E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

এমন সুখস্বপ্ন দেখি প্রতিদিন 

২০২৩ মে ১৮ ১৫:৩০:১৯
এমন সুখস্বপ্ন দেখি প্রতিদিন 

মীর আব্দুল আলীম


মানুষই স্বপ্ন দেখে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সকল মানুষই স্বপ্নবাজ। স্বপ্ন নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে। আমিও স্বপ্ন দেখতে ভালো বাসি; সুখস্বপ্ন। প্রতিদিন দেশে ষোল কোটি ভালো কাজ হবে, তারপর ৩২ কোটি, ৬৪ কোটি। দিন যাবে আরও অনেক ভালো কাজ হবে দেশে। দেশের মানুষগুলো ভালো কাজে দিনেদিনে জড়িয়ে যাবে, সেই সুখস্বপ্নই দেখি প্রতিদিন। আমরা যদি প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ করি তবে দেশে ১৬ কোটি ভালো কাজ হবে। ২টি ভালো কাজ করলে হবে ৩২ কোটি ভালো কাজ, ৪টি করলে দৈনিক হবে ৬৪ কোটি ভালো কাজ। দেশতো তখন সোনার দেশ হবে। ভালো কাজের মাঝে খারাপ কাজগুলো পালিয়ে যাবে। স্বপ্নবাজ মানুষ তাই, এমন সুখস্বপ্নতোই দেখি আমি।

স্বপ্ন দেখি মাদকমুক্ত বাংলাদেশের, স্বপ্ন দেখি সস্ত্রাস, চাঁদাবাজমুক্ত, নকল মুক্ত, ভেজালমুক্ত, দুষণমুক্ত বাংলাদেশের। সর্দাই ভ্রাতৃত্ব, পিতৃত্ব, মাতৃত্ব, বন্ধুত্ব অটুট থাকার স্বপ্ন দেখি। রাতে স্বপ্ন দেখি, দিনেও দেখি। যে স্বপ্ন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখি তা প্রকৃত স্বপ্ন নয়; যে স্বপ্ন মানুষকে ঘুমুতে দেয়না সেটাই হলো আসল স্বপ্ন। রাতে ঘুমিয়েই স্বপ্ন দেখি দেশ হানা-হানি, খুন-খুনিমুক্ত হয়েছে। সকালে পত্রিকা পড়লেই দেখি স্বপ্নটা উল্টে গেছে। রাস্তায় লাশ, ঘরে লাশ, শিশু ধর্ষণ, অপমৃত্যু, নির্যাতন এসবেই আটা থাকে পত্রিকা। একদিন ঘুম থেকে উঠে যদি দেখতাম, সত্যিই দেশটা শান্তির দেশে পরিনত হয়েছে। যদি সকালের পত্রিকার মূল শিরোণামটা দেখতাম এমন “শান্তির পথে ফিরে এসেছে বাংলাদেশ”।

যুদ্ধ করিনি। তবে রাজাকার ছিলাম না। যুদ্ধ করার বয়সতো দেড় বছর নয়। ছোট ছিলাম। বাবা যুদ্ধ করেছেন। তিনি স্বাধীনতার মর্ম বোঝেন। যদি দেশটা শান্তিতে ভরে উঠতো। সকাল গুলো আলোকিত হতো, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছরটা ভালোয় ভালো কাটতো সবার। দেশ থেকে ঘুষ, দুর্নীতি যদি দৌড়ে পালাতো, ধনী-গরীবের ভেদাভেদ না থাকতো, কেউ আর খাবারে ভেজালা না দিতো, চিকিৎসকরা বাণিজ্যিক, সাংবাদিকরা দলবাজ, ভুমিদস্যুরা মানবিকগুণের হতো, জুলুমবাজরা জুলুম ছেড়ে শান্তির পথে ফিরে আসতো; তবে স্বাধীনতার স্বাদ পেতাম আমরা। ভাবি এমন স্বাধীন দেশ কি হবে এদেশ কখনো? কথা হলো, কখনো স্বপ্ন পূরণ হয়, আর কখনও হয় না। এইতো হয়। আমাদের স্বপ্নগুলো একদিন বাস্তবে রূপ নেবেই। দেশ একদিন সোনার দেশ হবেই। এমন স্বপ্নই দেখি প্রতিনিয়ত। আর এমন স্বপ্ন দেখতে দোষ কি তাতে?

