E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমানত সুরক্ষিত, ব্যাংকের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত কী ?

২০২২ নভেম্বর ২২ ১৫:২৬:৫৬
আমানত সুরক্ষিত, ব্যাংকের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত কী ?

চৌধুরী আবদুল হান্নান


ব্যাংকে আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ, কোনো টাকার সংকট নেই — হঠাৎ করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমন বিজ্ঞপ্তি প্রচার করার কেন প্রয়োজন পড়লো ? দেশের ব্যাংক ব্যবস্থ্যায় তারল্য সংকট নেই, আতংকিত নাহওয়ার আহবান জানানো হয়েছে।

ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ এবং তা চাহিদা মতো ফেরত পাওয়া যাবে, এমন বিশ্বাস থেকেই মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন।

ব্যাংকের নিজস্ব কোনো টাকা নেই, আমানতকারীদের জমানো টাকা ব্যাংকের জীবনীশক্তি এবং সেই টাকা দিয়েই মূলত ব্যাংকের ব্যবসা চলে।সেই অর্থে ব্যাংকের প্রকৃত মালিক আমানতকারীরা। ব্যাংক ব্যবসার প্রকৃত মূলধন ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস, টাকা কড়ি নয়।

নিকট অতীতে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতে বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারীর ঘটনা ঘটেছে। একটি রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের চেয়ারম্যানই তো একাই সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দিলো, আর একজন দশ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়ে এখন পার্শ্ববর্তী দেশের কারাগারে আটক; ব্যাংকিং খাতে এ জাতীয় অর্থ আত্মসাতের ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। তবে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো, তা হলো টাকা উত্তোলনের জন্য ওই সকল ব্যাংকের আমানতকারীদের প্রদত্ত চেক ডিসঅনার হয়েছে বলে শুনা যায়নি। এমন ঘটনা কদাচিৎ দু-একটি ঘটে গেলে এবং দুষ্টচক্র দ্বারা তা ব্যাপক প্রচার পেলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরী হওয়ার আশংকা থাকে। অন্যদিকে গুজব রটিয়ে সরকারকে বিব্রত করার লোকের তো অভাব নেই। যেমন হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের এক সময়ের অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশ লেবাননে। সেখানে শত শত গ্রাহক ব্যাংকে গিয়ে তাদের জমানো টাকা তুলতে না পেরে বিক্ষোভ করেছে।

দেশে আমানতকারীরা সুরক্ষিত রয়েছে, তা না হয় বুঝলাম, কিন্ত এই যে হাজারো কোটি টাকা আত্মসাৎ হলো, পাচার হলো, এ সকল টাকার মালিক তো রাষ্ট্র বা দেশের জনগণ অর্থাৎ জনগণের সম্পদই লুট হলো।

আমাদের দেশে কোনো ব্যাংক সংকটাপন্ন হয়নি তা নয়, সরকার তাৎক্ষণিকভাবে ভর্তুকি দিয়ে দুর্বল ব্যাংকটিকে সবল করেছে। দেশে ব্যাংক বাঁচাতে ভর্তুকি সংস্কৃতি নতুন নয়। তবে এ ভর্তুকির টাকাও জনগণের ট্যাক্স থেকে আহরণ করা।

ব্যাংক ইচ্ছা করলেই সংগৃহিত আমানতের সবটাই ঋণ হিসেবে বিতরণ করতে পারে না, ব্যাংকে জমাকৃত আমানতের একটি নির্দিষ্ট অংশ রিজার্ভ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে যা আপদকালীন তহবিল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে ।

ব্যাংকের সম্ভাব্য তারল্য সংকটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময় রক্ষা কর্তার ভূমিকায় অবতীর্ন হয়ে থাকে। আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তীক্ষ্ণ নজরদারি বিদ্যমান এবং সর্বোপরি ব্যাংক ব্যবস্থা বিভিন্ন বিধি-বিধান-আইন দ্বারা সুরক্ষিত এবং জনগণের জমা অর্থের নিরাপত্তা রক্ষায় সরকারের সর্বোচ্চ সতর্কতা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমানতের সুরক্ষা নিয়ে আতংক অমূলক। তবে দেশে ব্যাংকের ওপর ধীরে ধীরে জনগণের আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে।

কিন্ত প্রশ্ন এখানেই শেষ নয়, বিশাল জনসংখ্যার দেশে কতজন মানুষ ব্যাংকে সঞ্চয় করার সক্ষমতা রাখেন ? অধিকাংশ মানুষ যা আয় করে তার সবই খরচ হয়ে যায়, কোনো উদ্বৃত্ত থাকে না, জমা করবে কি ?

দেশে বিদ্যমান ৬৪টি ব্যাংকের মোট আমানতের পরিমান ১৪ লক্ষ কোটি টাকার অধিক এবং এ অর্থের মালিক কারা তা বিশ্লেষণ করলে একটি বাস্তব চিত্র কিছুটা পাওয়া যাবে।

এ দেশের ৭৫ শতাংশের অধিক মানুষের সঞ্চয় করার জন্য ব্যাংক হিসাব নেই, তারা যা রোজগার করে তা-ই খরচ করে অথবা সঞ্চয়ের সক্ষমতা নেই।

অবশিষ্ট ২৫ শতাংশের মধ্যে যারা অঢেল টাকা ব্যাংকে জমা রাখেন তাদের মধ্যে কিছু আছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত, নানাভাবে অর্থ আত্মসাতকারী, চাঁদাবাজি, ঘুষ, তদবিরের মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়া, অর্থপাচারকারী জাতীয় শত্রু। সংখ্যার বিচারে তারা উল্লেখযোগ্য নয় কিন্ত ব্যাংকে জমা টাকার সিংহভাগই তাদের, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

দেশের জনসংখ্যা বিবেচনায়, অল্প সংখ্যক মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন এবং তাদের আমানত সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এতো তোড়জোড় কিন্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে অবশিষ্ট অধিকাংশ জনগোষ্ঠির যে নাভিশ্বাস অবস্থা তার প্রতিকারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।

খেলাপি গ্রাহকদের, অর্থ আত্মসাতকারীদের লক্ষ কোটি টাকা মুদ্রা বাজার ও পুঁজি বাজারে প্রবেশ করেবাজার-অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, দ্রব্যমূল্যে বাড়তি চাপ তৈরী করছে। পরিশ্রম ছাড়া প্রাপ্ত অবৈধ এ অতরিক্ত অর্থে সৃষ্ট সামাজিক অস্থিরতার ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে প্রতিটি নাগরিককে। ব্যাংক থেকে লুটে নেওয়া অর্থ বাজার সয়লাব করে বাজার-স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে দিয়েছে যার অভিঘাতে প্রত্যক্ষ ওপরোক্ষভাবে ভুগছে দেশের মানুষ।

ব্যাংক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সুদূর পরাহত, এ খাতটি ইতোমধ্যে দুষ্টদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের পথ জানার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হবে না; ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সকলেরই জানা।

কিন্ত প্রশ্নটা হলো — ঘন্টা বাঁধবে কে? যতদিন চিহ্নত অর্থ আত্মসাতকারী, দাগী অপরাধী যারা আজও সমাজে মাথা উঁচু করে বিলাসী জীবনযাপন করে চলেছে, তাদের আইনের আওতায় সোপর্দ না করে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার চিন্তা করা কেবল হাস্যকরই নয়, মূর্খতাও।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test