E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আসপিয়া চাকরি পেল কিন্তু ছাত্র যুব সমাজ?

২০২১ ডিসেম্বর ১৭ ১৫:১৯:২০
আসপিয়া চাকরি পেল কিন্তু ছাত্র যুব সমাজ?

রণেশ মৈত্র


বহু কালের অভ্যাসমত সকালে ইন্টারনেটে পত্রিকাগুলো দেখে ঢুকলাম ফেসবুকে। রোজই করি। ভাল কিছু দেখলে তা আবার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করি বা লাইক দেই বা কমেন্ট করি। ভালই লাগে এই যোগাযোগ। কিন্তু সকালে ফেসবুকে ডসয়ে একটি পোষ্ট দেখে মনটা ভারী হয়ে উঠলো-বেদনার্ত বোধ করছি এখনও। পোষ্টটিতে আমাদের অহংকারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি নির্মলেন্দু গুনের অনশনে যাবার হুমকি দেখে মানসিকভঅবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। তিনি লিখেছেন, “ভূমিহীন হলে পুলিশের চাকুরী করা যাবে না-এরকম একটা আইন আছে, সেটাই তো জানতাম না। কনষ্টেবল পদে চাকরির জন্য সাত স্তরে যাচাই বাছাই, শারীরিক যোগ্যতা, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা এবং দুই দফা মেডিক্যাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বরিশালের হিজলা উপজেলার কলেজ ছাত্রী আসপিয়া ইসলাম ভূমিহীন পিতার সন্তান হওয়ার কারণে পুলিশে চাকরি হচ্ছে না। এদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য অনেক ভূমিহীন ও যুদ্ধ করেছিল। আসপিয়া চাকরি পাবে না এটা হতে পারে না-হতে দেওয়া যায় না। এই আইন বাতিল কিংবা সংশোধন করে তাকে চাকরি দেওয়া হোক। নইলে আমি অনশনে বসবো।

জনৈক রুহুল কুদ্দুস বাবুল ও একই কথা লিখেছেন। জনৈক আলী আকবর তারা লিখেছেন, আপনার সঙ্গে আছি। মেয়েটি ভূমিহীন এই বাক্যটি উচ্চারণ করতে বুকের ভেতর মোড়ক দেয়। কেন সে ভূমিহীন? কেউ অঢেল সম্পদের মালিক ভূস্বামী আর কেউ ভূমিহীন মানা যায়? বিবেকের তাড়নায় ঐ পোষ্টগুলি পড়ে এবং অসহায় মেয়েটির ছবি দেখে আমিও নির্মলেন্দু গুনের সাথে সংহতি জানাই। সংহতি জানাই। কী অদ্ভুদ দেশ আমাদের আইনটি নিশ্চয় ইংরেজদের বা পাকিস্তানীদের করা। কিন্তু বাংলাদেশ অর্জনের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পরেও আইনটি দিব্যি বহাল এবং কার্যকর আছে দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেকের প্রচ- দংশন অনুভব করি।

দেশটা তাহলে কাদের? কোটিপতিদের? তাদের সন্তানদের চাকরি পাওয়া বৈধ এবং পেয়েও যাচ্ছে বড় বড় পদ যদিও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদের কোন অবদান ছিল না-হয়তো বা তাদের অনেকেই জামায়াত আলবদর-জামায়াত বিস্তর টাকা পয়সা দিয়ে নিজেদের জীবন বাঁচিয়েছে যার অর্থ প্রকারাস্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শিবিরে অবস্থান নিয়েছে। আইনে, এই স্বাধীন বাংলাদেশে তারা বা তাদের সন্তানরাই কি তাহলে কম যোগ্য বা যোগ্যতা বিহীন হলেও চাকরি পাবেন আর ভূমিহীন হওয়ার কারণে তারা বা তাদের সন্তানেরা যোগ্য প্রমাণিত হওয়া সত্বেও, চাকুরী না পেয়ে ভিজ্ঞার ঝুলি নিয়ে পথে পথে বেড়াবে আর দারিদ্রের জন্য এবং হয়তো বা শরীরের জন্যও লাঞ্ছিত হচ্ছে? কবির ভাষায় বলতে হয় “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি।”

