতা বৃদ্ধি করছে। বিদ্যমান দুই গ্রুপ, একই দরে নামে, পরস্পরের প্রতি গুলি নিক্ষেপ করছে, একে অপরকে হত্যা করছে, খবর সংগ্রহের ও ঘটনার ছবি তোলার মত পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিরীহ সাংবাদিক নিহত হচ্ছেন, আরও অনেকের প্রাণ যাচ্ছে, অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন-এসবই এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবহ।
চারিদিকে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের নামে ব্যাপক দুর্নীতি, ব্যাংক লুঠপাট, বিদেশে টাকা পাচার নির্বাচনগুলিতে জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ার নামে ধনিক-বণিক ব্যবসায়ীদেরকে মনোনয়ন দিয়ে দলের মধ্যে যেমন কলহের সৃষ্টি করা হচ্ছে-তেমনই আবার রাজনীতি থেকে রাজনীতিকদেরকে হটিয়ে দিয়ে ব্যবসায়ীদেরকে কৃত্রিমভাবে রাজনীতিক সাজানো হচ্ছে।

এ চিত্র সংসদের দিকে তাকালে, সিটি কর্পোরেশনগুলিতে জেল পরিষদগুলিতে, পৌরসভাগুলিতে এবং ইউনিয়ন পরিষদগুলিতে মনোনয়ন দেওয়া প্রার্থীদের তালিকা ঘাঁটলে এবং সে তথ্য প্রকাশ করলে সব কিছু স্পষ্ট হবে। আর অরাজনীতিক অর্থগৃন্ধু বিত্তশালীরা মনোনয়ন পেলে নির্বাচন ব্যবস্থাকেও তারা একটি পণ্য মনে করে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে অপরিহার্য্য নির্বাচন ব্যবস্থাকেও তারা দূষিত করে এবং ইতোমধ্যে করে ফেলেছেন।

আর এ জাতীয় অরাজনীতিকরা অবশ্যম্ভাবীরূপে স্তাবকতায় লিপ্ত থেকে দলীয় নেতৃত্বকে, সরকারকে প্রকৃত তথ্য জানার সুযোগও বন্ধ করে দিয়ে নেতৃত্বকে কখনও কখনও ভুল সিন্ধান্ত গ্রহণের দিকে ঠেলে দেয়। পরিণতিতে কি রাষ্ট্র, কি সরকার, কি দল, কি জনগণ-সবাই অপরিসীম ক্ষতির শিকার হলেও তা অন্ধকারের আড়ালে থেকে যায়।

টেণ্ডারবাজী, চাঁদাবাজি, দখলবাজির মাধ্যমে ঐ জাতীয় অ-রাজনীতিকরা নিজেদের তহবিল অবৈধভাবে স্ফীত করে, জনগণের সাথে তাদের সম্পর্ক আরও দূরবর্তী করে তোলে। ফলে দল এবং সরকার হয়ে পড়ে চূড়ান্তভাবে জনবিচ্ছিন্ন, জন সমর্থনহীন। এই কোকিলেরা কিন্তু দল বা সরকারের বিপদের মুহুর্তে ঠিকই সটকে পড়ে বিপদের অংশীদার যাতে না হতে হয়।

আলজাজিরার প্রতিবেদনের মূল লক্ষ্য ছিলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে আঘাত করা। এই ঘটনার প্রতিবাদে দেশের মাত্র দু’চারটি জায়গায় সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনগুলি মানবন্ধনের আয়োজন করলেও, সাধারণ মানুষ কোথাও তাতে সম্পৃক্ত হন নি। এতেও উপব্ধি করা যায়, স্তাবকেরা তাদের দল ও সরকারকে কতটা জনবিচ্ছিন্ন ইতোমধ্যেই করে তুলেছে।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে তা প্রশ্নাতীত। কিন্তু সেই উন্নয়নের ছোঁয়া যে পঁচানব্বই ভাগ মানুষের ঘরে না পৌঁছে মাত্র পাঁচভাগ বা তারও অনেক কম মানুষের সমৃদ্ধি ঘটাচ্ছে তা ততোধিক সত্য। এর পরিণতিতেও ক্ষোভ বাড়ছে।

যুব সমাজকে আজ আর অন্যায়ের প্রতিবাদে অতীতের মত রুখে দাঁড়াতে দেখা যায় না-তারাও সরকার দলের হয়ে ভাগ বাঁটোয়ারায় প্রলুব্ধ হচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের কোন জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয় না-শাস্তি তো দূরের কথা। তাই যুব সমাজের ব্যাপক অংশ রাজনীতিতে, আন্দোলনে নিস্পৃহ।

এসবই নানা অঘটন ঘটানোর জন্যে অত্যন্ত অনুকূল। তাই সময় থাকতে এই অব্যবস্থাগুলি দূর করা এবং সতর্ক হওয়ার বিকল্প নেই। সর্বাগ্রে অ-রাজনীতি স্তাবকদের হাত থেকে মুক্ত হতে হবে রাষ্ট্র, সরকার ও দেশের স্বার্থেই। দেশের সবচাইতে মারাত্মক শত্রু জামায়াত ও হেফাজতও ওৎ পেতে আছে সুযোগ পেলেই ছোবল মারতে তারা আদৌ দ্বিধা করবে না।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test