E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের প্রতীকী জবাব ঋষি সুনাক 

২০২২ নভেম্বর ১৩ ১৫:১৯:১৭
ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের প্রতীকী জবাব ঋষি সুনাক 

চৌধুরী আবদুল হান্নান


১৯৬০ এর দশকে একটি পরিবার ভারতের পাঞ্জাব থেকে পাড়ি জমান ব্রিটেনে কিন্ত কেউ কি ভাবতেপেরেছিলেন সেই ঘরেই জন্ম নেবে একজন রাজনীতিক যিনি নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটে থাকা ব্রিটিশদের পথ দেখাবেন, দিকনির্দেশনা দেবেন ? একদিন তোমাকে শাসন করবে যে, তোমার ঘরেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে সে।

একজন ভিনদেশী অভিবাসী এবং তাও আবার অশ্বেতাঙ্গ, এক সময় ব্রিটেনের শাসনভার হাতে তুলেনেবেন তা কেউ কল্পনা করেনি। সুনাকের দাদা-দাদি ভারত থেকে ব্রিটেনে গিয়ে স্থায়ী হয়েছিলেন; হিন্দুধর্মাবলম্বী সুনাক ভগবদগীতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২৫ অক্টোবর শপথ নেন।

এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, আমি এখন ব্রিটিশ নাগরিক, এটি আমার জন্মভূমি, এটি আমার দেশ। আত্মপ্রত্যয়ী সুনাক আরও বলেন, তবে আমার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হচ্ছে ভারতীয়, আমার স্ত্রী ভারতীয়। আমি একজন হিন্দু।

ঋষি সুনাক বিয়ে করেন এক ধনী পরিবারের মেয়েকে যা তার এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালনকরে, দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে এ দম্পতির।

বলতে গেলে, রাজনীতিতে নবাগত সুনাক বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসে সর্ব কনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে সাবেক এ অর্থমন্ত্রী ব্রটিশ রাজনীতিতে এক চমক দেখাতে সক্ষম হলেন ।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস মাত্র দেড় মাসের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, কনজারভেটিভ পার্টি একজন বাদামি পুরুষের পরিবর্তে সাদা নারীকে বেছে নিয়েছিলেন যেখানে বর্ণবাদের গন্ধ পাওয়া যায়।

কিছুদিন আগেও মনে করা হতো ব্রিটেনে কোনো বর্ণবাদ নেই কিন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়ার (ব্রেক্সিট) প্রস্তুতিকালে ভোটাভুটির সময় বর্ণবাদ ভাবনা আবার মাথাচাড়া দিয়েছিল। তারা মূলত বয়সে প্রবীণ বিদেশবিদ্বেষী কনজারভেটিভ পার্টির শ্বেতাঙ্গ ও ধনী সদস্য।

ইইউ ভূক্ত সদস্য দেশের মধ্যে ভিসা ছাড়া অবাদ যাতায়াত ও বসবাস করার সুযোগ থাকায় যুক্তরাজ্যে ওই সকল দেশ থেকে প্রবাসী আগমন বৃদ্ধি পায় এবং তা রোধ করার মানসিকতাও ব্রেক্সিট পন্থীদের মধ্যে কাজ করেছিল।

যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত থাকবে কি থাকবে না সে বিষয়ে ২০১৬ সালের জুন মাসে রেফারেন্ডাম ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন, সামান্য ভোটের ব্যবধানে ব্রেক্সিট জয়যুক্ত হলে তিনি পদত্যাগ করেন। তিনি ব্রেক্সিট সমর্থক ছিলেন না।

ইইউ ভূক্ত থাকার বাড়তি সুবিধা তাদের আর দরকার নেই, ২৭ বছর এক সাথে পথ চলার “সংসার” ভেঙে দিয়ে তারা “একলা চলো” নীতি গ্রহণ করলো, বুঝতে হবে ব্রিটিশদের কৌলীন্যবোধ আজও টনটনে।

ব্রিটিশদের বিদেশি বিদ্বেষ বা প্রবাসী বিদ্বেষ ব্রেক্সিট কার্যকর করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল এবং সেকারণে প্রবাসী মা-বাবার সন্তান ঋষি সুনাক তাদের পছন্দের লোক হওয়ার কথা নয়। ব্রিটিশ রাজনীতি এখানে পথ হারিয়েছে বলা যায়।

বাণিজ্য করার জন্য ইংরেজরা প্রথম ভারতবর্ষে এসেছিল এবং এক পর্যায়ে সুচতুর ব্রিটিশ বেনিয়া শাসন ক্ষমতা দখল করে নিতে সক্ষম হয়, ২০০ বছর কেটে যায় তাদের শাসন আর শোষণে।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত যেত না, বলতে গেলে, তারা এক সময় পৃথিবী শাসন করেছে আর সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে নিজ দেশে। ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশ বাণিজ্য, বিলিতি বস্ত্র ব্যবসায়ী একে একে আমাদের সমস্ত হস্তচালিত শিল্পের বিনাশ সাধন করেছিল। ঢাকা নগরী মসলিনের জন্য বিশ্ব বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল, ঢাকাই মসলিন দেশ দেশান্তরে রপ্তানি হতো । বাঙলার বস্ত্র শিল্পের সাফল্যের নায়ক তাঁতি সমাজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশ স্বার্থে তারা নির্মমভাবে ভারতীয় শিল্পকে আঘাত করেছে।

আর একটি ভয়ংকর নির্যাতন, শোষণের নাম “নীলকর প্রথা”। অত্যন্ত কঠোর শর্তে প্রজাদের ফসলিজমিতে নীল চাষে বাধ্য করা হতো এবং উৎপাদিত নীল ইংরেজ ভূ-স্বামীদের কাছে একটি নির্দিষ্ট দরেবেচতে হতো।

ভারতবাসীর প্রতি ব্রিটিশদের এমন নির্যাতন-নিপীড়নের অসংখ্য ক্ষত-চিহ্ন আজও ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে। ভারতবর্ষে যা কিছু ঘটেছে সব কিছুর মধ্য দিয়েই কেবলই বুঝিয়ে দেওয়া হতো — তোমরা অধীন জাতি, হীনতর জাতি।

ভারতে ব্রিটিশরাজের শাসন অবসানের মাত্র ৭৫ বছর পর একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত সেই “হীনতরজাতির” একজন প্রতিনিধি ঋষি সুনাক যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর আসনে আসীন হয়েছেন। এখনতিনি গ্রেট ব্রিটেন শাসন করবেন। বলতেই হবে, ইতিহাস নিজেই ফিরে আসে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test