E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বঙ্গবন্ধু ও তরুণ প্রজন্ম

২০২২ মার্চ ১৫ ১৪:১০:৪৬
বঙ্গবন্ধু ও তরুণ প্রজন্ম

মোহাম্মদ ইলিয়াছ


হাজার বছরে অনেক মনীষী বাংলার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির প্রসার ঘটিয়েছেন। নিঃসন্দেহে তাদের অবদান ভোলার নয়; কিন্তু এদের সব অবদানকে বুকে ধারণ করে তিলে তিলে একটি অসামান্য স্বপ্নের বীজ বাঙালির মনে গেঁথে দিয়েছেন খুবই সাফল্যের সঙ্গে কেবল একজনই। সেই স্বপ্নটি হলো, বাঙালির আলাদা একটি রাষ্ট্র হবে।

সেই রাষ্ট্রের নায়ক হবেন একজন বাঙালি। এই রাষ্ট্রের ভাষা হবে বাংলা। সেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি পরম মমতায় তাঁকে ডাকেন বঙ্গবন্ধু বলে। তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতা, মানবিকতা, সাধারণ মানুষের প্রতি সহমর্মিতার গুণেই তিনি হতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের সব মানুষের স্বপ্নের সম্রাট। আমাদের জাতির পিতা।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তরুণরাই আগামীর বাংলাদেশের ভরসার প্রতীক। স্বপ্নচারী এই তরুণরাই বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। তাদের অদম্য প্রাণশক্তির বলেই মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছি। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই ছিলেন বয়সে তরুণ। বেশিরভাগই গ্রামের ছেলেমেয়ে। প্রায় ৮০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন সরাসরি কৃষকের সন্তান।

স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের সংখ্যা বিপুল হলেও সরাসরি কৃষিকাজে নিয়োজিত তরুণদের সংখ্যাও কম ছিল না। শহরের ছাত্রছাত্রীদের পরিবারের সঙ্গেও গভীর সম্পর্ক ছিল গ্রামবাংলার। এরা সবাই দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেওয়ার এক অবিস্মরণীয় প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। একাত্তরের সেই দিনগুলো ছিল সত্যি হিরণ্বয়।
আনন্দ ও বেদনার সেই দিনগুলোতে তরুণদের আত্মবলিদানের সেই দৃশ্য যারা নিজের চোখে দেখেননি, তারা কল্পনাও করতে পারবেন না- স্বদেশের জন্য প্রাণ বিতরণের সে কী অসামান্য প্রতিযোগিতা! ‘হাজার বছরের নিপীড়িত-নিগৃহীত বাঙালির এই জেগে ওঠার উপাখ্যান আসলেই বিস্ময়কর। আর তা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মোহনীয় নেতৃত্বের গুণেই।
তরুণরা তাঁর বজ্রকণ্ঠকে পাথেয় করেই বাংলা মায়ের কোলে মাথা রেখেছে। স্বদেশের মাটিকে নিজেদের রক্তে উর্বর করেছে। যেমনটি উর্বর করেছেন বঙ্গবন্ধু তাঁর পবিত্র রক্ত ঢেলে বাংলাদেশের সবুজ মাটি। এমনি এক স্বপ্ন সঞ্চারি নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি পুরো দেশবাসীকে, বিশেষ করে তরুণদের আরও বেশি করে স্বপ্ন দেখতে উৎসাহ দিতেন। আরও বেশি করে গুণমানের শিক্ষা লাভের অনুপ্রেরণা দিতেন। আর সেই স্বপ্নের সমান হওয়ার আহ্বান জানাতেন।

ধ্বংসস্তূপের ওপরে দাঁড়িয়েও তিনি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে ‘কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করেছিলেন। তারুণ্যের শক্তিকে দেশ নির্মাণে কাজে লাগাবেন বলেই তিনি এমন দূরদর্শী নীতি-উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। শোষিত, নির্যাতিত ও লুণ্ঠিত বাংলাদেশের সমাজদেহে সমস্যার অন্ত নেই।

