E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

উত্তর মেলে না

২০২২ অক্টোবর ১৬ ১৫:২৯:২২
উত্তর মেলে না

পীযূষ সিকদার


আমি কাউকে টানতে পারি না। এটা আমার দুর্বলতা। কত মানুষের কাচারি ভুল মানুষে ভরে যায়। আমার কাচারি ঘর ফাঁকা। নির্বাচন করবো ইচ্ছে হয়েছিলো। সাধ পূরণ হবার নয়। কারণ আমার টানে অথবা ডাকে কেউ আসে না। সৃষ্টিকর্তাকে ডাকি। আমার সাধ পূরণ করে দাও। সৃষ্টিকর্তা অলক্ষ্যে হাসেন। মানুষকে যে ভালোবাসে না। তার টানে কেউ কী টানে! কেউ হেসে ছায়াসম বনে যায়। ঘুম ভাঙ্গে। দেখি আমার কাচারি ঘর লোকেলোকারণ্য হয়ে গেছে। আমি ভীষণ আশ্চর্য হই। ঈশ্বর আমার ডাক শুনেছেন। উপর দিকে দুই হাত তুলে শূণ্যে চোখ রেখে বলি, হে সৃষ্টিকর্তা তুমি কী মহান! বলতে বলতে পরিমল বলে উঠেÑতুমি একটা চোর! পরক্ষণেই ধ্যান ভাঙ্গে আমার। গভীর ঘুম থেকে উঠে বসি। একের পর এক স্বপ্নেরা হানা দেয়। মনে মনে ভাবি আর স্বপ্ন দেখবো না। একাকী পথ আমার। একাই চলি পথ। আমার টানে কেউ আসে না। আবার অতল ঘুম। নিদ্রাদেবীর আশীর্বাদে। ঘুমের মধ্যেই দেখিÑআমাকে কেউ একজন ফুলের মালা পড়িয়ে দিচ্ছেন। আমার নেতা তোমার নেতা...। সারা কাচারি ঘর মানুষে ভরে গেছে। চোপ শালা বেশী ভাবুক। ফুলের মালা চায়! ভোর হয়ে গেছে। বাতাবী গাছের ডালে একটি পাখি ডেকে যায়। জানালা খুলি। আমার কাচারি ঘরে কেউ নেই। একা আমি বাতাবী লেবু গাছের সাথে কথা বলে চলি। দরজা খুলে বাহিরে আসি। আমার টিনের চালে একটি সাদা কবুতর বসে আছে। দলছুট কবুতর। আমার মত দলছুট কবুতরও দলছুট। কবুতরটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। কবুতরও আমাকে দেখে নিলো। শিকারী কিনা! শিকারী নই বলে কবুতর অনেকক্ষণ ধরে আমাকে পরখ করলো। মনে মনে বলি, কইতর আমার বাড়িতে থেকে যাও। তুইও দলছুট আমিও দলছুট। কবুতরটি ঠায় বসে রইলো। একবার মনে হলো একটা ঝাকা বেঁধে দেই। না না আমাকে কেউ টানে না। শুধু ঝাকা বাঁধা বিফলে যাবে। কবুতরের চলে যাবার আগেই আমি বাজারের দিকে পা বাড়ালাম। তবু তো কবুতরটা রইলো কিছুক্ষণ আমার চালে। আমার সাথে কেউ থাকে না। থাকবে কেমনে আমার ব্যাংকে তো টাকা নেই! ফর্সা গাল ফোলা ব্যবসায়ী নই আমি। রঘু চা দেতো এক কাপ। রঘু আমার জায়গাতেই চায়ের দোকান বসিয়েছে। তবুও রঘু আমাকে চা দিতে দেরী করে। আমি বরাবর লাজুক প্রকৃতির। নরম মনের। রঘু চা হবে না! রঘু চা দেয়। চায়ে চুমুক দিতেই ফোন বেজে উঠে। হ্যাঁ, টুলু বলো। আজকে আমাদের নিতে আসবা! প্রিন্স বাবা বাবা করছে। ঠিক আছে। ফোন কেটে দেয়। রঘুর হাতে চায়ের কাপটি এগিয়ে দেই। পকেট থেকে টাকা বের করে রঘুকে দেই। রঘু ভীষণ খুশী। আমার জায়গায় চায়ের দোকানদারী করে তবু একদিনও একটি অতিরিক্ত চা খাওয়াইনি। আমাদের পাড়াতে রঘুর নামে নানা অভিযোগ। আমাকে অনেকে বলে আমি চুপচাপ শুনে যাই। বাবা মা মরা ছেলেতো! আমার সাথে ওর অনেক মিল। আমি কিছু বলি না। 

আজ টুলু ও প্রিন্স বাড়ি আসবে। তাই মাছ বাজারের দিকে যাই। প্রিন্সের রুই মাছ বেশ পছন্দ। রুই মাছ কিনলাম । দেখে শুনে তপন মাঝিই কিনে দিলো। রুই মাছটি কেটে নিয়ে ব্যাগে ভরে সোজা বাড়ি। দেখি কবুতরটি ওইখানেই বসে আছে। আমার টানে। না না আমাকে কেউ টানে না। সত্যিই কী কবুতরটি আমার টানে বসে আছে?

