E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্বাগত ২০২২ : বছরটি যেন নির্ভয়ে কাটানো যায়

২০২২ মার্চ ১০ ১৬:৪৬:৪৬
স্বাগত ২০২২ : বছরটি যেন নির্ভয়ে কাটানো যায়

রণেশ মৈত্র


২০২১ সাল বিদায়। কিন্তু কোন বিদায়ী অনুষ্ঠান বা ফেয়ারওয়েল ফাংশনের আয়োজন কোথাও করতে দেখা গেল না। খৃষ্টান সমাজ গীর্জার অভ্যন্তরে বসে কোন প্রার্থনাদির আয়োজন হয়তো করেছেন-সীমিতভাবে, তারুণ্যের প্রকাশ জনিত কারণে, হয়তো কোথাও কোথাও থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্দামতার সাথে উদযাপিত হয়ে থাকতে পারে-তবে তা বহুলাংশে নিষ্প্রাণভাবে।

বিদেয় দিয়েছিলাম ২০২০ সালকেও। যেভাবে এবার ২০২১ কে বিদেয় দেওয়া হচ্ছে, ঠিক সেভাবেই। করোনার বিভীশিকার এই দুটি বছর জুড়েই পৃথিবীব্যাপী মানুষের জীবনকে গতিহীন, বিধ্বস্ত ও নানাভাবে বিপর্য্যস্ত করে তুলেছে।
অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর মিছিল সেই যে ২০২০ এর মার্চে শুরু হলো-তা আজ পর্য্যন্ত প্রতিদিনই দুটি বছর ধরে বড়ই হতে থাকলো। এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্য্যন্ত মাত্র দুটি দুর্দিন।

কারও করোনায় মৃত্যু ঘটে নি বলে জানা গেছে। কিন্তু বাদ-বাকী প্রতিটি দিনই দুই, তিন, পাঁচ থেকে আড়াই শত পর্য্যন্ত মানুষকে বিদেয় নেওয়ার খবর গণমাধ্যমসূহে প্রকাশিত হওয়ার খবর শুনা গেছে। বাংলাদেশে এ যাবত মৃত্যুর সংখ্যা ৮,০০০ ছড়িয়ে গেছে। অসংখ্য বুদ্ধিজীবী ঐ মৃত্যুর তালিকায় স্থান পেয়েছেন। তাঁদের সংখ্যা প্রায় ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। শিক্ষক, সাংবাদিক, নানা পেশাজীবী মানুষ বহুসংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থকর্মী বিদেয় নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তির দিকে থেকে সমগ্র বাংলাদেশকে প্রায় একটি শূন্য গোয়ালে পরিণত করেছে। নারী-পুরুষের মধ্যে নারীর তুলনায় পুরুষের মৃত্যু অনেক বেশী ঘটায় পৃথিবী জুড়ে নারী-পুরুষের সংখ্যায় মারাত্মক ভঅরসাম্য সৃষ্টি করেছে।

লক্ষাধিক মানুষ বাংলাদেশে আক্রান্ত হয়েছে-তার বেশীর ভাগই চিকিৎসায় বা বিনা চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু যাঁরা সুস্থ হয়ে উঠলেন-তাঁদের মধ্যে কতজন পঙ্গত্ব বরণ করে অসহায়ভাবে সয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন-সে সংখ্যা প্রকাশ না করায় জানা গেল না আজ পর্য্যন্ত।

বিগত দুই বছর যাবত বাঙালির ঐতিহ্যের উল্লেখযোগ্য একটি দিক হলো বন্ধু-বান্ধবের বাড়ীতে বেড়ানো, আত্মীয় পরিজনের বাড়ীতে যাতায়াত, খাওয়া-দাওয়া, উপহার বিনিময় এ সবই বন্ধ করে দিলো করোনা। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর সর্বত্রই।

বাইরে যাওয়া, সব কিছু বাদ দিলেও, সকলেরই স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অন্যতম প্রয়োজন। সে কাজটি বন্ধ হলো-স্বাস্থ্য বিধি মানার কারণে অনেকেরই যেন বিনা অপরাধে, বিনা বিচারে গৃহবন্দীত্ব নেমে এলো অনেকের জীবনে।

আবার যাঁরা বাইরে না গিয়ে পারবেন না-তাঁদেরও স্বাধীনতা হরণ হলো ঐ স্বাস্থ্যবিধির নামেই। মাস্ক পরা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা, ন্যূনতম দুই গজ দূরত্ব (একের সাথে অপরের) রেখে চলা, জাতীয় নির্দেশের নামে। কিন্তু বাস্তবে কি সবগুলি বিধান সকলের মানা সম্ভব?