চীনের সবচেয়ে বৃদ্ধ মানুষটি যেদিন ১৪৬ বছর বয়সে মারা গেলেন সেদিনকার কথা। সেদিন পত্রিকা পড়ে আমার সেজ মামা (এখলাস গ্রুপের এমডি আলহাজ্ব মাজহারুল হক ভুঁইয়া) আমাকে বলছিলেন- ঐ বৃদ্ধ প্রায়ই নাকি বলতেন “আগের দিনও নেই, আগের মানুষগুলোও নেই”। কঠিন কথা। মামার মুখে এ কথা শোনার পরই ভাবছিলাম এনিয়ে জাতীয় দৈনিকে একটি কলাম লিখবো। সমসাময়িক বিষয়ে লিখতে ভালোবাসি। যেদিনই দেশে কোন বিশেষ ঘটনা ঘটে, পরদিনই সাধারনত কোন না কোন জাতীয় পত্রিকায় আমার কলাম ছাপা হয়। এজন্য দ্রুত লেখা তৈরি করতে হয় আমাকে। এলেখাটা লিখতে গিয়ে ভীষণ ভাবনায় পড়ে যাই আমি। “আগের দিনও নেই, আগের মানুষগুলোও নেই”। কয়েকটি শব্দ মাত্র, কিন্তু এর মমার্থ অনেক। কৈ গেল আগের সেই দিন? মানুষগুলো বদলে গেছে বলেইতো দিনও বেদলে গেছে।

এ লেখায় আমার জীবনের দু’টি গল্প শোনাতে চাই আপনাদের। ছোটবেলার নষ্টালজিয়া থেকেই সে গল্প বলছি। গল্পতো গল্পই! এ গল্প, গল্প নয় বাস্তব ঘটনা। বাস্তবতার সাথেও যে গল্পের মিল থাকে তা ছোট বেলায় নিজের চোখে দেখেছি। বৃহত্তর ঢাকা জেলার তৎকালীন নারায়নগঞ্জ মহকুমার রূপগঞ্জের রূপসী গ্রাম। আমার গ্রাম। প্রিয় স্থান। যেখানে শেষ বেলা ঘুমনোর স্বপ্ন দেখি। কাস থ্রি পর্যন্ত আমার ছোটবেলা ঐ গ্রামেই কেটেছে। ছোট বেলায় আমার মায়ে কাছে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্প শুনেছি। তিনি গল্প শুনিয়েই আমাকে বড় করেছেন। মায়ের গল্পগুলো ছিলো বাস্তবতার সাথে মিলানো। বলছিলাম হেমিলনের বাঁশিওয়াল গল্পের কথা। জার্মানির হ্যানোভারের ৩৩ মাইল দক্ষিণে হ্যামিলন শহরে হ্যামিলনের বাঁশির সুরে যেমন প্রথমে ইঁদুর ও পরে শিশুদের ঢল নেমেছিল ঠিক তেমনি বিরল ঘটনা ঘটতে দেখেছি আমার জন্মস্থান, রূপসীর অজগাঁয়ে। এখনকার স্বনামধন্য পূর্বাচল খ্যাত এলাকাটি তখন নিভৃত গ্রামই ছিলো বলা চলে। এখন শিল্প সমৃদ্ধ শহর। যা কিনা হতে যাচ্ছে এশিয়ার সর্ব বৃহৎ স্যাটেলাইট শহর। তখনকার একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কথা আমার বেশ মনে পরে।

নাম তাঁর সোনামিয়া। যার নামের পরে কবে যে চেয়ারম্যান শব্দটি যোগ হয়েছে এখনও তিনি সেই নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি বেঁচে নেই। চেয়ারম্যান চাচা যখন গাঁয়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতেন তখন, যুব, বৃদ্ধ, শিশুর দল তাঁর সাথে ছুটতো। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো অত ইঁদুর আর শিশুর দল তাঁর সাথে না থাকলেও গোটা ৫০ লোকতো তখন সব সময়ই তাঁর পিছু পিছু ছুটতে দেখতাম। তিনি এ তল্লাটে অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। তার কথায় তখন সবাই উঠতো, আর বসতো। বিচার সালিশ থেকে সব কিছুই সোনামিয়া চাচা অতি সহজে করে দিতেন। তার কোন সিদ্ধান্তে কারো অমত করতে দেখিনি কখনো। সারা থানাই ছিলো তার প্রভাব পতিপত্তি। তাঁর প্রভাব চলতো গরীব অসহায় মানুষের পক্ষে। এখন কি দেখি? নিজেদের নিয়েই ভাবেন অনেকে।

