E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কারাগারে শিক্ষা ব্যবস্থা, হৃদয় মন্ডল নয়!

২০২২ এপ্রিল ১০ ১৪:৩৫:০০
কারাগারে শিক্ষা ব্যবস্থা, হৃদয় মন্ডল নয়!

চৌধুরী আবদুল হান্নান


শ্রেনীকক্ষে পাঠদান কালে গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডল বিজ্ঞানকে “প্রমান ভিত্তিক জ্ঞান” আর ধর্মকে “বিশ্বাস” হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি তো বিজ্ঞানের শিক্ষক, কেন ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতে গেলেন ?

বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বুঝতেই পারেননি, তাকে ফাঁসানোর জন্য একটিশক্তিশালী চক্র নিভৃতে কাজ করছে, তাঁরই ছাত্রের মাধ্যমে বিজ্ঞান ক্লাসে ধর্মীয় বিষয়ে প্রশ্ন করে তারেকর্ড করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে তাঁকে ধর্ম অবমাননার দায়ে ঠিকই ফাঁসাতেসক্ষম হয়েছে ।

হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন নিরীহ মানুষ, যাঁরা প্রায়ই বিভিন্ন কারণে আতংকে দিন কাটান, ২১ বছর যাবৎশিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তি ধর্ম অবমাননা করে নিজের মহাবিপদ ডেকে আনবেন, এমন বিশ্বাস কেউকরবে না ।

একজন শিক্ষককে এভাবে হেনস্তা করে কারা নিজেদের সুবিধা পেতে চায় তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব শিক্ষা বিভাগের, প্রশাসনের ।

অনেক ক্ষেত্রে যেমন দেখা যায়, হিন্দু সম্প্রদায়ের অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যক্তিকে তার জমিজমা দখলের দুরভিসন্ধি নিয়ে অনেককে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে। এখানে হৃদয় মন্ডলের পেশাগত সাফল্যে তার সহকর্মীরা ঈর্ষান্বিত হয়েও এমন নোংরা কাজ করে থাকতে পারেন ।

শ্রেনীকক্ষে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করলে শিক্ষককে উত্তর দিতেই হয় । বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক ধর্মকে “বিশ্বাস” হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, প্রতিটি ধর্মই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে এবং এটা বিতর্কের বিষয় নয়।

তিনি কি ভুল বলেছেন ? শত শত বছর যাবৎ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ তাদের নিজ নিজ ধর্মকে বিশ্বাসের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেচলেছে । প্রকৃতপক্ষে এখন দুষিত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবৃক্ষটি ধর্মান্ধ আর ধর্মব্যবসায়ীদের মদদে ক্রমশফলবান হয়ে উঠছে ।

আসলে আমাদের গোড়ায় গলদ ঢুকে পড়েছে। সংবিধানে অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে স্বৈর শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” ঘোষণা করে আন্তঃসম্প্রদায় সম্প্রীতি বিনষ্টের বীজ বপন করলেন । তিনি ধর্মকে ভালোবেসে এটা করেননি, ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে তিনি ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। একটি ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে অন্যদের প্রতি বৈষম্য সভ্য সমাজের কাজ হতে পারে না ।

মক্কা বিজয়ের পর যখন ইসলাম ধর্মের বিজয় পতাকা উড়ছে, তখন আমাদের প্রিয় নবীজী (সঃ) নির্বিঘ্নে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করতে পারতেন কিন্ত দেশে সকল ধর্মের মানুষের বসবাসের জন্য উম্মুক্ত রেখেছিলেন । যে ধর্ম এমন শান্তি সম্প্রীতি শেখায় সে ধর্মের প্রকৃত বিশ্বাসীগণ অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক না হয়েইপারেন না ।

বঙ্গবন্ধু ১৯৫৫ সালে তাঁর রাজনৈতিক দলকে অসাম্প্রদায়িক করার জন্য দলের নাম থেকে “ মুসলিম” শব্দটি সরিয়ে দিলেন । ভারতীয় উপমহাদেশের প্রচলিত ও পালিত ধর্মগুলোর মূল শিক্ষা হলো — প্রেম-শান্তি-সম্প্রীতি ।

হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক একে অপরের সাথে দেখা হলে করজোড় করে “নমস্কার” বলে সম্মান জানান, যার অর্থ —“তোমার ভেতরে যে ভগবান আছে তার প্রতি আমি মস্তকাবনত ।” এমন চমৎকার ও কল্যাণময়ী সম্বোধন যে ধর্মে আছে তা অন্য ধর্মের জন্য অমঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।

অন্যের দ্বারা নির্দেশিত হয়ে বিদ্যালয়টির ইলেকট্রিশিয়ান মো আসাদের দায়ের করা মামলায় বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় মন্ডল কারাগারে গেছেন ।এর পেছনে সক্রিয় রয়েছে সাম্প্রদায়িক শক্তি । তার পরিবার আতংকে দিন কাটাচ্ছে, সন্তানের স্কুলে যাওয়া বন্ধ ।প্রতিবেশীরা কি পরিবারটির পাশেদাঁড়াবেন না ? কোনো সহৃদয় আইনজীবী কি তাঁর পেশাগত ফি না নিয়ে মামলাটি লড়ে দিতে পারেন না? দেশে এমন মানবিক নীতিবান আইনজীবী নিশ্চয়ই আছেন । প্রয়াত ব্যরিষ্টার রফিকুল হককে স্মরণকরি, তিনি কোনো দিন রাজাকারের পক্ষে মামলা লড়েননি ।

সাম্প্রদায়িক শক্তির মদদে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের কারাবাস পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে আঘাত করেছে। সুপ্রীম কোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যরিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এ ঘটনাকে স্বাধীন শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর চরম আঘাত বলে মন্তব্য করেছেন এবং ৭২ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিকরে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন —“এ ঘটনায় আমরা মর্মাহত এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমরা চিন্তিত-উদ্বিগ্ন”

বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশে একজন মানুষকে অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠা সহজ কাজ নয়, এ শিক্ষা পরিবার থেকে আসে, তারপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ।

অসাম্প্রদায়িক চেতনা তৈরি এবং মননে ধারন করার মানসিকতার শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে থাকতে হবে এবং এর মূল দায়িত্ব পালন করবেন শিক্ষকগণ ।

এমন শিক্ষক যদি কারাগারে যান, তা হলে তো শিক্ষা ব্যবস্থাই কারাবন্দি হয়ে যায় । এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল সবার দেশ হয়ে ওঠার জন্য ।

আমরা যদি ধর্মান্ধ এবং ধর্ম ব্যবসায়ীদের কাছে বার বার হেরে যাই , দেশটি অসাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়েনা উঠে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি বড় একটি অসম্মান করা হবে ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test