হুকুম হলো মাঠে ঈদের জামাত নয়, স্বাস্থ্য-বিধি মেনে দফায় দফায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠান, পরস্পরের ঐতিহ্যবাহী আলিঙ্গনে নিষেধাজ্ঞা সবই স্বাভাবিক ধর্মীয় জীবনকেও বিব্রত করেছে।
তেমনই ঘটেছে দুর্গোৎসবে, জন্মাষ্টমীতে-বড়দিনের সমাবেশগুলিতেও।

দীর্ঘকাল সাধারণ দোকান পাট বন্ধ রাখা, কল-কারখানা বন্ধ রাখা, শ্রমিকদের বেকারত্ব ও ক্ষেত্রবিশেষে অনিয়মিত বেতন একদিকে-অপরদিকে অসংখ্য কোটিপতির সৃষ্টি এমন আর্থিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণে। তারা সিন্ডিকেট গড়েছে, পণ্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটিয়েছে দারিদ্র্যের কষাঘাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে জর্জরিত করেছে।

শিক্ষাঙ্গনগুলি তরুণ-তরুণীর সরব পদচারণা থেকে বঞ্চিত হলো দেড়টি বছর ধরে একটানা সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ফলে। বন্ধ রাখার কোন বিকল্পও ছিল না-কারণ করোনা হলো অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ-তাই শিশু-কিশোর-কিশোরীদের জীবনকে কোন ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেওয়া যায় না। কিন্তু ফলে লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীর শিক্ষা জীবন দীর্ঘদিন ধরে একটানা ব্যাহত হলো-তা পূরণের কাজটি প্রায় অসম্ভব। এতকাল ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ থাকায় ঝরে পড়েছে অসংখ্য শিশু, বেড়েছে বাল্যবিবাহ ও অকাল মাতৃত্ব। এবম্বিধ অসংখ্য সমস্যায় দুটি বছর ধরে বিপর্য্যস্ত হয়েছে জনজীবন যার মেয়াদ নিঃশেষিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

তবে ২০২১ এর শেষ প্রান্তে এসে মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসায় কিছুটা আশাবাদের লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। দেখা যাচ্ছিল এক সোনালী সম্ভাবনা বা তার আলোক রশ্মি। কিন্তু ২০২০ ও ২০২১ দু’বছরেই দীর্ঘ লকডাউনের কবলে পড়তে হয়েছে। বিমান বন্ধ, বাস-সার্বিস বন্ধ, লঞ্চ-স্টীমার বন্ধ, কল-কারখানা-অফিস-আদালত বন্ধ-যেন জীবনটাই লক্ড ডাউন হয়ে গেল। কোন বাড়ীতে কারও করোনায় আক্রমণের খবর পেলে বাড়ীটাই সীল করে দেওয়া, কাউকে বাইরে যেতে বা কাউকে ভেতরে আসতে না দেওয়ার বিভীষিকার অনেকের জীবনেই সইতে হয়েছে।

এর সুযোগ নিয়েছে ব্যবসায়ীরা পরিবহন বন্ধ থাকার মিথ্যে অজুহাতে (মিথ্যে বলছি এ কারণে যে যাত্রী পরিবহন বন্ধ থাকলেও পণ্য পরিবহন কদাপি বন্ধ থাকে নি) নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিসহ সকল পণ্যের অগ্নিমূল্য তৈরী করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনে অসহনীয় বিপর্য্যয় ঘটিয়েছে। সরকারিভাবে কিছু এবং ক্ষেত্র বিশেষে বে-সরকারি কোন কোন মহল থেকে কিছু ত্রাণের ব্যবস্থা অবশ্য করা হয়েছিল কিন্তু তা পেয়েছেন যত সংখ্যক মানুষ পান নি ততোধিক দরিদ্রজন।