সোনা মিয়া চেয়ারম্যানরা দেশে আছেন কি? থাকলে ক’জন? আজকাল কেউ কাউকে মানতে চায় না। যেন সবাই নেতা। গ্রাম একটা, আর নেতা ১৪ জন। আমার জন্মস্থান রূপসীতেও এখন তাই ঘটছে। দিনদিন গ্রামের মানুষগুলো যেন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। আর রাজনীতিতে বিশুদ্ধতার বড্ড অভাব দেখা দিচ্ছে। তাই সবার সাথে সবার বনিবনা কম হচ্ছে। আগের মানুষ গুলো কই? আগের সেই দিনগুলো কই? নেই। হারিয়ে গেছে। পৃথীবি বদলে গেছে, যা দেখি তাতো সবই নতুন লাগে। আগে অনেক সুন্দর দিন কাটাইতাম। আগে বাঙ্গালী ছিলাম ভালোইতো ছিলাম। সাহেব হয়ে, শহুড়ে হয়ে আর্টিফিসিয়াল হয়ে যাচ্ছি আমরা। আমার দাদা সুবেদ আলী মীর, নানা এখলাছইদ্দিন ভূঁইয়ার মতো ভালো মানুষ এখন আর দেখি না কেন? কাঁদা মাটিতে গড়া মানুষ। আমরা এমন হতে পারছি না কেন? ছলচাতুরি, বাটপারি, মিথ্যাচার তাঁদের কাছেই কখনো ভিড়তো না। গ্রামের বিচার আচার তাঁরাই করতেন। চুল চেঁড়া বিচার। এখন আইন আদালতে ভরে গেছে দেশে। জজ, ব্যারিষ্টারের অভাব নেই। সুবিচারের অভাব? এমন দিনের প্রত্যাশায়ই কি ছিলাম আমরা?

স্বাধীতার আগে এবং পরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গল্প আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার কাছে অনেক শুনেছি। আপামোর দেশের মানুষ নাকি তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতেন। তাঁর কোন আদেশ পেলেই তাই সাদরে গ্রহন করতো আমজনতা। এখন এই বাংলাদেশেই কত শত নেতা-নেত্রী দেখছি। সবাই ক্ষমতা ধর। কেউ কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলে না; মানতে চায়না; বিশ্বাস করেন না। রাজনীতিতে এখন বড় ভেজাল হয়ে গেছে। শুদ্ধতা, পরিপক্কতা খুবই কম। আগের সেই ত্যাগী নেতাও নেই। সে সময় গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বারদের অনেক ইজ্জত ছিলো। এখন নেই তা বলবো না। কতটা আছে জনগন আপনারাই তা ভালো বলতে পারবেন। এখন চেয়ারম্যান মেম্বারদের মানুষ মানতে চায় না। নানা বিভেদ ও স্বার্থের কারনে রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্বও কেউ মানতে চায়তা।

সমিহ করে কতটুকু তাতো দেখছিই প্রতিদিন। করলেও ভয়ে কে বেশ সমিহ করে মামলার ভয়ে, হামলার ভয়ে, জান খোয়ানের ভয়ে। তবে এভাবে সবাইকে এক কাতারে ফেলা বোধ হয় আমার সমোচিন হচ্ছে না। ভালো মানুষ, ভালো চেয়ারম্যান, মেম্বার, কমিশনার, নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী-এমপি নেই তা বলা বোধ হয় ঠিক না। তবে তাঁরা সংখ্যায় খুবই নগন্য। যার কারনে কতৃত্ব, মর্যাদা হারাচ্ছে রাজৈতিদক দলের নেতা এবং জনপ্রতিনিধিরা। এ অবস্থায় দেশের শৃঙ্খলা, আর্থসামাজিক উন্নয়ন কোনটাই সঠিক ভাবে হবে না বলেই মনে করছি। এ বিষয়টি আমাদের দেশপ্রেমিক জনগন, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক এবং বিজ্ঞজন সবাই ভাবনায় এনে নেতৃত্ব এবং জনপ্রতিনিধিদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হবেন এটাই আমরা কায়মনে চাই।

