E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মেধাবীরাই বদলাবে রাজনীতি

২০২১ নভেম্বর ২৯ ১০:৪৬:০১
মেধাবীরাই বদলাবে রাজনীতি








 

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান

এ কথা অস্বীকার করার অবকাশ নেই, বর্তমানে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, অর্থের দাপট, সম্পদের জৌলুস, ক্ষমতার অপব্যবহার, অযোগ্যদের উত্থান অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতিতে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্য, সুন্দরের মতো অনুষঙ্গ একান্তভাবে জরুরি। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্য, সততা আবশ্যকীয় উপাদান হলেও কেবল সততাই রাজনীতিতে সবকিছু নির্ধারণ করে না। রাজনীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি আমাদের রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সম্পর্কে সমাজ তথা জনগণের মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গি অনেকাংশেই নেতিবাচক। সঞ্চিত অভিজ্ঞতার আলোকে জনগণ ধরেই নিয়েছে, রাজনীতিবিদের অনেকেই খারাপ মানুষ।

তাদের ভাষায়, রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেকেই বাটপার, ধাপ্পাবাজ এবং ধান্ধাবাজ লোক। ব্যক্তি স্বার্থেই লোকরা রাজনীতিতে আসছে এবং রাজনীতি করছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এ ধারণাই সমাজে সুদৃঢ় হচ্ছে। যদিও বর্তমানে রাজনীতিতে ভালো মানুষ যে একেবারেই কম, তা কিন্তু নয়। কিন্তু খারাপ মানুষের দাপটে সাধারণ মানুষের চোখে ভালোর মূল্যায়ন নেই। রাজনীতি সম্পর্কে পুরো সমাজের ধারণা যদি এমন হয়, তাহলে ভাবতে হবে ভবিষ্যতে আমাদের জন্য আরও নেতিবাচক কিছু অপেক্ষা করছে। অর্থাৎ রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে সমগ্র জাতির ধারণা যদি এমন হয়, তাহলে এ থেকে উত্তরণের উপায় কী? এ ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকলে রাজনীতিতে ভালো মানুষের প্রবেশদ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে এবং ভালো মানুষও রাজনীতিতে আগ্রহ হারাবেন। এ জন্য জরুরি দরকার রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন সাধন করা।

যেভাবেই হোক রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনতেই হবে। এ জন্য রাজনীতিতে মেধাবী লোকদের বিকল্প নেই। কেননা রাজনীতিবিদরাই সমাজের নানা সমস্যা চিহ্নিত করবেন এবং সেগুলোর সুষ্ঠু সমাধান করার জন্য নেতৃত্ব দেবেন। মানুষকে সঠিক পথ দেখাবেন এবং দিকনির্দেশনা দেবেন। কাজেই সেই রাজনীতিবিদদের অবশ্যই সৎ ও মেধাবী হতে হবে। সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে সারা দেশে আন্দোলন আমরা লক্ষ করেছি। আমি মনে করি, আমাদের রাজনীতিতে অতি দ্রুত মেধা কোটা চালু করা দরকার।

কেননা যারা লেখাপড়ায় দুর্বল, কোনোমতে তৃতীয় শ্রেণিতে পাস করেছে, শিক্ষা জীবনে তেমন কোনো অর্জন নেই, তারা কীভাবে রাজনীতি করবেন? এমন ব্যক্তি সমাজের মানুষের সমস্যা কীভাবে চিহ্নিত করে সেগুলো সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে সমাধান দেখাবেন? এ কারণে আমি মনে করি, রাজনীতিতে সততার চেয়ে মেধার গুরুত্ব কম নয়। এ লক্ষ্যে রাজনীতিতে মেধাবীদের টেনে আনার গুরুত্ব অপরিসীম। এক সময় বামধারার রাজনৈতিক দলগুলো যেমন কমিউনিস্ট পার্টিতে অনেক মেধাবীদের উপস্থিতি ছিল। আগে রাজনীতিতে যে সংখ্যক মেধাবী লোক ছিলেন, এখন তেমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। নেপথ্যে কারণ একটিই, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন। বর্তমানে সমাজের মানুষ সামাজিকভাবে রাজনীতিবিদদের, সম্মানের চেয়ে ভয় বেশি করে। সে ভয়ের কারণ, তাদের কাছে টাকাপয়সা ও ক্ষমতা আছে। অনেকে আবার রাজনীতিবিদদের কাছে অনেক কিছু প্রত্যাশা করে।