ফ্রিজে মাছ থুয়ে ভাঙা ঘরে চলে আসি। একটি ভাঙা ঝাকা পাই। ঠিক ঠাক করে ঘরের বাইরের দিকটায় ঝুলিয়ে দেই। খড়কুটো দিয়ে ঝাকাটি ভরিয়ে দেই। হঠাৎ মনে পড়ে কবুতরটারতো ক্ষুধা লাগতে পারে! ঘরের ভিতর ঢুকে ভাঙা চাউল নিয়ে উঠোনে ছিটিয়ে দেই। কবুতরটি প্রাণ ফিরে পায়। চাল থেকে নিচে নামে। খুত খায় মহানন্দে। আমি কবুতরটিকে প্রাণ ভরে দেখি। এতোদিন মিথ্যা ভাবনা কবুতরটি হারে হারে বুঝিয়ে দিলো। কবুতর বোবা মুখে বলে, আমি তোমার টানেই এসেছি। মিথ্যা মিথ্যা মিথ্যা। কবুতরটি ঝাকায় না ঢুকে উড়াল দেয়। আমার কষ্ট হয়। শেষ পর্যন্ত কবুতরটিও চলে গেলো। সত্য এই আমাকে কেউ টানে না। টানাটানির সংসাওে আমি খুব বেমানান। টিউবয়েলের পাড়ে যাই। এক বালতি জল তুলি। স্নান ঘরে ঢুকে স্নান করি। অকস্মাৎ মাথার মধ্যে খেলে যায় প্রিন্স তো টানে। প্রিন্স তো বাবা বলে অজ্ঞান। ঠোঁটে হাসির রেখা খেলে যায়।

প্রিন্স তো আমিই। আমারই টু কপি। প্যান্ট শার্ট পড়ে দরজায় তালা লাগিয়ে সোজা পুরান বাজার। পুরান বাজার থেকে ভ্যানে সোজা কৃঞ্ষনগর। প্রিন্স নাচে। বাবা আসছে। বাবা আসছে। প্রিন্স ঘুরে ঘুরে নাচে। আজ আমার এতদিনকার ভাবনার অবসান হয়। টানে। টানে। প্রিন্স আমাকে টানে। আনন্দ লাগে। বাবা হাত মুখ ধুয়ে নাও খেতে দেবো। ঠিক আছে মা। আমি হাত মুখ ধুয়ে নিচ্ছি। টুলু দরজায় মাথা ঠেকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাপ-ছেলের কীর্তি দেখছে। আর মৃদু হাসছে। টুলু বলে রুই মাছ কিনছো? আমি মাথা ঝাকি। টুলু খুশী হলো কিনা বোঝা গেলো না। নানা পদের মাছ দিয়ে খেয়ে নিলাম। একটু কৃষ্ঞনগর বাজারটা ঘুরলাম। চা খেলাম সংকরদার চায়ের দোকানে। সংকরদা বলে, অনেকদিন পরে আসলেন। আমি বলি হ্যাঁ সংকরদা। আসি। সংকরদা ঘাড় নেড়ে বিদায় জানায়।