আমার গ্রামের ছোট বেলার পল্লী চিকিৎসক। নাম তাঁর টুকুন ডাক্তার। তিনিও এখন আর বেঁচে নেই। বছর ৪০ আগে মারা গেছেন। নিভৃত পল্লীতে বসেই চিকিৎসা সেবা দিতেন গ্রাম্য চিকিৎসক টুকুন ডাক্তার। তিনি সে সময়কার আমার গ্রামের একমাত্র ডাক্তার। চিকিৎসা সেবার ভরসা। অসম্ভব মেধাবী এই চিকিৎসকের চিকিৎসাপদ্ধতি ছিলো একটু ভিন্ন ধরনের। একেবারে সাদাসিধে জীবনযাপন ছিলো তাঁর। শোয়ার ঘরটিও টিনের বাংলো ঘওে ছিলো। সামান্য সময় পেলেই বসে যেতেন পড়ার টেবিলে। বই সেই চিকিৎসা সাস্ত্রীয়। ডাক্তারীর ওপর সংসার চলতো তাঁর। গোটা গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করলেও তাঁর অভাবের সংসারই ছিলো। টুকুন ডাক্তার তার আসল নাম নয়। তবে এ নামেই তিনি পরিচিত ছিলন। এ নামের ভীড়ে আসল নামটি যেন হারিয়ে গেছে কখন। যখন লিখছি, তখন আমার পিতার কাছে জানতে ছুটে যাই টুকুন ডাক্তারের আসল নাম জানতে। তিনিও বলতে পারলেন না। সরল ভাবে বললেন- ‘ নামতো টুকুন ডাক্তারই।’ পরে তার ছোট ছেলের কাছ থেকে জানা গেলো তার প্রকৃত নাম আব্দুল আজিজ। চিকিৎসা করে সকলের কাছ থেকেই টাকা পয়সা নিতেন না তিনি। অভাবী মানুষদের বলতেন- ‘দুরু; যাওতো। তুমি টাকা দিবা কইথাইক্কা।’ তাঁর সংসারের অভাবটাও বুঝতে দিতেন না রোগীদের।

ঢাকার পাশের রূপসী গ্রামের এই টুকুন ডাক্তারে উপরেই আমাদের গোটা গ্রামের চিকিৎসা সেবা নির্ভর ছিলো। আমার ভাগ্না এ হাই মিলন। বর্তমানে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। আমার বছর খানিকের ছোট হবেন তিনি। সেই ছোট বেলায় কাঁচা বাঁশ দিয়ে ভোঁ ভোঁ করে গাড়ি চালাতে গিয়ে নিজের অজান্তেই আমার থুতনিতেই বাঁশ লাগিয়ে দিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে কেঁটে ঝুলে গেলো মাংস। সবাই ধরা ধরি করে ৬ বছর বয়সী আমাকে নিয়ে গেলেন টুকুন ডাক্তারের কাছে। একটু ডেটল, দু’টি সেলাই আর কয়েকটি ঔষধ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। বললেন- ‘বাড়িত যাইয়া সাবু খাওগা, দুই চারদিন পরে সাইরা যাইবো।’ তাই হয়েছে। সেই আমারই বড় ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় সামান্য ব্যাথা পেয়ে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের কেবিনে ২২ দিন, এবং পরে তিনি যে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সে মেডিক্যাল কলেজে ২ মাস ভর্তি ছিলেন। সামান্য পায়ের আঘাতেই তার ৬ মাস লেগে গেছে সুস্থ্য হতে।

