E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমাদের বইমেলা এবং বন্ধ ঘরে তালা 

২০২২ মার্চ ১২ ২২:৩৮:৪০
আমাদের বইমেলা এবং বন্ধ ঘরে তালা 

রহিম আব্দুর রহিম


পৃথিবীর স্বাদ পেতে হলে একটা জীবন্ত প্রাণ থাকতে হয়। 'প্রাণ' মানেই পৃথিবী নামক বিশাল রাজ্যের অবাধ বিচরণের আনন্দঘণ পরিবেশ।যেখানে সভ্য জগতের মানুষরা খুঁজে ফিরবে রহস্যময় জগতের নানা ব্যঞ্জনা, রূপ-রস, আদি-অন্ত। পৃথিবীর সকল সৃষ্টিশীল মানুষের ইতিহাস তাই বলে। কেউ সৃষ্টির মাঝে, কেউ আবার শ্রষ্টার মাঝে আনন্দ খুঁজে। এই খুঁজাখুঁজির নামই জীবন। এই জীবন কৌতুহলি হয়ে ওঠে একেবারেই শিশুর প্রারম্ভিক বয়সে। একটি শিশুপ্রাণ ছয় মাস বয়স থেকেই ধাপে ধাপে পরিবর্তন, পরিবর্ধন হয়ে এক সময় এই প্রাণটি 'রাজা-রাণী'তে পরিণত হয়।যেখানে জাত-কূল, ধর্ম-বর্ণ, সাদা-কালোর কোন পার্থক্য থাকে না। সভ্যতায় মানুষকে 'মানবপ্রাণ' আর বন্য প্রাণিদের 'পশু' বলে।যা যৌক্তিক পৃথিবীতে অযৌক্তিক প্রলাপের নামান্তর। একপাল পশু এই পৃথিবীর কল্যাণ, মঙ্গল এবং ভারসাম্য রক্ষায় যা করেছে, তামাম দুনিয়ার গোটা মানুষরা তার সিকি ভাগও করে নি। আমরা শিক্ষার নামে কুশিক্ষা এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামকে সম্পদ গড়ার যুদ্ধে পরিনত করেছি।    

মানুষ চলাফেরা, আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে যে শিক্ষা অর্জন করতে পারে, তা হাজার বছর পাঠ্যসূচির ভেতর থেকে অর্জন করা সম্ভব না। একটি জাতির ইতি-ঐতিহ্য, কৃষ্ঠি-কালচার, দুঃখ-বেদনা,হাসি-কান্না, মান-অভিমান খুঁজে পেতে হলে তাঁকে প্রথমেই খুঁজে নিতে হবে একটি মাত্র ভালো বই। যা চার দেয়ালে ঘেরা কোন খুঁপড়িতে বসা জ্ঞানরাজ্যের শাসক-শোষক নামের কোন মাস্টার মহাশয়ের প্রাইভেট টেবিলে নয়।বিদ্রোহী কবি নজরুল, বিশ্বকবি রবীদ্র নাথ, ক্ষ্যাপা কবি মুকুন্দ দাস, সক্রেটিস, এরিস্টেটল, জাতির পিতা শেখ মুজিবসহ শত মণিষীর জীবন আলেখ্যে এমনটাই বলে।

ছাত্রজীবন থেকেই পাঠ্যসূচির বাইবের বই পড়তে ভাল লাগতো,সেই থেকে অভ্যাস। লেখার চেয়ে পড়তে ভালো লাগে।বইমেলা জ্ঞান পিপাসুদের আড্ডাস্থল। বই পড়তে না পারলেও নেড়ে চেড়ে দেখতে ভালো লাগে। প্রতিবছর বই মেলায় যাই। দু'বছর ধরে বইমেলায় নিজের কিছু বই আসছে।বেঁচা-কেনা কেমন হচ্ছে তা প্রকাশক ভালো বলতে পারবেন। আমি প্রতিবছর কিছু বই কিনতে আসি, একই সাথে কোন শ্রেণি'র পাঠকরা বই কেনে, কারা নেড়ে চেড়ে দেখে এইগুলো অবলোকন করি। এবারও ৮ মার্চ থেকে ১০মার্চ নিয়মিত মেলায় গিয়েছি, বই কিনেছি, পাঠকদের ধরন নির্ণয় করেছি।নান্দনিক প্রচ্ছদ, চকচকে, ঝকঝকে কভারের অনেক বই খুলে দেখেছি। ভেতরে মাল-মসলা খুব একটা ভাল না। আবার হত দরিদ্র কভারের কিছু বইতে খুবই জ্ঞান গর্ব, আনন্দ বিনোদনের পরিচ্ছন্ন উপাদেয় মনে হয়েছে।শিশুরাও এসেছে, সোনামনিদের ‘আদরী উপহার’ বই কেনে দিচ্ছেন মা-বাবারা। এরা পাঠক না, তবে তাদের পাঠক বানাতে নিরন্তর চেষ্ঠা করছেন তাদের বাবা মায়েরা। যা দেশ জাতির জন্য শুভ সংবাদ। টিনএজ বয়সের পাঠক খুব একটা চোখে পড়েনি। যা পড়েছে তা চায়ের স্টলে, লেকের পাড়ে।তা হলে কি বই কেনা-বেঁচা হচ্ছে না? অবশ্যই হচ্ছে। এরা কারা? পঞ্চাশ উর্ধ্ব সেকালের পড়ুয়ারা। এ অবস্থা কেনো? তবে কি আমরা লেখক এবং প্রকাশকরা পাঠক সৃষ্টি করতে ব্যর্থ ?

