E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, কমিশন গঠন জরুরি নয় 

২০২২ মার্চ ২৯ ১৪:১০:৪৯
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, কমিশন গঠন জরুরি নয় 

চৌধুরী আবদুল হান্নান


প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তা যদি তাঁর অধিনস্ত সৎ, সাহসী, কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দিতে সচেষ্ট না থাকেন, নিজের পদ ধরে রাখতে প্রভাবশালী মহলকে তুষ্ট রাখতে সদা ব্যস্ত থাকেন, তা হলে তাঁর শিক্ষার কি দামআছে ?

আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা রক্ষায় নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে, দক্ষতারঅভাবও। শীর্ষ পদে টিকে থাকা বা দীর্ঘদিন দখলে রাখতে কলা কৌশল করতেই যদি সব দক্ষতা ব্যয় হয়ে যায়, প্রতিষ্ঠানকে সঠিক নেতৃত্ব দানের দক্ষতা অবশিষ্ট থাকে কি করে?

বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের মতো একটি ডুবন্ত তরীকে উদ্ধার করতে দেশের অর্থনীতিবিদ, আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞগণ সরকারকে অনবরত নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। যদিও, যেখানে অর্থের অবৈধ প্রবাহবেশি সেখানে কেবল পরামর্শে কাজ হওয়ার সম্ভাবনা কম। সর্বশেষ পরামর্শ — ব্যাংক কমিশন গঠন। ব্যাংক খাতের দুর্নীতি উদঘাটন ও ব্যবস্থা নিতে মূলত ব্যাংক কমিশন গঠন করতে বলা হয়েছে ।

ব্যাংক কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারি ও তদারকি করার দায়িত্ব যার সেই স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংককেই এ ক্ষেত্রে অনেকেই ঠুঁটো জগন্নাত বা নিধিরাম সর্দার মনে করে থাকেন, সেখানে নতুন আর একটি কমিশন এসে কি করবে? স্বায়ত্তশাসন থাকলেই তো হবে না, যার স্বায়ত্তশাসন, তা বজায় রাখার দায়িত্বও তার ।

এ কমিশনের সভাপতি/সচিব বা অন্যান্য সদস্যদের নিয়োগ দিবেন কারা বা কোন নীতিমালায়?

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগেরই তো কোনো নীতিমালা নেই, ব্যক্তির ইচ্ছা বা সরকারের ইচ্ছাইসব । যোগ্যতা যাচাইয়ের প্রশ্ন নেই। আবার কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতকারী দুর্দান্ত ক্ষমতাধর ঋণখেলাপি , বেসরকারী ব্যাংকের মালিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী প্রতিনিধিদের প্রভাবমুক্ত থাকবেতা কেউ বিশ্বাস করবে না। ব্যাংক মালিকদের অ্যাসোসিয়েশন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে কোটি কোটি টাকা দিয়ে থাকে, যার বিনিময়ে তারা আনুকূল্য প্রত্যাশা করতেই পারেন। এ ব্যাংক কমিশনে বাবুলচিশতির (অধুনালুপ্ত ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন) মতো লোকের অনুপ্রবেশঘটবে না তা কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারে না ।

কেহ কেহ বলেছেন, খেলাপি ঋণ বন্ধে এই কমিশনের বিকল্প নেই। মনে হবে, এমন মতামত ব্যাংকিং এরসাথে বাস্তব অভিজ্ঞতাহীন এবং পুঁথিগত বিদ্যায় বিদ্বান ব্যক্তিদের গতানুগতিক বক্তব্য এবং অনেকটাহাস্যকরও।

তাছাড়া, এ কমিশনে নিয়োগ পাওয়ার জন্য একটা নীরব প্রতিযোগিতাও থাকবে, অনেকেই লাভের হিসাব নিকাশ করবেন, তারা তো আমাদেরই জাত-ভাই, চরিত্র পার্থক্য হবে— এমন আশা করা দুরাশা। কমিশন গঠন হলে, বলা হবে গাড়ি দাও, বাড়ি দাও, টাকা দাও। এটা তাদের চাকুরি ছাড়া কিছু হবে না।

আসলে, ব্যাংক ব্যবস্থা রক্ষার্থে বহুস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা বলয় বিদ্যমান রয়েছে, যথেষ্ট অবকাঠামোগত ব্যবস্থা রয়েছে ।এখন প্রয়োজন কেবল তা কার্যকর রাখা ।

দক্ষ, সৎ কর্মকর্তাগণ বর্তমানে কোণঠাসা হয়ে আছে । ইতোমধ্যে যারা ‘বড় কর্তার’ অনৈতিক নির্দেশ অবলীলায় মেনে না নেওয়ার জন্য রোষানলের শিকার হয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের খুঁজে বের করে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। অনৈতিক নির্দেশ অমান্য করাও নৈতিকতা। তাদের সুরক্ষা দিলে অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাংকের ভিতরেই একটি প্রতিরোধ শক্তি গড়ে উঠবে।

যারা নৈতিকতা, সততার দায় থেকে অন্যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারাক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছেন। একটি প্রতিষ্ঠানে এ সকল প্রতিবাদী কর্মকর্তাদের রয়েছে বহুতর দুর্দশা ।

সর্বশেষ দৃষ্টান্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের সদ্য চাকুরিচ্যুত উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন। তিনি জিরো টলারেন্স নীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের বিরাগভাজন হয়েছেন, চাকুরি গেছে, এখন জীবন নিয়ে টানাটানি। এমন অসংখ্য শরীফ হারিয়ে গেছে, দেশবাসীর নজরে আসেনি। যে রোগের ঔষধ ঘরেই আছে, বাইরে থেকে আমদানি করার দরকার কি ?

অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংককে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করা এবং অধিনস্ত সকল সৎ, সাহসী কর্মকর্তাদের আগলে রাখার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ব্যাংক ব্যবস্তা সুরক্ষার মুলমন্ত্র। ভালো কাজের ইচ্ছা থাকতে হবে, সদিচ্ছা ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test