আসলে আমরা নিজেরাই যেন কেন দিন দিন জটিল হয়ে যাচ্ছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়ন হয়েছে। অবনতি হয়েছে আমাদের। আমাদের চিকিৎসকরা অনেকে দিনকে দিন জটিল হচ্ছেন, বাণিজ্যিক হচ্ছেন (তবে সবাই না)। ছোট বেলায় জ্বর হলে মা জোর করে সাগু খাইয়ে দিতেন। সাগু খাওয়ার ভয়েই দৌড়ে পালাতো জ্বর। তা না হলে বড় জোড় ডাকা হতো টুকুন ডাক্তারকে। তিনি যে দোকানে বসে চিকিৎসা দিতেন তার আশপাশের পথঘাটগুলো মান্ধাতা আমলের ছিলো। সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটু কাঁদা। তখন ছিলো না ওই গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থাও। ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় রাত বিরাতে অন্ধকারেই ছুটতেন টুকুন ডাক্তার। তিনি মিক্চার কিংবা দু/একটা বড়ি খাইয়ে দিলেই জ্বর-জারি হাওয়ায় মিলাতো। আর হাঁচি কাশিতো তিনি তুঁড়ি দিয়েই সারিয়ে দিতেন। এখন আছেন কি সেই ভদ্র, সজ্জন, বিনয়ী, ত্যাগী ও মানব দরদী কোন টুকুন ডাক্তার? এখনকার ডাক্তারগন সেবা দেন না তা বলছি না। বললে যে আমার ঘারেই পড়বে বেশি। কারন আমার পরিবারেই ডজন খানেক ডাক্তার আছেন। ডাক্তারগন এখন বড্ড বেশি প্রফেশনাল, এটা আমাকে বলতেই হবে। হাসপাতাল গুলোতো বটেই!

আমি নিজেও আল-রাফি হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছি। নারায়নগঞ্জ জেলার হাসপাতাল এবং ডায়াগনষ্টিক সেন্টার এসোসিয়েশনের উপদেষ্ট আমি। উপদেষ্টা হিসাবে স্থানীয় তিন এমপি গাজী গোলাম দস্তগীর (বীর প্রতিক), নজরুল ইসলাম বাবু, এবং লিয়াকত হোসেনও রয়েছেন। আমরা হাসপাতাল মালিকদের নিয়ে যখন আলোচনায় বসি তখন একটি কথাই আমি আমার বক্তব্যে বলি, হাসাপাতাল ব্যবসা বলবেন না। এটা চিকিৎসা সেবা। ২৭ জানুয়ারী ২০১৮ আল-বারাকা হাসপাতালে সমিতির সাধারন সভায় অতিথি হিসাবে ছিলাম। সবাইকে একটি গল্প শুনিয়েছে।

আমার গল্পতো সব বাস্তব ঘটনা নিয়ে। বাস্তব ঘটনাকে গল্প বলি, এ কারণে যে আমাদের চাওয়া পাওয়া গুলো বাস্তবে রূপ পায় কম। গল্পের মতো মিলিয়ে যায় সব। নাটক সিনেমা শেষ হলে যা হয় তাই। মনে রাখে না কেউ। বাস্তবে রূপ পায় না। দিন আগের কথা। রাতে একজন মোবাইলে ফোন করে বলছেন-“স্যার আপনার হাসপাতালের আমার নাতি হইছে। বারবার কইছি সিজার করতে। করে নাই। নরমাল ডেলিভারি করনে আমার মাইয়ার অনেক ক্ষতি হইয়া গেছে।” কি ক্ষতি জানতে চাইলাম আমি। বললেন সেলাইয়ে সমস্যা হয়েছে। বললাম অপরাধীতো আমি নিজেই। হাসপাতালে সোজাসুজি বলে দিয়েছি অপারেশনতো দুরের কথা অহেতুক একটি ইনজকশনও কারো গায়ে পুশ করা যাবে না।

আপনারা অপরেশন চাইলেও আমরা প্রথম নরমাল প্রসবের চেষ্টা করি। হয়তো তাঁরা তাই করেছেন। বললাম, একটি অপারেশন এতো সহজ কথা নয়। তাতে সারাজীবনের প্রতিক্রিয়া থাকে। আরও বললাম অপারেশন করে দিলেইতো কয়েক হাজার টাকা পেতাম আমরা। জানতে চাইলাম হাসপাতালে কত টাকা দিয়েছেন। ৫ শ’টাকা। বললাম টাকাও বেঁচে গেছে, আপনার মেয়েও একটা অপারেশন থেকে রক্ষা পেয়েছে। বললাম আগামী কাল ৪টায় চলে আসেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের গাইনির বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে বলে রাখবো আপনার মেয়ের সমস্যাটা যেন ভালো ভাবে দেখেন। এও বললাম আমাদের অপরাধের জন্য যদি প্লাষ্টি সার্জারির প্রয়োজন হয় তাও বিনে টাকায় করে দেব। পরে চিকিৎসা শেষে ঐ ব্যক্তি এবং কার মেয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। বলেছি এটা আমাদের কর্তব্য। আমরা অহেতুক অপারেশনে বিশ্বাসী নই। মানুষতো আমরা? কয়েটা হাজার টাকার জন্য অহেতুক পেট কেঁটে কাউকে পঙ্গু করতে চাইনা। চিকিৎসা যেন সেবার জায়গায়ই থাকে, সে কথাই সেদিনের সভায় হাসপাতালের মালিক ডাক্তার সবাইকে বললাম।

