E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি : পর্ব-৮

২০২২ আগস্ট ১৪ ১৪:৫৮:৪০
বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি : পর্ব-৮

আবীর আহাদ


বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি খর্ব, তাঁকে হেয় ও জনবিচ্ছিন্নকরণের চক্রান্তে লিপ্ত থাকা সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের স্বাধীনতাবিরোধী গণবিরোধী পাকিস্তানিমনা আমলাচক্রের কার্যকলাপ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর নির্লিপ্ততা সত্যই ছিলো বেদনাদায়ক। ঐ চক্রটি সচিবালয় ও ডিজিএফআই দপ্তরের সুরম্য অট্টালিকার শীতাতপ কক্ষে বসে বসে দিনের পর দিন বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চক্রান্তের জাল বুনেছে। তারা উভয় প্রশাসনের অভ্যন্তরে তাদের অনুসারী, বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, ধর্মীয় মোল্লা-মাওলানা, অসৎ ব্যবসায়ী, সাবেক শিল্পপতি, উঠতি ধনিকশ্রেণীসহ সর্বস্তরের বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতাবিরোধী দুষ্কৃতকারীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে নানান মিথ্যাচার-অপপ্রচারণা, অন্তর্ঘাত, লুটপাট, গুম-রাহাজানি, চোরাচালানি, মজুতদারি ইত্যাকার জঘন্য কার্যকলাপ চালিয়ে সাধারণ্যে সার্বিক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারকে ব্যর্থ করার প্রয়াস চালায়। এসবের মধ্য দিয়ে একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।

গোটা পাকিস্তান আমলে ঐ গণবিরোধী আমলাচক্র সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা বঙ্গবন্ধু-আওয়ামী লীগই প্রথমবারের মতো সেই কায়েমী ক্ষমতা থেকে তাদেরকে উচ্ছেদ করেছে। এ কারণেই তাদের যাবতীয় গোস্বা ও বিদ্বেষ তাই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধ ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধে তারা পরাজিত হওয়ায় মানসিকভাবে তারা ছিল পরাজয়ের গ্লানিতে তাড়িত। সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণে তাই তারা ছিল সদা:তৎপর। স্বাধীনতার পর কিছুদিন মুক্তিযোদ্ধাদের ধাক্কা সামলে কোনোপ্রকারে জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে দিয়ে তারা সময় ও সুযোগ মতো অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে কার্যক্রমে নেমে পড়ে। দেশীয় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রসহ তাদের বৈদেশিক প্রভূরা তাদের পেছনে যাবতীয় পূষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। তারই পর্যায়ক্রমিক চক্রান্তের ফলশ্রুতিতে অত্যন্ত সূক্ষ্মতার সাথে সৃষ্টি হলো চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষ এবং একই চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হলো পঁচাত্তর সালের পনেরোই আগসট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের অধিকাংশই অংশগ্রহণ করেনি। সামরিক বাহিনীর (পাকিস্তানি) বাঙালি অফিসারদের মধ্যে সম্ভবত : শতকরা দশ ভাগ ও বেসামরিক অফিসারদের মধ্যে তিন ভাগ মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক যুদ্ধের ময়দান থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেছিল। আবার কিছুসংখ্যক অংশগ্রহণ করেছিল উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে। পাকিস্তান থেকে সামরিক-বেসামরিক কর্মকতা-কর্মচারীরা ফিরে এলেন তাদের স্ব-স্ব দপ্তরে। দেখা গেল সামরিক-বেসামরিক উভয় অঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধাদের অনুপাত সম্ভবতঃ ৩ : ৯৭!

ঐ অমুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আমলাচক্রের প্রকৃত হোতাদের অবস্থান ছিল, যারা মনেপ্রাণে ছিল পাকিস্তানি বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগবিরোধী। তাদের সাথেই পাকিস্তান সৌদি চীন ও মার্কিনদের যোগাযোগ ছিল। স্বাধীনতার পর তত্ত্বাবিজ্ঞমহল থেকে এদের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করে দেয়া হয়েছিল। তারা ঐসব মতলববাজদের চাকরি থেকে অবসর দেয়ার জন্য সুপারিশও করেছিল। স্বাধীনতার পর তাদের চক্রান্তমূলক কার্যকলাপ তথা চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি ও আইন শৃঙ্খলার অবনতি বিষয়ে এদের সংশ্লিষ্টতা, বঙ্গবন্ধুর ইমেজ খর্ব ও তাঁর সরকারকে উৎখাত ষড়যন্ত্রে এদের জড়িত থাকার খবরাখবর বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে পৌঁছলেও তিনি সেসবকে নির্বিকার চিত্তে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর বিশাল পিতৃহৃদয়ের স্নেহশীলতা ও পরম আস্থাশীলতা তাঁকে যেন অন্ধ করে ফেলেছিল।

চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের অন্যতম নায়ক খাদ্যসচিব আবদুল মোমেন খান ও অন্যান্য চক্রান্তকারীদের সূক্ষ্ম কার্যকলাপ বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করা হলেও তিনি তা বিশ্বাস করেননি। কারণ বঙ্গবন্ধুর সাথে কলকাতায় মোমেন খানের একদা সখ্যতা ছিল বলে জানা যায়। এ-কারণেই সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে তাকে পদায়ন করেছিলেন । অথচ এই মোমেন খানই ছিলো নাকি একদা পূর্ব পাকিস্তানের আরেক অভিশাপ গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের একান্ত সচিব। মোমেন খানসহ এধরনের চক্রান্তকারী সামরিক-বেসামরিক আমলাদের সম্পর্কে তাঁর কাছে অভিযোগ করা হলে তিনি প্রায়শ:ই বলতেন : ও-সব ঠিক হয়ে যাবে, ওরা ভুল বুঝতে পারবে! ওরা তো অনেকেই আমার সহপাঠী, বন্ধু, এমনকি সন্তানতুল্য। ওরা কি বুঝে না, পাকিস্তান আমল থাকলে ওরা বড় জোর সেকশন অফিসার, ডেপুটি সেক্রেটারি হতে পারতো! একজন আর্মীর লোক মেজর/কর্নেল হতে পারতো! তারপর বলতো, আচ্ছা এবার বাড়ি যাও, আচ্ছা এবার এবাউট-টার্ন হও! এখন ওরা সচিব হচ্ছে, জেনারেল হচ্ছে, যে যা নয় তাই হচ্ছে !' এ-ধরনের মন্তব্য আমি (লেখক) নিজেও একাধিকবার শুনেছি।

কিন্তু 'চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী'! ঐ চক্রটি তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অঙ্গ বিদেশীশক্তির দালালি ও দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কমিশন খাওয়ার লাইসেন্স নেয়ার কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। এরা মানুষ নামধারী বিকৃতমস্তিষ্কের গণবিরোধীচক্র যাদের মধ্যে দেশপ্রেম, মানবসেবা, সমাজকল্যাণের লেশমাত্র নেই। এদের কাছে ব্যক্তিসুখ, ক্ষমতা, অর্থ, নারীভোগ, লাল-নীল পানীয় ইত্যাদি বিকৃতপনাই প্রথম ও শেষ চিন্তা ধ্যান ও সাধনা। এ-প্রসঙ্গে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সেই পরামর্শের প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য ছিল : মি: ক্যাস্ট্রো, আমি প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধে বিশ্বাসী নই। আমি মার্কসবাদী বিপ্লবী নই, আমি গ্রাম্য বাঙালি, রবীন্দ্রমানসে গড়া এক কোমল হৃদয়ের মানুষ। কবিগুরু শিখিয়েছেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। আমি সেই বিশ্বাস আর ভালবাসা দিয়ে সকল হৃদয় জয় করার মানুষ। আমি আমার মানুষকে ভালবাসি। ওরাই আমাকে বন্ধু ও পিতার আসনে বসিয়েছে। পিতা হয়ে, বন্ধু হয়ে আমি কারো প্রতি নিষ্ঠুর হতে পারি না। হোক তারা অবাধ্য, হয়তোবা না-বুঝে, একটু লোভে পড়ে অন্যায় করছে কিন্তু ওরাও তো মানুষ, একদিন সব বুঝবে, সুযোগ দিয়ে যাচ্ছি বুঝবার জন্য!' চুয়াত্তরের শেষদিকে একদল বুদ্ধিজীবী সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় এমনিভাবে কথাগুলো বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে আমিও উপস্থিত ছিলাম।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বিপ্লবের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধ ও বিপ্লবের বিরোধিতা করা, বানচাল করা, প্রতিবিপ্লব ও প্রতি-আক্রমণ করা, বিপ্লব বা মুক্তিযুদ্ধ থেকে দূরে থাকা, বিরোধীশক্তিকে সহায়তা করা, হত্যা, ধ্বংস, গণহত্যা, নারীনির্যাতন, লুটপাট, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা, জনগণের সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা ইত্যাদি কার্যকলাপ যুদ্ধাপরাধের সামিল হিশেবে গণ্য করে এসবচক্রকে চিরতরে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদেরকে তো উচ্ছেদ করেনইনি, উপরন্তু তাদের অনেককেই প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ স্তরে নিয়োগ করেছেন ! বহাল রেখেছেন। পদোন্নতি দিয়েছেন। তিনি তাঁর হৃদয়ের চিরাচরিত উদারতা দিয়ে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দ্রুত সার্বিক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে তাদেরকে ক্ষমা করেছিলেন এই ভেবে যে, ওরা মেধায় ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। এই মানবিক ও বিচক্ষণ মূল্যায়ন থেকেই বঙ্গবন্ধু তাদেরকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। তিনি ব্যকিস্বার্থ ক্ষমতা ও নিজের ব্যক্তিনিরাপত্তার কথা ভাবলে প্রথম সুযোগেই তাদেরকে উচ্ছেদ করতে পারতেন। করেননি। দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ও মানবিক মূল্যবোধের কারণে করেননি। কিন্তু তাঁর পরম আস্থা স্নেহ ও বিশ্বাসকে তাঁর দুর্বলতা ভেবে, তাঁরই বদান্যতায় প্রাণ-পাওয়া সামরিক ও বেসামরিক দালাল আমলারা চক্রান্ত করে চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষ ডেকে এনেছে, পঁচাত্তর সালে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করার পথ প্রশস্ত করেছে। একেই বলে হয়তো নিষ্ঠুর নিয়তি! বঙ্গবন্ধুকে এভাবে পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে দিয়ে সেই আমলারা ও তাদের সহযোগী ধনিক-প্রতারকশ্রেণী নিজেদের মধ্যে দেশের অর্থসম্পদ লুটপাট ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ভাগাভাগি করে নিয়েছে। জীবনে যিনি যা কল্পনাও করেননি তিনি তাই হয়েছেন এবং হচ্ছেন। (চলবে)

লেখক : বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বহু গ্রন্থের লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test