টুলু চলো। এই এলে একটু বসো। বিশ্রাম নাও তারপর যাই। বিশ্রাম অনেক হয়েছে এবার চলো। হ্যাঁ, টানার মানুষ আছে। প্রিন্স। টুলু। তারপরও আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কাউকে টানতে পারিনা। ভেবেছিলাম কবুতরটি আমার টানে এসেছে। না ভুল। পরক্ষণেই উড়াল দেয় ভিন আকাশে। তবে প্রিন্স যে আমাকে ভালোবাসে আমাকে টানে। মিথ্যা। মিথ্যা সব। ঘুম ভাঙে। বাবা স্কুলে যাবা না? আমি বলি যাবো বাবা। টুলু বলে, স্কুলে তোমার মন নেই। সত্যিই স্কুলে আমার মন নেই। স্কুল আমার ভালোলাগে না। কচি মুখের দিকে তাকালে মনটা নেচে উঠে। কিন্তু মাস গেলে যে কয়টি টাকা পাই তাতে আমার বাজে খরচ চলে না। টুলু চেচিয়ে উঠে। ওই কয়টি টাকা নিয়েই তো আমরা বেঁচে আছি। টুলুর চেচামেচিতে ঘুম ভাঙে। ব্রাশ করি। হাত মুখ ধুয়ে সোজা স্কুল। অ্যাসেম্বিলি হবে। সামনে দাঁড়াই। আযাদ প্যারেড করায়। প্যারেড শেষে আমি ছেলে মেয়েদের উদ্দেশ করে কথা বলি। প্রথম বেল পড়ে। আমি আমার চেয়ারে গিয়ে বসি। পাঁচ বেল পড়লেই ছুটি। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি। যেমন হাফ ছেড়ে বাঁচে ছেলেমেয়েরা। আমিও তেমনি। বাজারে একটি দোকান নিয়েছি। বই খাতা কলম পেন্সিলের দোকান। বেঁচা কেনা ছাই। বসে বসে যা তা লিখি। ফোন আসে টুলুর। দুই কেজি আলু ও এক কেজি পিয়াজ নিয়ে এসো। এই তো আমার দৈনন্দিন রোজ নামচা। দুপুরে খেতে যাই। কোনো কোনো দিন বন্যা নামে আমার উঠোনে। ভালোই লাগে। কুলহারা কবুতরটি আবার আমার চালের উপর। ভুল ভাঙে আমার। না না আমি ইলেকশন করবো না। প্রিন্স, টুলু ও কবুতরটি আমাকে একই সমান্তরালে বেঁধে রাখে। এই যে লিখছি। লিখে লিখে খাতা ভরছি। মিথ্যা। মিথ্যে সব।

আমি সারারাত আড্ডা অথবা লিখে কাটাই। ভোরের আযানের সময় ঘুমুতে যাই। এ আমার নিত্যদিনের গদবাঁধা রুটিন। এই রুটিনের সাথে যুক্ত হয়েছে সজীব। সজীবকে চিনতে আমার কষ্ট হয়! ঘুমাবে না! ঘুম যে আসে না! বলতেই ঘুমিয়ে পড়ি। আমি ঘুমিয়ে থাকি না জেগে থাকি বুঝতে পারিনে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে জামাপ্যান্ট পড়ে বাজারের পথে। পেছনে তাকাই। কবুতরটি বসে আছে। ঘরের ভেতর ঢুকি। খুত নিয়ে উঠানে ছিটাই। কবুতরটি উড়ে এসে খুত খায়। একসময় আমার হাতে এসে বসে কবুতরটি। প্রিন্স মজা পায়। কবুতরটিকে ওর বাসায় রেখে সোজা দোকান। ভাবনারা আমাকে জেকে বসেছে। আমি নিদ্রায় নাকি জাগরণে বুঝতে পারি না। ভাবছি বাস্তব না স্বপ্ন।

একাকী জীবনে মা আমার একমাত্র ভরসার কেন্দ্র। মার বালিশের ভেতর থেকে টাকা নিয়ে চা আর ধুয়া ছাড়ি। আমি যে কে বুঝি না! মা যে এই ধরাধাম থেকে চলে তা একবারের জন্য ভাবি নাই। মা দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে ভুগছিলেন। একবারের জন্য তার সেবা করিনি। টাকা ফুরিয়ে গেলে বালিশের ভেতর থেকে টাকা। বাজারে আসি। চা আর ধুয়ার কুন্ডলী পাকাই। তাহলে এতক্ষণ যে প্যাঁচাল পেরে গেলাম সব মিথ্যা! না সব মিথ্যা না। ঐতিহাসিকগণ খুঁজলে কিছু সত্যের সন্ধান দিতে পারবেন। আমাকে কেউ টানে না। অথবা আমার টানে কেউ আসে না। আমার কাচারি ঘর শূণ্য। শূণ্য আমার পকেট। বুকের মধ্যে চিন চিন ব্যথা অনুভব করছি। কেনো এই ব্যথা! আমি ঘুমিয়ে না জেগে আছি! স্বপ্ন না আধা জাগরণ না ঘুম! বুঝতে পারিনা। ভোরের আযান শেষ। হঠাৎ অন্য ঘর থেকে মেজো ভাইয়ের কান্নার রোল। মা মারা গেছে। আমি দৌঁড়ে আসি। মাকে দেখি। মুখ ভর্তি ক্ষত। বালিশের ভেতর হাত দেই। টাকা লই। ধীরে ঘর থেকে বের হই। চায়ের দোকান তখনো খোলে নাই। ধুয়ার বৃত্ত আঁকি বাতাসে। ভাবি। ভাবনা আসে না। কিছুক্ষণ আগেই মা চলে গেছেন। আবার বাড়িতে যাই। দেখি বাড়িতে কান্নার মাতম উঠেছে। সবাই কাঁদে। শুধু আমিই মায়ের জন্য এক ফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারলাম না। আচম্বিতে নিজেকে আবিষ্কার করি একটি হল রুমের জানালার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আমি কে? উত্তর মিলেও মেলে না!

লেখক : শিক্ষক ও নাট্যকার।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test