সারা দেশে সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল ও কিনিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন কোনো শেষ নেই। অনেক কিনিকে তো রীতিমতো অচিকিৎসকরাই রোগীদের চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। অথচ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বড় বড় কর্মকর্তা যেন ‘নাকে তেল দিয়ে’ ঘুমায়। দেশের ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অবস্থা তো আরো ভয়াবহ। রোগ পরীক্ষার নামে এদের বেশির ভাগই মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে, রোগীদের প্রকারন্তে হত্যা করছে। এ রকম হৃদয়বিদারক ঘটনা অহরহ ঘটছে। কারণ বেশির ভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রশিক্ষিত লোকজন বা টেকনিশিয়ান নেই বললেই চলে। পরীক্ষায় যেসব উপাদান (ইনগ্রেডিয়্যান্ট) ব্যবহার করা প্রয়োজন, তা করা হয় না। আবার অনেকে খরচ কমাতে মেয়াদোত্তীর্ণ উপাদান ব্যবহার করে। এসব সেন্টারে আগে থেকে প্যাথলজির একজন অধ্যাপকের সই করা রেজাল্ট শিট থাকে; সেগুলোতে যা খুশি লিখে রোগীর স্বজনদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। আমরা জানি না, আর কত নিচে নামব আমরা? নীতি-নৈতিকতাহীন ব্যবসার কাছে মানুষ আর কতকাল অসহায় হয়ে থাকবে? আর কত নিষ্ঠুরতা আমাদের দেখতে হবে?রাষ্ট্রের কাছে আমরা এর প্রতিকার চাই। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে যেন ব্যবসার নামে লাগামহীন কর্মকা- না চলে, তার নিশ্চয়তা চাই।

আমরা বদলাতে চাই, বদলে দিতে চাই। সুখ চাই, শান্তি চাই। বউলের মতো সুরে সুরে বলতে চাই না “শান্তির মায় মইরা গেছে অশান্তির মায় মরে না।” শান্তির সুখম্বপ্ন দেখি আমরা। শান্তিময় বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি আমরা। নীতি-নৈতিকতা বির্জিত মানুষ হতে চাই না আমরা। নোংরা কুলশিত সমাজ চাই না। ব্যবসার নামে এক শ্রেণীর বিবেকহীন মানুষ বিষ খাইয়ে মানুষ মারছে। অপচিকিৎসায় দেশে মানুষ মরছে। এজনের জমি আরেকজন গায়ের জোরে হরণ করছে। সম্পদ লুট হচ্ছে, মানুষ গুম হচ্ছে, খুন হচ্ছে। দিনদিন প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। প্রতিনিয়তই আমাদের ভেজাল ও বিষযুক্ত খাবার হজম করতে হচ্ছে, ব্যবসার নামে শিক্ষার অধঃপতন ঘটিয়ে দেশে সার্টিফিকেট বিক্রি হচ্ছে, বারবার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। আরো কত কী! অথচ রাষ্ট্র উদ্বেগহীন, নির্বিকার। এভাবে আর কত কাল চলবে?

এভাবে তো চলে না? চলতে পারে না? আর চলতে দেয়া যায়ও না। সব শেষ হয়ে যাবার আগেই বদলে যেতে হবে আমাদের। মুখোশধারীদের রূপ বদলে দিতে হবে। তবেই বদলে যাবে দেশ। এই স্বপ্নই দেখি আমরা। এ লিখার শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। ভোর হয়েছে। মোয়াজ্জিানির আজান শুনতে পাচ্ছি। সুন্দর সকালটার মতই সুন্দর হউক আমার এ দেশ। আমাদের স্বপ্ন গুলো বাস্তবে রূপ পাক। এই প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, সমাজ গবেষক, চেয়ারম্যান, আল-রাফি হাসপাতাল।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test