E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Walton New
Mobile Version

চামড়া শিল্প খাতে অপার সম্ভাবনা

২০২৩ নভেম্বর ২৮ ১৫:২৯:৩২
চামড়া শিল্প খাতে অপার সম্ভাবনা

মীর আব্দুল আলীম


চামড়া শিল্পে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বর্তমানে রফতানি খাতে চামড়ার অবদান ৯ শতাংশেরও বেশি। তাই বিশ্বব্যাপী চামড়ার বাজারে বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে তুলে ধরতে এবং চামড়া শিল্পকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চলছে নানা পরিকল্পনা। আশা জাগানিয়া একটি বিষয় হলো, ফরাসিদের ‘ফ্রেঞ্চ কাফের’ পর মানের দিক থেকে আমাদের দেশের চামড়াই দুনিয়ার সেরা। চামড়া শিল্পের বোদ্ধারা তাই মনে করেন। এরকম স্মুথ গ্রেইনের চামড়া বিশ্বের আর কোথাও মেলে না। গুণগত মানের কারণে গত এক দশকে সমানতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে চামড়াজাত পণ্য রফতানির পরিমাণ। এটাও সত্য যে, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এ শিল্প যতটা এগোনোর কথা ততটা এগোয়নি এখনও। এ শিল্পকে অনেক সামনে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। আমাদের দেশের চামড়া দিয়ে বিশ্বমানের হুগো বসের মতো প্রতিষ্ঠান জুতা তৈরি করে বিশ্ববাজারে বিক্রি করছে। আমাদের জানা মতে, প্রতিষ্ঠানটির তৈরি এক জোড়া জুতা বাংলাদেশের অর্থমানে ৩০/৪০ হাজার টাকা।

বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি পণ্য হিসাবে পরিগণিত হয়। এ সম্ভাবনাময় খাতকে আরও কাজে লাগিয়ে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়া সম্ভব কিন্তু রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে চামড়া শিল্প যতটা সামনে এগিয়ে যাবার কথা ততটা আগায়নি। যেন পিছিয়ে পড়েছে কিছুটা। অথচ জাপান, ইটালি, জার্মান, ইংলেন্ডসহ উন্নত বিশ্বে আমাদের চামড়ার শিল্পের যথেষ্ট সুনাম এবং চাহিদা রয়েছে। এ সুনাম এবং চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে প্রতি বছর লাখ লাখ ডলার কামিয়ে নেয়া সম্ভাব।

আশার কথা হলো, ইউরোপের সবচেয়ে বড় জুতা বিক্রেতা ডাচম্যানের তিন হাজার আট শতাধিক শোরুম রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি এখন বাংলাদেশ থেকে চামড়াজাত জুতা আমদানি শুরু করেছে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির শিরদাঁড়া শক্ত হতে শুরু হয়েছে। আমেরিকা ছাড়াও বাংলাদেশের জুতা যাচ্ছে ইউরোপের জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ইতালি, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়ামে। রাশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপানেরও খুব পছন্দ বাংলাদেশি জুতা। চামড়ার গুণগত মান তুলনাহীন হওয়ায় রফতানি বেড়েছে, বেড়েছে চাহিদাও। চামড়ার জুতা তৈরির সকল ধরনের সুবিধাই প্রস্তুত। এ শিল্পে ঝুঁকছে বিদেশি নামীদামী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। আমরা মনে করি, গার্মেন্ট শিল্পের পর চামড়া শিল্পই এখন বিদেশি বিনিয়োগ আসার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত।

দেশে বর্তমানে ১১০টি রফতানিমুখী কারখানায় চামড়ার পাদুকা তৈরি হয়। এর মধ্যে এপেক্স, এফবি, পিকার্ড বাংলাদেশ, জেনিস, আকিজ, আরএমএম, বেঙ্গল এবং বে’র রয়েছে নিজস্ব ট্যানারি ও চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। এর বাইরে শুধু চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে এমন কারখানার সংখ্যা ২০৭টি।
বাংলাদেশ হয়ে উঠছে বিদেশি ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের প্রধান আকর্ষণ। কারণ এ শিল্পের জন্য পর্যাপ্ত কাঁচামাল, চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, সস্তা শ্রম এবং জুতা তৈরির জন্য যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে আমাদের।

এছাড়া চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে সরকারের ১৫ ভাগ ভর্তুকি সুবিধার ফলে বিদেশি উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। চামড়া শিল্পে রফতানি বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে বিনিয়োগ। বিদেশি বিনিয়োগও আসছে দেশে। আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানিতে সুবিধা থাকায় ডলারেও টান পড়ছে না। সরকারি শুল্কে ছাড় রয়েছে বেশ পর্যাপ্ত পরিমাণে। লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতির সাথে কথা বলে জানা গেছে, এরই মধ্যে অন্তত ৫১টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান যৌথ বিনিয়োগে বাংলাদেশের পাদুকা শিল্পে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