জনগণ হয়তো কিছু একটা পাওয়ার জন্যই রাজনীতিবিদদের সম্মান করে। সাধারণ মানুষ রাজনীতিবিদদের সম্মান করছে না এই জন্য যে, সমাজের সমস্যা সমাধানের প্রাথমিক যোগ্যতা রাজনীতিবিদদের অনেকেরই নেই। তাদের পড়াশোনার যোগ্যতা যথেষ্ট থাকে না এবং একজন রাজনীতিবিদের যে প্রজ্ঞা, জ্ঞান, বুদ্ধি, নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, মেধা, ধৈর্য, মনোবলসহ অন্য গুণাবলী থাকা দরকার এমন গুণাবলী অনেক রাজনীতিবিদদের নেই। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর এমন গুণাবলী সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না। অথচ রাজনীতিই একটি রাষ্ট্রের হৃৎপিণ্ড। রাজনীতিবিদরা সমাজের সব সমস্যার সমাধান করবেন। ষাট এবং সত্তর দশকে রাজনীতিতে কত তাত্ত্বিক বিষয়ে আলোচনা হতো। সে সময় আমাদের সামনে বিভিন্ন মতামত, মতবাদ, দর্শন, চিন্তা তথা আইডিয়োলজি ছিল এবং এগুলোর চর্চা হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মার্কসবাদ, লেনিনবাদ, পুঁজিবাদসহ অনেক কিছু নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনায় ব্যস্ত থাকত। শিক্ষার্থীরা জার্নাল, পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বইসহ নানা প্রকাশনা বের করত। বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠী সংস্কৃতি চর্চা করত। কিন্তু বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সেসব প্রবণতা আর নেই। এখন কেবল ‘এগিয়ে চল, এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে’, এসব নিয়ে ব্যস্ত। এ প্রবণতা কেবল শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, একেবারে সমাজের তৃণমূল পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়ছে।

এখন নির্বাচন করতে প্রচুর টাকা লাগে। নেতারা নির্বাচন করবেন এবং তার জন্য সবাই একসঙ্গে নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করবে, এমনটি সেকেলে ধারণা। বর্তমানে কর্মীরা টাকা ছাড়া সহজ কোনো কাজ করে না। প্রত্যেকটি পোস্টার সাঁটানোর জন্য গুনেগুনে টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ একশটি পোস্টার সাঁটানোর জন্য ২০ টাকা হারে দুই হাজার টাকা গুনে কর্মীর হাতে দিতে হবে, নতুবা পোস্টার ছুড়ে ফেলে চলে যাবে। এটাই বাস্তবতা। আগে মানুষ নিজ ইচ্ছায় জনসভায় জমায়েত হতো। রেসকোর্স ময়দান পরিপূর্ণ হতো। কিন্তু এখন মানুষ ব্যস্ত। ট্রাকযোগে মানুষকে সভা সমাবেশস্থলে নিতে হয়। অনেকে আবার ট্রাকেও উঠতে চান না। আগে বস্তিতে জনপ্রতি একশ করে টাকা দিলেই মানুষ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন ৫০০ টাকার কমে কাউকে পাওয়া যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ জনসভা করার জন্য স্থান পাওয়া যায় না।

আমি মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য পুরো রেসকোর্স ময়দান উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক, তারা যত লোক নিয়ে আসতে পারে আনুক। রাজনীতিতে আসলে সেই দিন এখন আর নেই। মানুষ এখন নিজ কাজে ব্যস্ত। দুর্ভাবনার বিষয় রাজনীতিতে অর্থবিত্ত সম্পন্ন লোকদের উপস্থিতি ব্যাপক হারে লক্ষণীয়। এর কারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন।
ষাট সত্তর দশকে রাজনীতিতে যে গুণাবলী এবং মানের লোক ছিলেন, এখন তা নেই। বিশ্ব রাজনীতিরও একই অবস্থা। এমন অবস্থা কেবল রাজনীতিতে নয়। বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনের দিকে তাকালেও একই অবস্থা লক্ষ্যণীয়। আগে যে মানের সৃষ্টিকর্মের জন্য কবি, সাহিত্যিক, লেখকদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হতো, এখন আর সেই মান নেই।

এখন যে শ্রেণির সাহিত্যিকদের নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হচ্ছে, তাদের তুলনায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অন্তত ৫ বার নোবেল পুরস্কার দিতে হবে। কাজেই এ দৈন্যতা কেবল রাজনীতিতে নয়, সর্বক্ষেত্রে। কাজেই যারা রাজনীতি করেন, তাদের প্রতি মানুষের সম্মানবোধ ফেরাতে হবে।

রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে মানুষের মাঝে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তা করতে না পারলে রাজনীতিতে ভালো মানুষকেও জনগণ সন্দেহের চোখে দেখবে। যতই ভালো লোকই হোক না কেন, মানুষ ভাববে হয়তো কোনো ধান্ধা আছে। কারণ, ধান্ধা ছাড়া রাজনীতিতে মানুষ আর কিছু দেখে না। আমরা যত কথা বলি না কেন, সমাজের সমস্যা সমাধান করে একটি দেশ, জাতি এবং রাষ্ট্রকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে অগ্রগতির সোপানে উপনীত করার জন্য রাজনীতি এবং রাজনীতিক ছাড়া আর কোনো শক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। কেবল রাজনৈতিক শক্তি পারে সঠিক পথ দেখাতে। এ লক্ষ্যে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনতেই হবে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

পাঠকের মতামত:

১৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test