লেখাটি শেষ করার আগে এবারের বই মেলার এক চরম বাস্তবতা পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। ৮ মার্চ মেলার উদ্যানের পশ্চিমের প্রবেশ গেটে পৌঁছলাম, বেলা তখন গড়িয়ে দুটো ছুঁই ছুঁই।প্রবেশ সময় হয়নি, প্রখর রোদ উদ্যানের বিশ্রাম চেয়ার খাঁ খাঁ জ্বলছে। সেখানে বসে আছে একই বয়সের চার কিশোর, মুখে মাক্স, কপাল রোদে কালো হয়ে গেছে, আমিও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, ওদের সাথে বসলাম। কথা বার্তা হলো, ওরা প্রাইভেট পড়ার কথা বলে বই মেলায় এসেছে। আমার ভালো লাগলো, ওদের ধন্যবাদ দিলাম, এভাবেই জ্ঞানের রাজ্যে আসতে হবে বলায় ওরা আমার সাথে মিশে গেলো, আমার সাথে মেলায় ঘুরে ঘুরে বই দেখলো, বই কিনতে সহযোগিতা করলো, ওদের চেহারে দেখা বুঝলাম, খাওয়া-দাওয়া করার মত টাকা হয়তো আছে বই কেনার মত টাকা নাও থাকতে পারে। ওদেরকে উপহার হিসেবে কিছু বই দিলাম। সে কি খুশি ! মহুর্তেই রাজ্যটা আনন্দে আত্মহারা। ৯ মাচ রাতে ওদের একজনকে ফোন দিন মেলায় আসতে বললাম তবে বাবা মাকে বলে। এই ফোনের জবাবে আমার ই-মেইলে ফাহিম নামে শিক্ষার্থীটি যা লেখেছে তা হুবহু পত্রস্থ করলাম।

স্যার, সালাম নিবেন, গত ৮ তারিখ বইমেলায় আমরা ৪ বন্ধু (আমি, আল-আমিন, আয়ান, মাহিদুল) য়ের সাথে আপনার দেখা হয়েছিলো আমরা আপনার সাথে সারাদিন ঘুরাঘুরি করি আর অনেক গল্পও করি।সবশেষে দিনটা ভালোই কেটেছিলো। গতকাল রাতে আল-আমিন আমাকে ফোন দিয়ে জানায় যে, আজই আপনার ঢাকায় শেষদিন এবং আপনি আমাদের সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। সত্যি বলতে আমার এবং বাকি তিনজনেরও ইচ্ছে হয়েছিলো আপনার সাথে দেখা করার । কিন্তু স্যার দুঃখের ব্যাপার আমাদের ছিলো অনেক গুলো প্রাইভেট যেগুলো মিস দিয়ে ২ দিন আগে বইমেলা থেকে ঘুরে আসি। তাই আজ মিস দিলে হয়তবা ভয়ানক অবস্থা হয়ে যেতো।

এছাড়াও স্যার, বইমেলা থেকে আমাদের বাসা বেশ দুরে।তাই স্যার ইচ্ছা থাকার পর ও আপনার সাথে দেখা হয়ে উঠলো না। আশা করি স্যার পরে যদি কোনো দিন ঢাকায় আসেন আমাদের ফোন দিয়ে জানাতে ভুলবেন না। এবং স্যার আপনার নাম দিয়ে ফেসবুকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাই নি তাই অনেক খারাপ লেগেছে।যদি পারেন একটু কষ্ট করে আপনার ফেসবুক আইডি টার লিংকটা দিয়েন। ভালো থাকবেন স্যার। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”

ফাহিমরা সবাই দশম শ্রেণির ঢাকার একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, ওদের এই চিঠির ভাষা উদ্ধার করা আমার পক্ষে অসম্ভব। অর্ধ দিবস ওদের সাথে চলাফেরায় যা জেনেছি তা হচ্ছে সরকার বিনামূল্যে বই দিচ্ছে এতে সরকারের লোকসান হচ্ছে কারণ স্কুলে বই পড়ায় না শুধুমাত্র কোচিং, প্রাইভেট। খেলাধুলা বিনোদন মোটেই নেই। সবকিছু মিলিয়ে বুঝতে বাকি থাকেনা শিক্ষায় যে আনন্দ নেই, জ্ঞানের রাজ্যে বিচরনের পথ উন্মুক্ত নয় তা স্পষ্ট। এই অস্বাভাবিক বন্ধ ঘরের তালা খুলবে কে ?

লেখক : শিক্ষক, নাট্যকার, কলামিস্ট ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test