E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি : পর্ব-১০

২০২২ আগস্ট ১৬ ১৫:০৯:২৯
বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি : পর্ব-১০

আবীর আহাদ


'বাংলাদেশ : দি আনফিনিস্ড রেভ্যুলেশন' গ্রন্থের রচয়িতা লরেন্স লিফসুলজ ১৯৭৯ সালে বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তাতে তিনি লেখেন যে, ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে খোন্দকার মোশতাক ও তার রাজনৈতিক সহযোগীদের সাথে সামরিক বাহিনীর কতিপয় সদস্যের সংযোগ ঘটে।

মূলত: এ-সংযোগ সামরিক বাহিনীর পক্ষে প্রথম ঘটান মেজর রশিদ, যিনি ছিলেন খোন্দকার মোশতাকের ভাগ্নে মেজর ফারুকের ভায়রা। মোশতাক ও ফারুক-রশিদচক্র যার যার অবস্থান থেকে বহু পূর্ব থেকে বঙ্গবন্ধুকে উৎখাতের চক্রান্ত করে আসছিলেন। এরই এক পর্যায়ে মার্চ মাসে মেজর ফারুক এ-চক্রান্তে সামরিক নেতৃত্ব প্রদানের জন্য ডেপুটি চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে দেখা-সাক্ষাত করেন। জেনারেল জিয়া এ-ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখান। এভাবেই হত্যাকাণ্ডের পশ্চাতে রাজনৈতিক ও সামরিক সংযোগ স্থাপিত হয়।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রধান খুনি ফারুক-রশিদ বিদেশি পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে একাধিকবার দাবি করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে জিয়া সরাসরি জড়িত ছিলেন। এসব তথ্য যখন প্রকাশিত হচ্ছিলো, তখন জিয়া ছিলেন দেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি তাদের এসব কথার কোনো প্রতিবাদ করেননি। এমনকি এরপর ফারুক ও রশিদকে দেশে পেয়েও তিনি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি। এতে প্রমাণিত হয় যে, জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ-ব্যতীত ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে ফ্রিডম পার্টিতে ভাঙন ধরলে ফারুক-রশিদ একে-অপরকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খুনি বলার পাশাপাশি তারা জিয়াকেও ঐ হত্যাকাণ্ডের হোতা হিশেবে দেশের মাটিতে বহুবার প্রকাশ্যে মন্তব্য করলেও প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও নিশ্চুপ থেকেছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কর্মকর্তারা ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তৎকালীন ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ প্রধান ফিলিপ চেরী ক্যু'র সাথে তার জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, বাংলাদেশিরা নিজেরাই শেখ মুজিবকে হত্যা করেছেন। তাদের সাথে মোশতাক-ফারুকসহ কতিপয় ব্যক্তির সংযোগ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, কিছু রাজনীতিক আছেন যারা বিদেশি দূতাবাসে ধর্ণা দিয়ে থাকে।

ওয়াকিবহাল বাংলাদেশি ও বিদেশি কূটনীতিকরা দাবি করেন যে, মোশতাক, তার কিছু সহকর্মী ও সামরিক বাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মুজিবহত্যার চক্রান্তে লিপ্ত ছিলেন। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের জনৈক কর্মকর্তা ও দেশীয় সূত্রের মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সর্বোচ্চমহল মুজিব হত্যায় সম্মতি দিয়েছিলেন। হত্যাকাণ্ডের দু'মাস আগে থেকেই দেশীয় ব্যক্তিরা দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেছিলেন। সূত্র মতে, উনিশশো চুয়াত্তরের নবেম্বর থেকে পঁচাত্তরের জানুয়ারি পর্যন্ত এ-সমস্ত লোকের সাথে মার্কিন কর্মকর্তাদের অনেক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এমনকি মেজর ফারুক একাধিকবার অস্ত্র ক্রয়ের নামে মার্কিন দূতাবাসের সামরিক ও সিআইএ কর্মকর্তাদের সাথে একাধিকবার বৈঠক করেছিলেন বলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে মেজর ফারুক বলেছেন, তিনি পনেরো আগস্টে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন যে, যখন তারা হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করেছিলো, ঠিক একই সময় মার্কিন দূতাবাসের অনেকগুলো গাড়ি ঢাকা শহরের এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছিল।

মেজর ফারুক নিজেকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নায়ক হিশেবে প্রচার করলেও তার এ-বক্তব্যে প্রমাণিত হয় যে, তিনি ও তার সহযোগীরা ছিলেন মূলত: ভাড়াটে কামলা। মোশতাক-জিয়াচক্র এই ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে কাজ সমাধান করেছিলেন। মেজর রশিদ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন যে, মোশতাক যখন বেতার কেন্দ্রে যান, তার আগেই তথ্যমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুব আলম চাষী সেখানে উপস্থিত। অপরদিকে তাহের ঠাকুর পশ্চিমা এক সংবাদদাতার কাছে এ-মর্মে দাবি করেন যে, হত্যাকাণ্ডের দু'দিন আগে তার বাড়িতে এ-হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়।

মোশতাকচক্রের এ-ধরনের একটি গোপন সভা সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক লেখক-সাংবাদিক একটি চমত্কার কাহিনী বলেছেন। সেই লেখক-সাংবাদিকের ভাষ্য : ১৯৭৫ সালের ১২ আগস্টের শেষ, ১৩ আগস্টের শুরু । সম্ভবত: রাত সাড়ে বারোটা। পত্রিকা অফিসের কাজ শেষে আমি আমার বাসা ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডের পশ্চিম মাথার দিকে হেঁটে অগ্রসর হচ্ছিলাম। ইন্দিরা রোডস্থ পাসপোর্ট অফিসের পাশ দিয়ে রাজাবাজারমুখি বাইলেনের কাছে আসতেই ধিরে আমাকে পাশ কাটিয়ে একটা লাল ডাটসান গাড়ি চলে গেল। ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আলোয় দেখতে পেলাম খোন্দকার মোশতাক, তাহের ঠাকুর ও নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে। ওদের সবাইকে আমি ভাল করেই চিনি। আমাকে দেখতে পেয়েছেন বলে মনে হলো না। আমি পাশের একটি নিমগাছের আড়ালে নিজেকে লুকাই। আরেকটি গাড়ি আসছে ফার্মগেটের দিক থেকে। একইভাবে গিয়ে ঢুকলো সাবেক পুলিশের আইজি মহিউদ্দিন দোহার বাড়িতে। বিস্ময়ে আমি কাঁপছি। স্বয়ং মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টার। পাশে ফিলিপ চেরীসহ আরো একজন। আমার গায়েব লোমগুলো ততক্ষণে শিরশির করে উঠলো : এ কী! তবে কি প্রতিদিনই তো নানান ষড়যন্ত্রের কথা কানে আসে। এটাই কি সেই ষড়যন্ত্রের আখড়া! আরেকটি গাড়িতে এলো তিনজন সুঠাম দেহের লোক। একজনকে চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো, মেজর জেনারেল জিয়া নয় তো! এরপর বেশ সময় কেটে গেল। আর কোন গাড়ি এলো না। বুঝলাম হয়তো আর কেউ আসবে না। এবার আমি পায়ে পায়ে দোহা সাহেবের বাড়ির গেটের কাছে গেলাম। আমি তো এখানেরই বাসিন্দা। (চলবে)

লেখক : বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থের লেখক-গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test