E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ওমিক্রন, যাত্রীভাড়া ও বাংলাদেশ

২০২১ ডিসেম্বর ১১ ১৪:৩৩:৪৫
ওমিক্রন, যাত্রীভাড়া ও বাংলাদেশ

রণেশ মৈত্র


বাংলাদেশের এই মুহুর্তের প্রধান খবর সাধারণ ছাত্র সমাজ পরিচালিত সড়ক অবরোধ, লাল কার্ড দেখানো, প্রতীকী লাশ নিয়ে মিছিল। দাবী মূলত: দুটি। এক. ঢাকায় ও সর্বত্র সড়ক পরিবহনে ছাত্রদের ভাড়া হতে হবে হাফ বা অর্ধেক। এবং তা সর্বক্ষণিক সরকারি ঘোষণামত সকাল ৮টা থেকে রাত ৮ টা পর্য্যন্ত নয়।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, এই প্রথমবারের মত ওই মিছিলে অংশ নিয়ে সংহতি জানালেন। বার অর্থ তিনিও ঐ দাবীগুলি যথার্থ বলে মনে করেন-যেমন মনে করে থাকেন দেশবাসী-দলমত নির্বিশেষে। কিন্তু পরক্ষণেই মন্ত্রী মহোদয় বলে উঠছেন সাধারণ সমাজের আন্দোলন নিয়ে বিশেষ একটি দল রাজনীতি করছে।

এই বাংলাদেশী অভিনব স্টাইল অবশ্য বাংলাদেশীর কাছে আদৌ পরিচিতি নয়। এখন এক কথা-পরবর্তী মুহুর্তেই বিপরীত কথা শুনতে সকলেই আমরা অভ্যস্ত।

“বিশেষ একটি দল” বলতে যে তাঁরা বি এন পিকে বুঝাতে চাইছেন-এদেশের হামেশা দলটির নাম ধরে মন্ত্রীপর্য্যায় থেকে প্রতিদিনই কোন একটি উক্তি করা।

শুরু করেছি এই মুহুর্তের সর্বাধিক আলোচিত এবং সকল মহলে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাধারণ ছাত্র সমাজের অর্ধেক ভাড়ায় চলাচলের দাবী নিয়ে। সেই আলোচনা করতে নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের ছাত্রসমাজের মিছিলে আকস্মিক অংশগ্রহণ যার তাৎপর্য্য দাবীগুলির প্রতি সংহতি জ্ঞাপন। তাহলে সরকার সমর্থন জানালে দাবীগুলি যথার্থ বলে বিবেচিত হবে আর বিএনপি বা কোন বিরোধীদল তা সমর্থন করলে সরকার ‘ষড়যন্ত্রের ঘ্রাণ খুঁজে পাবেন এ কেমন কথা?”

আসলে আমরা সহজ বিষয়কে জটিল করতে পছন্দ করি। মন্ত্রী যথন (অঘোষিতভাবে হলেও) আন্দোলনকারীদের মিছিলে গেলেন-তাদের আন্দোলনের সাথে সংহতি জানালেন-তখন সরকারিভাবে দাবী মানায় ঘোষণা দিলেই তো মিটে যেত? ছাত্রদেরও পরদিন প্রতীকী লাশ কাঁধে নিয়ে রাপথে ঘুরতে হতো না-বিষয়টি আন্তর্জাতিক খবরে পরিণত হওয়ার সুযোগও পেত না। দিব্যি সকলে শান্তির সাথে ঘরে ফিরে যেতে পারতেন।

ওমিক্রেন

গোটা পৃথিবী হঠাৎ করেই আবার নতুন সংকায় শংকিত। বিষয়টি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত, আফ্রিকার বেশীরভাগ দেশে প্রসারিত-সেখান থেকে ইউরোপের কতিপয় দেশে রোগটির ছুটে যাওয়া, আমেরিকা, লঙ্ঘন ও ভারতের তার কয়েকটি রোগীর সন্ধান পাওয়া এক গভীর শংকাবোধ সৃষ্টি করেছে পৃথিবীব্যাপী। আরও শংকার বিষয় হলো হলো-রোগটির প্রতিরোধক বা প্রতিষেধক কোন ওষুধ আজও আবিষ্কার হয় নি। অবশ্য এত দ্রুত আবিস্কার হওয়ার কথাও না। তবে আশার কথা বিখ্যাত ওষুধ প্রস্তুতকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান “মডার্না” ইতোমধ্যেই ওমিক্রন নিয়ে গবেষণা সুরু করেছে এবং শীঘ্রই আবিস্কার-পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তা বাজারজাত করতে সক্ষম হবে বলে জানিয়েছে।