দেশে বেকার ও দরিদ্রের সংখ্যা আইন করে বাড়ানোর ব্যাপারটা তুলনাহীন। প্রশ্ন অবশ্যই করা যায়, হামেশা প্রচার করা হয়, আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়ে কয়েক হাজার ডলার বেড়েছে। আসপিয়া বা তার বাবার বা কলিম উদ্দিন সলিমুদ্দিদের কি বেড়েছে? তা হলে বাড়লো কার? ডা. মুরাদ হোসেন দের? ঐ যারা ব্যাংকের টাকা পাচার করে, কলিমুদ্দি-সলিমুদ্দিন, কার্তিক-গণেশ বা জনদের অংশ তাহলে তাদের পকেটে যাচ্ছে? যারা দেশে বিদেশে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়ী-গাড়ী তৈরী করে বিলাসী জীবন কাটাচ্ছেন-ঐ মাথাপিছু আয়ের ৯৯% তাদের পকেটে গিয়ে বাড়ী ১ ভাগ কি ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্যে ভিক্ষা বা অনুদান হিসেবে যাচ্ছে?

দৈনিক সমকালের শেষ পৃষ্ঠায় “মেধা তালিকায় পঞ্চম-তবুও চাকরি হচ্ছে না আসপিয়ার” শীর্ষক প্রকাশিত খবরটি চোখে পড়লো। তাতে একটু ভিন্ন কথা বলা হয়েছে-তবে মূলত: একই। সমকালের বরিশাল ব্যুরো লিখেছে পিতৃহীন আসপিয়া ইসলাম (১৯) পুলিশ কনষ্টেবল পদে চাকরি পাবেন এমন খবরে তার পরিবার এবং পাড়া-প্রতিবেশীরা ছিলেন উৎফুল্ল। আশপিয়ার চাকরি হলে অভঅবের সংসারে ফিরে আসবে সচ্ছলতা এমন স্বপ্নে বিবোর ছিলেন পরিবারের সবাই। কিন্তু স্থায়ী ঠিকানা নিয়ে জটিলতার কারণে চাকরিটা হচ্ছে না আসপিয়ার।

চাকরি হবে না-এখবর জানতে পেরে গত বুধবার আসপিয়া ছুটে যান বরিশাল বেঞ্জের উপ-পলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম আখতারুজ্জামানের কার্য্যালয়ে। সেখানে গিয়ে আসপিা কেন চাকরি পাবেন না তা জানতে চাইলে ডিআইজি তাঁকে বলেন, স্থায়ী ঠিকানা যেখানে সেখানে সে জেলা থেকে আবেদন না করার কারণে তাঁদের করার কিছু নাই।

নিয়োগ পরীক্ষার মেধা তালিকায় পঞ্চম হয়েও পুলিশের কনষ্টেবল পদে নিয়োগ বঞ্চিত হচ্ছেন তাসপিয়া ইসলাম কাজল (১৯)। উত্তরাধিকার সূত্রে এই তরুণীর স্থায়ী নিবাস ভোলার টরফ্যাশন উপজেলায়। বাবার কর্ম সূত্রে বরিশালের হিজলা উপজেলায় ভাড়া বাড়িতে জন্মগ্রহণ ও শিক্ষা সম্পন্ন করায় তিনি আবেদনপত্রে স্থায়ী ঠিকানা হিজলা উপজেলা লিখেছেন এই ত্রুটির কারণে নিয়োগপত্র প্রদানের আগে পুলিশ তদন্তে আপসিয়া নিয়োগ অযোগ্য বিবেচিত হয়েছেন সরকারি চাকরী নামক সোনার হরিণটি হাতছাড়া হওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন আপসিয়া ও তাঁর পরিবার।
আপসিয়ার পরিবার হিজলার খুন্না গোবিন্দপুর মেজবাহ উদ্দিন অপু চৌধুরীর বাড়িতে ভাড়া থাকেন। সেখানকার একাধিক বাসিন্দা জানান-তার বাবা শরিফুল ইসলাম চরফ্যাশন থেকে তিন দশক আগে হিজলায় এসে বসবাস শুরু করেন। তিনি ঠিকদারী কাজ করতেন। ২০০৯ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। শফিকুল ইসলামের তিন মেয়ে এক ছেলের জন্ম ও লেখাপড়া হিজলাকে বাবার মৃত্যুর পর বড় ছেলে ঢাকার পোষাক কারখানায় চাকরি নিয়ে সংসারের হাল ধরেন।