এবারে ওমিক্রন : নতুন আতংক হঠাৎ করেই দক্ষিণ আফিকা থেকে ওমিক্রন নামক করোনার এক নতুন ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়েছে। ঐ দেশটিতে ওমিক্রন ধরা পড়ার পর মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে তা প্রায় ৮০টি আফ্রিকান, ইউরোপীয়ন ও এশিয়ান দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ইংল্যা-ে একজনের মৃত্যুরখবরও পাওয়া গেছে। আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়া থেকে এই নিবন্ধ লেখা পর্য্যন্ত ওমিক্রন আক্রমণের খবর পাওয়া যায় নি।

২০২১ এ এ রোগের হাত থেকে বিন্দুমাত্র রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে ২০২২ এ পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে, ভবিষ্যতে তা জানা যাবে ।

৫০ কোটি মানুষ বিশ্বব্যাপী ক্ষতিগ্রস্ত

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য সেবা বিঘ্নিত হয়েছে। এটি গত শতাব্দীর ৩০ এর দশকের সবচেয়ে বেশী অর্থনৈতিক সংকট তৈরী করেছে। এই পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সেবার খরচ মেটানো কঠিন করে তুলেছে। গোটা বিশ্বের উপর করোনা মহামারির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ১০ বছরের মধ্যে অন্যান্য টিকাদান কার্য্যক্রমের আওতা প্রথমবারের মধ্যে হ্রাস পেয়েছে। ফলে যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

এই মুহুর্তে চীন

একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে চীনে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে পাঁচ লাখ লোককে কোয়ারান্টাইনে রাখা হয়েছে। করোনার সংক্রমণ চীনে রাড়তে থাকায় উৎপাদন বন্ধ রেখেছে চীনের বেশ কয়েকটি কোম্পানী। দেশটির রাজধানী বেইজিং এ শীতকালী অলিম্পিকের আগে ওমিক্রন ধরণে আক্রান্ত হয়েছে কয়েকজন। দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৯৪ জন। যুক্তরাজ্য জানিয়েছে, ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়ে অন্তত: ১৫০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন-ভর্তি ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বৃটেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ডোমিনিক রাব জানিয়েছেন, ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়ে অন্তত: ২৫০ ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। লন্ডনে শীঘ্রই লন্ডনে ওমিক্রন প্রাণঘাতি রূপ ধারণ করতে পারে।
ভারতের দিল্লী ও রাজস্থানে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। ওমিক্রনের প্রভাবে এশিয়ার অর্থনীতিতে প্রত্যাশা অনুযায়ী সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)

ওমিক্রনের বিভীষিকা

জি-সেভেন সম্প্রতি বলেছে, বৈশ্বিক জনস্বাস্থের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হতে পারে ওমিক্রন। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে উল্লেখ করে সতর্ক করেছে জি-৭ জোট। এই ভ্যারিয়েন্ট ইউরোপ ছাড়াও বিশ্বের জন্য হুমকি বলে একমত হয়েছেন জোটের স াতজন স্বাস্থ্য মন্ত্রীই। জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওমিক্রন উত্থানের অর্থ হলো, দেশগুলোর জন্য ঘনিষ্ট সহযোগিতা করা আগের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। সংক্রণের বিস্তার রোধে সামাজিক ও জনস্বাস্থ্যের ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে জোটটি।

২০২২ এর আকাংখা

দেশের চাহিদা অনেক। সমস্যাও অনেক। সবগুলির সমাধান ২০২২ দিতে পারবে-এমন ভরসা বাস্তবতা বর্জিত। কিন্তু যে আকাংখা-যে কর্তব্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন ২০২২ এ যেন ২০২০-২১ এর ম তো করোনার বিভীষিকা ও অসংখ্য মৃত্যু ও সংক্রমণ ডেকে আনতে না পারে তার জন্যে সকল আত্মতুষ্টি বিসর্জন দিয়ে আরও বেশ কিছু বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ করা হোক-একটি করোনা-ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীও যেন চিকিৎসা সুযোগ বঞ্চিত না হন, আমাদের সম্পদ চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে আর যেন ওই রোগের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে জীবন দিতে না হয় এবং সর্বোপরি করোনা-ওমিক্রনের স্থায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ও ওষুধ তৈরীর এবং গবেষণার আশু উদ্যোগ নেওয়া হোক। ২০২১ এর শেষে মৃত্যুও সংক্রমণ কমে আসার ধারা যেন ২০২২ এও অব্যাহত থাকে-তাকে নির্মূল করে।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test