আমরা সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের। এই খবরটি আনন্দের হলেও তাতে আস্বাস্ত হতে পারি না। কারণ অভিজ্ঞতায় দেখেছি করোনার টিকা পৃথিবীর বহু দেশে আবিস্কৃত হতে যথেষ্ট সময় লেগেছিল এবং বাংলাদেশ পর্য্যন্ত ঐ ভ্যাকসিন এসে পৌঁছাতে যথেষ্ট সময় লেগেছিল। ততদিনে রোগটির দৈনন্দিন ব্যাপক বিস্তার ও প্রতিদিন বহুসংখ্যক রোগীর মৃত্যু ঘটে গিয়েছিল। অবশ্য এ কথাও ঠিক, বেশ কিছু দেশে পৌঁছানোর আগেই আমরা কিছু সংখ্যক করে ভ্যাকসিন নানা দেশ থেকে পেতে পেরেছিলাম। ফলে দেশে করোনার উন্নতিও ঘটেছে এবং এই ২০ মাসে একদিন “কোন মৃত্যু ঘটে নি” এমন সুখবর আমরা পেয়েছি। ব্যস, ঐ একদিনই। তারপর থেকে আবার শুরু। তবে আক্রান্তের এবং মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমেছে। বেশ কিছুদিন যাবত মৃতের সংখ্যা ১০ এর নীচে রয়েছে আক্রান্তের সংখ্যাও হাজার-এমন কি, পাঁচ সতেরও নীচে রয়েছে।

ফলে নিশ্চিন্তে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যায়গুলি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর চালু করা হলো। তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মচারীদের দৃপ্ত তবে সংশয়ী পদচারণায় ক্যাম্পাসগুলি মুখরিত হলো।

এমন কি পাবলিক পরীক্ষাগুলি নেওয়াও সুরু হলো। অফিস আদালত, হাট-বাজার, বিপণী বিতান সব খুলে গেল এবং স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সর্বত্র মানুষ চলাচও সুরু হলো।

এমন একটা উন্নয়নমূলক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলিও আর ঘরোয়ায় বা অনলাইন সভা-সমিতিতে আটকে থেকে সভা-সমিতি, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলিও জুম অনুষ্ঠান, টিভি চ্যানেলগুলিও ক্রমশ: জুম অনুষ্ঠান-টক শোর পরিবর্তে সীমিতভাবে প্রকাশ্য অনুষ্ঠান, লাইভ অনুষ্ঠান, সভা-সমিতি প্রভৃতি শুরু করায় পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। অশান্ত পরিস্থিতি, সন্ত্রাসী পরিস্থিতিতে হলেও শত শত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে সুরু করলো। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ঢাকায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচও অনুষ্ঠিত হলো-যদিও দর্শক স্বল্পতা ছিল ষ্টেডিয়ামে লক্ষ্যণীয়।

এরই মুখে এল ওমিক্রমন। এই রোগের লক্ষণাদির সাথে করোনার যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আপাতত: এর প্রতিষেধক হিসেবে করোনার ডবল ডোজ ভ্যাকসিন কোন কোন বিশেষ এমনও ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে করোনা ভ্যাকসিনের বুষ্টার ডোজ ডোজ দেওয়া প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি বলেছে, ধনী লোকদের বুষ্টার ডোজ না দিয় গরীবদের দ্রুত সর্বত্র টিকা দেওয়া হোক।

এই কথাটির উপর জোর দিতে চাই। কারণ সমস্ত গরীব লোককে ডবল ডোজ টিকা দূরে থাক-সিঙ্গল ডোজ দেওয়া হয়েছে কিনা জনগণকে তা আজও জানান হয় নি। কোন দেশ থেকে টিকা অনুদান বা আমদানীর ভিত্তিতে এলে তা যদিও প্রকাশ করা হয় কিন্তু এ যাবত মোট কত ডোজ ভ্যাকসিন বাংলাদেশে এসেছে কতজনকে সিঙ্গল ডোজ আর কতজনকেই বা ডবল ডোজ দেওয়া হয়েছে-যাদের দেওয়া হয়েছে তাদের বয়স ৬০ এর নীচের কতজন এবং ষাটোর্ধ কতজন। শহরবাসী কতজন গ্রামবাসী কতজন। নারী কতজন পুরুষ কতজনকে এযাবত টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে-এসব কিছুর দফাওয়ারী তথ্য যেমন সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তেমনই নাগরিকজন্য।

সোজা কথায় ৬০ এর নীচে এবং ছয় বছরের ঊর্ধে কতজনকে (বয়স ওয়ারীভাবে) টিকা এক ডোজ এবং দুই ডোজ এযাবত দেওয়া হয়েছে তা প্রকাশ করা হোক;