আসপিয়ার স্বজনরা জানান, ২০২০ সালে হিজলা ডিগ্রী কলেজ থেকে আসপিয়া এইচ.এস.সি পাশ করেন। গত সেপ্টেম্বরে বরিশাল জেলার জনবল নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে আসপিয়া আবেদন করেন। ১৪, ১৫, ১৬ নভেম্বর জেলা পুলিশ লাইনে শারীরিক যোগ্যতা পরীক্ষা, ১৭ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষা এবং ২৪ নভেম্বর একই স্থানে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধাতালিকায় পঞ্চম হলে তিনি পরে ২৬ নভেম্বর জেলা পুলিশ লাইনে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয় ও ২৯ নভেম্বর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চূড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয় আসপিয়ার। সংসারের অভাব-অনটন লাঘবের স্বপ্নে নিয়োগ পত্র পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। কিন্তু পুলিশ তদন্তে ঘটে বিপত্তি।

আসপিয়ার নাম, ঠিকানা ও পরিচয় তদন্তের কাজ করেছেন হিজলা থানার পুলিশ উপ-পরিদর্শক আব্বাস উদ্দিন। তিনি বলেন আবেদন পত্রে দেওয়া ঠিকানায় তদন্তে গিয়ে জানতে পারেন আসপিয়ার পরিবার সেখানে ভাড়াটিয়া বাসিন্দা। হিজলায় তাদের জমিজমা নেই। তার দাদাবাড়ী ভোলার চরফ্যাসান উপজেলায়। বাবা শরীফুলের মৃত্যু হলে তাকে চরফ্যাশান উপজেলায় দাফন করা হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের চরফ্যাশনের দাদাবাড়ি হচ্ছে স্থায়ী ঠিকানা। এস আই আব্বাস উদ্দিন বলেন আসপিয়ার জন্ম ও লেখাপড়া হিজলা উপজেলাতে। সে কারণে না বুঝে স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করেছেন। এসব বিষয় উল্লেখ করে তিনি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে বৃহস্পতিবার দুপুরে আর এক কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করলে আসপিয়াকে জানানো হয়, তার জন্যে খারাপ লাগছে কিন্তু আইন না থাকায় কিছু করার নেই। আইন কার স্বার্থে? কারা তৈরী করেন? বিস্তারিত জেনে বুঝা গেল ভূমিহীন হওয়ার এবং স্থায়ী ঠিকানা ভুল লেখার ফলে চাকরীটি আসপিয়া পাচ্ছেন না সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চূড়ান্তভাবে পঞ্চম স্থান অধিকার করা সত্বেও। এতে স্পষ্ট হয় মেধা নয়-স্থায়ী ঠিকানাই বড় এবং একমাত্র বিবেচ্য। কমমেধা সম্পন্ন যে কেউ চাকরি পেতে পারেন স্থায়ী ঠিকানা ঠিকমত লিখলে?

