E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ডিজিটাল বাংলাদেশ : নগরবাসী কী ভাবছেন?

২০২২ এপ্রিল ০২ ১৪:১৬:৫৮
ডিজিটাল বাংলাদেশ : নগরবাসী কী ভাবছেন?

রণেশ মৈত্র


বিগত ২০২০ সালের ২০ মার্চ তাড়াহুড়ো করে ঢাকা ছেড়ে পাবনায় ফিরে যাই। তখন করোনায় আক্রান্ত হওয়া ও কিছু কিছু মৃত্যু শুরু হয়েছিল মাত্র। দ্রুতই বাড়ছিল রোগটি আর বিজ্ঞানীরা নানা দেশ থেকে জানাচ্ছিলেন, করোনার ভাইরাস অত্যন্ত ছোঁয়াচে প্রায় ঝড়ের বেগে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে সমগ্র পৃথিবীতে। সেই আতংকেই অকস্মাৎ ঢাকা ছেড়ে সস্ত্রীক পাবনা চলে গেলাম। 

পাবনা ফেরার পর পরই আমাদের সঙ্গে একই বাসায় বাসকরা একটি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির করোনা টেষ্ট করে পজিটিভ পাওয়া গেল। দুশ্চিন্তা-উৎকণ্ঠা নিয়ে সিভিল সার্জনকে ফোন করে একটি এমবুলেন্স এনে রোগীকে একা হাসপাতালে পাঠালাম। তার স্ত্রী-পুত্র কাউকেই সঙ্গে যেতে দিই নি সংক্রমণের ভয়ে। খবরটি জেনে পাবনার ইউ.এন.ও আমাদের বাসা পূরোপূরি লকডাউন ঘোষণা করে দরজায় ‘লক-ডাউন’ বড় বড় হরফে লেখা একটি কাগজ সেঁটে দিলেন। গোটা এলাকায় আতংক সৃষ্টি হলো।

এর ১০/১৫দিন পরে হাসপাতালে পর পর দু’বার টেষ্ট করে নেগেটিভ ফল আসাতে তাকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হয়। তার পূর্ব মুহুর্তে আমরা দু;জন সহ বাসার অপর সকলের টেষ্ট করে নেগেটিভ পাওয়া গিয়েছিল। অত:পর লক-ডাউন প্রত্যাহৃত হয়।

সেই যে বাসার বাইরে যাওয়া বন্ধ হলো-গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে অষ্ট্রোলিয়া থেকে বড় ছেলে প্রবীর আসা পর্য্যন্ত একদিনও বাইরে যেতে পারি নি। বাড়ী যান নি সহধর্মিনী পূরবীও। লিটারে লিটারে তরল জীবানুমুক্ত করণ বাড়ীর প্রতিটি ঘর জীবানুমুক্ত করা প্রতিদিনের কাজ হয়ে দাঁড়ালো। মাস্ক-হ্যা-ওয়াশের তো কোন হিসেবই নেই যেমন নেই সাবানেরও। কিন্তু হাট-বাজার তো করতে হবে। পেলাম স্নেহভাজন এক যুবক প্রবীর জোয়ার্দ্দারকে। সে নিয়মিত চাল, ডাল, তেল, নূন, সবজী তরী-তরকারি, মাছ, ওষুধ যখন যা দরকার হয়েছে প্রদীপকে ডেকে ফর্দ ও টাকা হাতে দিলেই বাজারে ছুটে গিয়ে সব কিছু কিনে এনে আমাদেরকে বাঁচিয়েছে। তাই তার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

এ কথাগুলি বলার কারণ হলো কোন ব্যক্তির প্রচার নয় বা কারও অহেতুক বা যৌক্তিক প্রশংসা করাও নয়-যে অবস্থার প্রায় ৮০০ দিন কাটলো তার উল্লেখ করা। এমন পরিস্থিতিকে নিশ্চয়ই মোকাবিলা করতে হয়েছে। সেই দুঃসহ গৃহবন্দীত্ব অনেকাংশ কাটলো যখন প্রবীর আমাদেরকে ঢাকায় নিয়ে এলো স্রেফ মেডিক্যাল কারণে। আমাদের স্বাস্থ্যের অবনতি তাকে পীড়িত করেছে। আবার দেশে আমরা ভুগছি জেনে অষ্ট্রেলিয়া থেকেও প্রবীর দুশ্চিটন্তা-দুর্ভাবনায় ভুগে অবশেষে চলে এসেছে। তার শারীরিক অবস্থাও ভাল নয়। সপরিবারে সিডনীতে সকলে মাস কয়েক আগে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল। সবাই অবশ্য সেরে উঠেছে।