এই সমস্যার জটগুলোকে খুলে সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে’ (বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪)। এমন করে বলতে তিনিই পারেন, যিনি এক রূপান্তরবাদী নেতা। আর তিনিই সেই নেতা, যিনি তাঁর অনুসারীদের, বিশেষ করে তরুণদের মনে লড়াই করার শক্তির সঞ্চার করতে পারেন। সহনেতা তৈরি করতে পারেন।

অনুসারীদের নেতৃত্বের ‘ল্যান্ডস্কেপে’ যথার্থভাবে যুক্ত করতে পারেন। আর জাতির সামনে দীর্ঘমেয়াদি ‘ভিশন’ দাঁড় করাতে পারেন। আমাদের বঙ্গবন্ধু ‘সোনার বাংলা’ গড়ব বলে সেই রকম সুদূরপ্রসারী পথনকশা তৈরি করে দিতে পেরেছিলেন। আর তাই বর্তমান তরুণদের কাছেও তিনি এক অবিস্মরণীয় রাষ্ট্রনায়ক।

আমাদের তরুণদের চোখে বঙ্গবন্ধু কেমন? সম্প্রতি ১৫২৩ জন তরুণ, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর, যাদের ৭৩ শতাংশই শিক্ষার্থী, তাদের প্রশ্ন করেছিলাম, বঙ্গবন্ধু শব্দটি উচ্চারণ করলেই কি দৃশ্যপট তাদের মনে পড়ে! কেন এমনটি মনে হয়? কেমন করে তিনি সমসাময়িক সব নেতাকে ছাড়িয়ে এমন অনন্য হতে পেরেছিলেন? আগামী প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে কী হিসেবে স্মরণ করবেন? উল্লেখ্য, প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তরে অন্তত ৬টি অপশন ছিল এবং একটি প্রশ্নের উত্তরে একাধিক অপশন বাছাই করে কিক করার সুযোগ ছিল।

জরিপে অংশ নেওয়া ৭৬ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন যে, বঙ্গবন্ধুর নাম এলেই তাদের মনে প্রথমে আসে ৭ মার্চের ভাষণের কথা। এদের মধ্যে ৭৯ শতাংশ বলেছেন- তারা মনে করেন, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য পুরো জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং দেশ স্বাধীন হয়েছিল; তাই বঙ্গবন্ধুর কথা মনে এলেই তাদের প্রথমে ওই ঐতিহাসিক ভাষণটির কথা মনে আসে।

৬৫ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর নাম এলেই তাদের মনে প্রথমে আসে স্বাধীন বাংলাদেশের কথা। এদের মধ্যে ৮১ শতাংশ বলেছেন, বঙ্গবন্ধু নিঃস্বার্থভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলেই এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল; তাই তাঁর কথা উঠলেই স্বাধীন বাংলাদেশের কথা মনে আসে। বঙ্গবন্ধুর নাম এলেই আরও যেসব শব্দ বা শব্দগুলোর কথা মনে পড়ে বলে উত্তরদাতারা জানিয়েছেন সেগুলো হলো : জাতির পিতা (৫৯ শতাংশ), ৬ দফা আন্দোলন (৫৬ শতাংশ) এবং সংগ্রামী দেশপ্রেমিক (৫১ শতাংশ)।

সমসাময়িক অন্য রাজনৈতিক নেতাদের ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু কী করে একক জাতীয় নেতা হলেন?- এ প্রশ্নের জবাবে ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলির কারণে একক জাতীয় নেতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। ৭১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর আপসহীন মানসিকতা তাঁকে সব শ্রেণির মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল বলে তিনি পুরো বাঙালি জাতির নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

৬৫ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বঙ্গবন্ধু সবসময় নিঃস্বার্থভাবে রাজনীতি করেছেন বলে দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে ভরসার পাত্র হয়ে উঠতে পেরেছিলেন আর তাই তিনি হয়েছিলেন একক জাতীয় নেতা। বঙ্গবন্ধুর একক জাতীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে আরও যেসব বিষয় উত্তরদাতারা চিহ্নিত করেছেন সেগুলো হলো : বঞ্চিত মানুষের প্রতি বিশেষ মনোযোগ (৬১ শতাংশ), সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা বোঝার সক্ষমতা (৬০ শতাংশ) এবং ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভ‚মিকা (৫৬ শতাংশ)।