কনষ্টেবল তো হবে শিক্ষিত এবং যোগ্য মেয়ে তাফিয়া-স্থায়ী ঠিকানা তো চাকরী করবে না। দেখার বিষয় হিসাবে প্রধান্য কিসের? এক. প্রার্থীর মেধা ও যোগ্যতা, দুই. প্রার্থী নাগরিকত্ব, তিন. তার বাবা-মায়ের নাম ও জন্মতারিখ।

এই তিনটা বিষয় ঠিক থাকলে ঠিকানাতে কি আসে যায়? সে যুগ নেই যখন মানুষ গ্রামে বাস করতো, চাষাবাস করে জীবিকা নির্বাহ করতো। পত্র পত্রিকা দেখার সুযোগ ছিল না। তখন হয়তো স্থায়ী ঠিকানার আইনের সামান্যতম গুরুত্ব ছিল। এখন মানুষ দূর-দূরান্তে ব্যবসা, চাকুরী ও অন্যান্য কাজে লিপ্ত। পৈত্রিক বাড়ী ঘর বংশগত ঠিকানা এখন আদৌ কোন ঠিকানা ন। “বর্তমান ঠিকানাই” তো যথেষ্ট যদি উপরের তিনটি বিষয় ঠিক থাকে এবঙ পরীক্ষাগুলিতে সাফল্য অর্জন করে। আর দু’তিন দশক পরে তো এখনকার বড় বড় কর্মকর্তাদের নাতি নাতনিরাও স্থায়ী ঠিকানা নামক বস্তুটি জানবেই না। জানবেই না স্থায়ী ঠিকানা কাকে বলে?

আসফিয়া ও ছাত্র আন্দোলন

বিস্তারিতভাবে জানা গেল, একটি চরম বৈষম্যমূলক, অগণতান্ত্রিক, অনৈতিক, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী তথাকথিত আইন গরীব, নিরীহ কিন্তু যোগ্য ছেলেমেয়েদের জীবনের সকল স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরণত করছে। এই দুঃস্বপ্নে আরও অনেকে ভোগেন নিশ্চয়ই কিন্তু এই মুহুর্তে তেমন তথ্য আমাদের হাতে নেই।

ছাত্র সমাজ নিরাপদ সড়ক ও অর্ধেক ভাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে মঞ্জুর ও নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত প্রশংসনীয় আন্দোলন করছেন যদিও এটি সরকারের কর্তব্যের ও আইনের আওতায় পড়ে। কিন্তু সরকার সে পথে না হেঁটে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের অযথাই রাজপথে নামতে, লাঠির ও গুলির আঘাত খেতে বাধ্য করে চলেছে অসংখ্যবার।
কিন্তু আসফিয়ার কথা, আশফিয়ার মত অন্যদের কথা কে বলবে? আগে তো এ দায়িত্ব ছাত্র সমাজই নিতেন-আজ কেন নয়? তখন ছাত্র সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলা দারিদ্র্য মোচন, নারী সহ সকলের উপর নির্য্যাতনের বিরুদ্ধে, স্বায়ত্ব শাসনের দাবীতে, এককেন্দ্রিক অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যমুক্ত বিজ্ঞান-ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করতেন-সবার জন্য কাজের অধিকারের জন্য আন্দোলন করতেন, অস্ত্রহাতে নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দুঃসাহসী যুদ্ধ পরিচালনা করে দেশ স্বাধীন করলেন-প্রজন্ম বদলের সাথে সাথেই কি সে সব বৈধ দাবীতে আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেল?

আসলে কাল টাকা ও অস্ত্রের এবং ক্ষমতার রাজনীতির প্রলোভন এক শ্রেণীর ছাত্র-যুব সমাজকে বিপথগামী করে তুলেছে। কিন্তু সে কত ভাগ? ১০ ভাগের বেশী তো নয়। আসফিয়াদের জন্য বাকী ৯০ ভাগের যে দ্রুতই এগিয়ে আসা প্রয়োজন-তা ভুললে চলবে কেন। নতুন প্রজন্মের ছাত্র-যুব সমাজের ভবিষ্যতও যে সুস্থ রাজনীতি, সংগঠন ও আন্দোলনের উপর নির্ভরশীল তা যেন ভুলে না যাই। ভুলে যেন না যাই আসফিয়ারাই এ দেশের প্রাণ।

খবর জানার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আসপিয়ার স্থায়ী ঠিকানা ও চাকরির ব্যবস্থা করলেন । অভিনন্দন জানাই। দাবী জানাই এমন যত আইন আছে সব বাতিল করুন।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test