এবারে ঢাকার যান চলাচল নিয়ে বলি। ব্যাপক প্রচার হচ্ছে বাংলাদেশ আর “ম্যানুয়াল” নেই ডিজিট্যাল হয়ে গিয়েছে। ভাবতাম ঢাকা যেহেতু রাজধানী এবং লক্ষ লক্ষ লোককে ধারণ করে-তাই শহরে যাতে ছোঁয়াচে ভাইরাসটি আক্রমণ করতে না পারে-সে জন্য বহুল প্রচারিত সামাজিক দূরত্ব বা (Social distance) বজায় রাখার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।

প্রয়োজনে নানা হাসপাতালে বহু ধরণের টেষ্ট বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন হাসপাতালে ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শ নিতে বেশ কয়েকদিন প্রচন্ড রোদ উপেক্ষা করে রিক্স নিয়ে যেতে আসতে যে দীর্ঘ যানজট ভোর থেকে রাত অবধি চোখে পড়লো এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার যে ভয়াবহ চিত্র দেখলাম তাতে ‘ডিজিট্যাল বাংলাদেশ’ এর প্রকৃত ম্যাজেঞ্জা উপলব্ধি করলাম। চিকন একট দুই গজ বা ছয় ফুট বা তারও কম লম্বা একটা লঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্র করছেন। কোন দিকার গাড়ি-ঘোড়া থামিয়ে দিচ্ছেন আবার কিছুক্ষণ পর অপর দিককার যান-বাহন চলাচল করতে দিচ্ছেন। এঁরা সাদা পোষাকধারী-সিটি কর্পোরেশন নিয়োজিত না কি ট্রাফিক পুলিশ তা দেখে বুঝাই গেল না। কিন্তু কোন কেউ কেটার গাড়ী দেখলে অন্য সব গাড়ী বন্ধ করে তাঁর গাড়ী যেতে দিচ্ছেন। যান জট এ ধরণের নিয়ন্ত্রণে আদৌ কমে না কমেও নি বরং বেড়েছে।

এই ট্রাফিক ব্যবস্থা খোদ রাজধানী শহরে দেখে নিজের মনেই প্রশ্ন জেগেছে তবে যে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বারবার অহরহ শুনানো হচ্ছে “ডিজিটাল বাংলাদেশ”-তা কি আদৌ সত্য? কোথাও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য নীল বাতি, হলুদ বাতি লাল বাতির নিশানা নেই। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে, মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীর পোষ্টার, রঙীন আলো সংবলিত বিলবোর্ড টাঙিয়ে সারা শহর ছেয়ে ফেলা হয়েছে কিন্তু ট্রাফিক লাইটের বালাই নেই।

এর আগে বহুবার শুনেছি বা সংবাদ পত্রের পাতায় পড়েছি যে অমুক অমুক রাস্তায় রিক্সা-স্কুটার প্রভৃতি চালানো নিষিদ্ধ করার ঘোষণা। এতে নাকি যানজট কমবে। তা হলে যে লক্ষাধিক রিক্সা-স্কুটার শ্রমিক ঐ যানগুলি রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে চালিয়ে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য আহার জুগিয়ে থাকেন তাঁরা যাবেন কোথায়? নিম্নবিত্ত লাখো যাত্রীই বা কম ভাড়ায় ওই যানগুলির অভাবে কীভাবে চলাচল করবেন? তাই তখন লিখেছিলাম-রিক্সা স্কুটার বন্ধ নয় তাদের জন্য সব রাস্তার দু’ধারে সরু রাস্তা ও পথচারীদের চলাচলের ব্যবস্থা করা হোক। দেখছি, তা হয় নি কিন্তু রিক্সা-স্কুটার শ্রমিকদের আন্দোলনের চাপে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে কিন্তু রাস্তার প্রশস্ততা বা দু’ধারে অপ্রসস্ত রাস্তা নির্মাণ করে দেওয়া হয় নি।

অপরদিকে রাজধানী সহ সমগ্র দেশে এখন লক্ষাধিক কোটিপতির উদয় ঘটেছে। তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য দামী দামী কার ও অন্যান্য যানবাহনকে দিব্যি রাস্তায় নামকে দেওয়া হচ্ছে। কতটুকু রাস্তায় কয়টি গাড়ী এবং কি প্রকারের গাড়ি নিরাপদে নির্বিঘ্নে দিবারাত্র চলাচল করতে পারে তার একটা আন্তর্জাতিক মাপকাঠি রয়েছে কিন্তু সে মাপকাঠির ধারও ধারা হচ্ছে না। ফলে অহরহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মানুষ মারা যাচ্ছে কিন্তু সড়ক মন্ত্রণালয়ের টনক নড়ছে না। পৃথিবীর কোন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেই ঐ মাপকাঠির বাইরে গাড়ী চলাচল করতে দেয় না।

ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের বিন্দুমাত্র আধুনিকায়ন চোখে পড়লো। অথচ দাবী করা হচ্ছে বাংলাদেশ ডিজিটালাইজড হয়ে গেছে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক লাইট (লাল, হলুদ-লাল) না বসালে ডিজিটালাইজড বাংলাদেশ এর দাবী দেশ বিদেশের কাছে হাস্যকর বিবেচিত হচ্ছে। ট্রাফিক আইন যান বাহনের মালিক বা চালককে মানাতে হলে একদিকে ট্রাফিক লাইট স্থাপন, সমগ্র ঢাকা শহরের প্রতিটি রাস্তা সি.সি ক্যামেরার আওতাভূক্ত করা এবং বিশ্বের অপরাপর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মত কঠোর ভাবে ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করা-না করলে সি.সি. ক্যামেরার ছবির ভিডিওতে সেই গাড়ীর মালিক চালককে বড় অংকের জরিমানা, দ্বিতীয়বার করলে তার দ্বিগুন জরিমানা এবং তৃতীয় বার করলে গাড়ীর যাবতীয় লাইসেন্স চিরতরে বাতিলের আইন করা প্রয়োজন পথ ঘাটকে নিরাপদ করার জন্য।

আবার এ কথাও ঠিক, প্রতি বছর বিপুলভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে। তাই মানুষ চলাচলের যান-বাহনও বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে রাস্তাও সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বিকল্প যান-বাহনের ব্যবস্থাও করতে হবে সড়কের স্বল্পতা হেতু। সেক্ষেত্রে রেলওয়ে বিশাল সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। প্রকৃত সত্য হলো ইংরেজ আমলে ট্রেন সার্ভিস সর্বাধিক উন্নত ছিল। ট্রেনের সংখ্যা বর্তমানের চাইতে কমপক্ষে তিনগুন ছিল আর প্রতিটি ট্রেনে বর্তমানের তুলনায় বগির সংখ্যা কমপক্ষে ৫গুন বেশী ছিল। ফলে রেলপথই যাত্রীরা বেশী ব্যবহার করতেন-তার ভাড়াও সড়ক পরিবহনের চাইতে অনেক কম। অপরদিকে ট্রেনে খাবার, টয়লেটের ব্যবস্থা থাকায় তা অত্যন্ত যাত্রী বান্ধব ছিল।

অথচ ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর দুই দফা স্বাধীনতা অর্জন করলেও, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হলেও রেলওয়ে সর্বাধিক অবহেলার বিষয়ে পরিণত হয়েছে রেলওয়ের পৃথক মন্ত্রণালয় থাকা সত্বেও।

আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে এত বিপুল সংখ্যক সরকারি কর্মকর্তাকে গাড়ি বরাদ্দ করা হয় না। নির্দিষ্ট কয়েকটি পদাধিকারী জেলা বা বিভাগ পর্য্যায়ে সরকারি গাড়ির বরাদ্দ হয়। আর আমাদের দেশে সরকারি কর্মকর্তঅর সংখ্যাও যেমন বাড়ানো হয়েছে তেমনি বাড়ানো হয়েছে তাঁদের জন্য গাড়ির সরকারি বরাদ্দ-ফলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে-তার অবনতি ঘটাচ্ছে।

আন্তর্জাতিকভাবে ইদানীং বলা হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী ও বেসরকারি সবাই বাই-সাইকেল ব্যবহার করলে একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় ব্যয় বিপুলভাবে হ্রাস পাবে তেমনি তা পরিবেশ উন্নয়নে ব্যাপকভাবে সহায়ক হবে। কিন্তু এমন ব্যবস্থার কথা বাংলাদেশে আমরা কল্পনাও করতে পারি না-যদিও দেশটি তুলনামূলকভাবে গরীব, রাস্তাঘাটের নিদারূন অভাব এবং যানযট ও ট্রাফিক দুর্ঘটনায় ২০ থেকে ৩০ জন যাত্রী এই ক্ষুদ্র দেশে প্রতিদিন মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছেন।
সারা দেশেই ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অবনতিশীল, যান-বাহনের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং রাস্তার স্বল্পতা থাকলেও ঢাকার যাতায়ত ডিজিটালাইজেশন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ঢাকাবাসী এ ব্যাপারে কি ভাবছেন?

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test