৭৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, আগামী প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করবে একজন আদর্শ জাতীয় নেতা হিসেবে। ৭১ শতাংশ মনে করেন, বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে তিনি আগামী প্রজন্মের মনে থাকবেন। ৬৫ শতাংশ মনে করেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর আপসহীন ও নিঃস্বার্থ রাজনীতির কারণে আগামী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

তরুণদের ওপর পরিচালিত জরিপ থেকে তারা কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে দেখে এবং তাদের ভাবনার কতটা জায়াগাজুড়ে কীভাবে তিনি আছেন, সে সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি এবং সঙ্গত কারণে আশান্বিতও হয়েছি। তরুণদের ওপর পরিচালিত এই জরিপই বলে দেয় যে, বঙ্গবন্ধুকে দেশের শত্রু বলেছিল ‘তুমি কেউ নও’, সেই বঙ্গবন্ধুই দিন দিন আরও বিরাট, আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।

‘যে স্বপ্নের লাশ পড়েছিল উদোম আকাশের নিচে’, সেই স্বপ্ন আজ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে দানা বাঁধছে আমাদের তরুণদের মনে। জরিপের ফলাফল নিয়ে আবারও খোলাখুলি আলাপে বসেছি আমার তরুণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তারা সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।

আগামী প্রজন্মের চিন্তায় ও মননে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা, কর্ম ও দর্শনকে গেঁথে দিতে আমরা কী করতে পারি। আমি খুবই চমৎকৃত হয়েছি যে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আমাদের আজকের তরুণরাও এ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে। তারা একটি বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দিচ্ছে। তা হলো, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষকে নিছক উদযাপনের মধ্যে আটকে না রেখে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ ও দর্শনকে প্রতিফলিত করতে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

এ জন্য কেউ পরামর্শ দিয়েছে স্কুল পর্যায় থেকে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তাঁর চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ডকে পাঠ্যসূচিতে এমনভাবে নিয়ে আসতে, যাতে করে আগামী প্রজন্মের নাগরিকরা তাদের জীবনে বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিকতাটুকু যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’সহ তাঁর নিজের লেখা গ্রন্থগুলো পাঠ করা এবং এগুলোর ওপর ভিত্তি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রুপভিত্তিক পাঠচক্র গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছে কেউ কেউ।

ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে সচেতনতা ও আগ্রহ বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেছে অনেকে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে তরুণদের নিয়ে সাহিত্য সম্মেলন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা করার পরামর্শও এসেছে তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে যে, আজকের শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধুকে তরুণদের মনে গেঁথে দেওয়াটাকে কেবল রাষ্ট্রের একক দায় হিসেবে দেখছে না, বরং একটি সামাজিক ও জাতীয় দায়বোধের জায়গা থেকে ভাবছে। নিজেরাও এ জন্য উদ্যোগী হওয়ার প্রয়োজনীয়তাটি অনুভব করতে পারছে।

কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করিতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব। তাহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।’
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘স্বদেশী সমাজ’, রবীন্দ্র রচনাবলি ২য় খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৩৯৩, পৃষ্ঠা ৬৩৪)। নিঃসন্দেহে বাংলার মানুষ তাঁর সঙ্গে যোগ রেখেছিলেন বলেই এত দ্রুত দেশটি স্বাধীন করা সম্ভব হয়েছে। এরই মধ্যে ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়িয়েছে ‘আরেক বাংলাদেশ’, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বুকে নিয়ে তাঁরই সুকন্যার হাত ধরে।

এই বাংলাদেশে শিশুরা নিশ্চয় খেলবে, মায়েরা হাসবে। তারুণ্যই এগিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের এই দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার সীমানায়। ‘মুজিববর্ষে’ তরুণরা এই অসামান্য নেতৃত্বের নানা অনুপ্রেরণার উৎস সন্ধান করবে, স্বদেশকে জানবে এবং ভালোবাসবে, সেই প্রত্যাশাই করছি। আমি সর্বদা তাদের পাশেই থাকব।

লেখক :৩১তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test