অনুমান করি, মওজুদ ও চাহিদার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। আমাদের যোগ্যতম এবং প্রভৃতি দায়িত্বশীল ও জনপ্রিয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারবেন না। কত ভ্যাকসিন আছে আর কত ভ্যাকসিন লাগবে সে তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তা সংবাদ মাধ্যমগুলিতে প্রকাশ করা হোক এবং যা ঘাটতি আছে তা সংগ্রহ করার দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া হোক। এই প্রক্রিয়ার কোন স্তরে, যদি নতুন কোন কার্য্যকর ওষুধ আবিস্কৃত ও বাজারজাত করা হয় তবে তা প্রয়োজনাতিত সংগ্রহ করতে অতীতের মত যেন আদৌ বিলম্ব না করা হয়।

বলা হয়েছে এবং দু’বছর আগে থেকেই বলা হচ্ছে বাইরে না যাওয়া, যেতে বাধ্য হলে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করা, বাইরে থেকে ফিরে কাপড় চোপড় আধা ঘন্টা সাবান জলে ধোয়া, ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, ঘর-দুয়ার জীবানুমুক্ত করা, হ্যা- স্যানিটাইজার সর্বদা সঙ্গে রাখা এবং ঘন ঘন ব্যবহার করা। এই উপদেশগুলি জরুরী কিন্তু তা কতজন মানছেন এবং কতজন মানছেন না-সরকারও হয়তো তা জানে না। এ ব্যাপারগুলোকে গুরুত্ব দিতে হলে মাইক-প্রচার তেমন কাজ দেবে বলে মনে হয় না। তার চাইতে সকল জেলার ভিসি-এসপি প্রতিদিন ৫/৭ টি করে ইউনিয়ন পর্য্যায়ে গণ সমাবেশ কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা-সঙ্গে অবশ্যই জেলাগুলির সিভিল সার্জনরা থাকবেন।

তবে সীমিতভাবে এবং বেশী বা কম নিরাপদ বা সম্ভাব্য বিপদগ্রস্ত এলাকাভেদে ষাটোর্ধ ব্যক্তিদেরকেও বুষ্টার ডোজ দেওয়া মওজুদের পরিমাণ বুঝে চালু করা যেতে পারে।

ইতোমধ্যে সৌদি আরবে বুষ্টার ডোজ বাধ্যতামূলক করেছে। অন্যান্য দেশ কারা কারা করেছে জানা যাচ্ছে না অথবা কোন কোন দেশ বিদেশগামী বিমান সার্ভিস বন্ধ করেছে, কোথায় কোথায় করতে যাচ্ছে বা করছে না-কূটনৈতিক মহল থেকে সে তথ্য সংগ্রহ করাও জরুরী। আজকের পৃথিবীতে প্রতিটি দেশ যেমন প্রতিটি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কিন্তু নানা চ্যানেলে নানা প্রয়োজন সকল দেশই সকল দেশের সাথে সম্পৃক্ত। এভাবেই দুই বছর আগে করোনা এক দেশ থেকে অপর দেশে গিয়েছিল এবং তার ফলে পৃথিবী জোড়া এম মহা বিপর্য্যয় নেমে এসেছিল। এদিকটি আদৌ যেন উপেক্ষিত না হয়।

যাত্রীভাড়া

এবারে আসি নানা পরিবহনে বর্ধিত যাত্রী ভাড়া প্রসঙ্গে। এ নিয়ে দেশে যে বিপর্য্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা সরকার কর্তৃক তেলের দাম বৃদ্ধি। এ নিয়ে সড়ক-জলপরিবহনের মালিকদের সাথে সাথে দফায় দফায় ভাড়া বাড়ানো না বাড়ানো নিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন তারই যৌক্তিক পরিণতি। যখন বিশ্বব্যাপী তেলের দাম প্রতিদিন হ্রাস পাচ্ছে-আমাদের দেশের সরকারের তা নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই। পকেট কাটাযাচ্ছে যাত্রীদের এবং পণ্যমূল্য বৃদ্ধি জনিত কারণে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের ।

এই খেলা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সঙ্গতি রেখে অবিলম্বে কমানো হোক-সেই অনুপাতে পরিবহন ভাড়াও কমানো হোক। নানা সিণ্ডিকেট যেভাবে খোঁড়া অজুহাতে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করেছে-সেই সিণ্ডিকেটগুলি ভেঙ্গে দিয়ে পণ্যমূল্য কমানো হোক।

ভুলে গেলে চলবে না, সরকার, জনগণের জন্য-জনগণ সরকারের জন্য না।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test