সম্ভাবনার দুয়ার সামনে আরো খুলে যাবে। জানা গেছে, চামড়ার জুতা উৎপাদনকারী প্রধান দেশ চীন, ভিয়েতনাম এবং ব্রাজিল এ খাত থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। ফলে গার্মেন্টের মতো আমাদের দেশে এখন এ খাতের ব্যবসা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। বিপুল সম্ভাবনাও আছে এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার। চীনের চামড়া শিল্প নিয়ে রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেট ডটকমের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১২-১৩ সালে চীনে চামড়ার তৈরি জুতা শিল্পের উৎপাদন ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ কমেছে। চীনের ছেড়ে দেয়া বিশ্বের জুতার বাজারের ওই অংশটিই ধরতে চাইছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।

প্রেসিডেন্স রিসার্চের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী চামড়াজাত পণ্যের বাজারের আকার ছিল ৪২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০২৩ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে প্রসারিত হয়ে ২০৩২ সালের মধ্যে এটি প্রায় ৭৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। গ্লোবাল বিজনেস ডেটা প্লাটফর্ম স্ট্যাটিস্টার হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে রপ্তানিকৃত বিশ্বব্যাপী চামড়াজাত পণ্যের বাজারের ৩০ শতাংশেরও বেশি অংশ চীনের দখলে। এরপর রয়েছে ইতালি, ফ্রান্স, ভিয়েতনাম এবং ভারত। এই খাতের মাধ্যমে বেশ ভালো রপ্তানি আয় হচ্ছে দেশগুলোর। অথচ বর্তমানে পুরো বিশ্বের মোট গবাদি পশু ১ দশমিক ৩ থেকে ১ দশমিক ৮ শতাংশের আবাসস্থল বাংলাদেশে হওয়া সত্ত্বেও বৈশ্বিক চামড়া বাণিজ্যে দেশটির হিস্যা মাত্র ০ দশমিক ৫ শতাংশ।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী গত কয়েক বছরে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট বছরের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.৫৯ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২.০৩ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬.০৬ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২১.৭৮ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৮.০৬ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩২.২৩ শতাংশ। সদ্য বিদায়ি অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ মাসে চামড়া ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬২.৭৩ মিলিয়ন ডলার। রফতানি হয়েছে ১১৪.৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চামড়াজাত পণ্য লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৯৮.৭৮ মিলিয়ন ডলার। রফতানি হয়েছে ৩৬১.৪৭ মিলিয়ন ডলার। ফুটওয়্যার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৪১.৩১ মিলিয়ন ডলার। রফতানি হয়েছে ৬৪৪.১৮ মিলিয়ন ডলার।

চামড়া সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সারা বছরে সংগৃহীত চামড়ার ৬০ শতাংশই আসে কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে। কিন্তু চামড়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করায় বিপুল পরিমাণ চামড়া ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। কোরবানির পশুর শরীর থেকে সঠিক পদ্ধতিতে চামড়া ছাড়ানো ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রতি বছর মোট চামড়ার ১৮ থেকে ২০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে প্রতি বছর দেশ হারাচ্ছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। এছাড়া পরিবহনে দীর্ঘসূত্রতা, অতিমুনাফা প্রবণতার কারণে পরিমাণ মতো লবণ প্রয়োগে কার্পণ্য করা এবং সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণে না রাখার কারণে এসব চামড়ার অনেকাংশই প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে অকেজো হয়ে পড়ে। অনেক দিন থেকেই নাজুক পরিস্থিতি পার করছে দেশের চামড়া শিল্প। পানির চেয়েও কম দামে বিক্রি হচ্ছে কোরবানিকৃত পশুর কাঁচা চামড়া। কয়েক বছর ধরে নামমাত্র মূল্যে কাঁচা চামড়া কিনছেন ব্যবসায়ীরা। তার পরও এ খাতের বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই খেলাপি ঋণের চক্রে আটকা পড়েছেন।

চামড়া শিল্পের জন্য অধিক শ্রমশক্তির প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে আছে। এ খাতে বর্তমানে ৬০ শতাংশেরও বেশি মহিলা কর্মী রয়েছে। বর্তমানে এই শিল্পে প্রায় ২ লাখ কর্মী নিযুক্ত রয়েছেন এবং ভবিষ্যতে আরও কয়েক লাখ কর্মী নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ২২০টি ট্যানারি, ৩,৫০০টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান, প্রায় ৯০টি বড় সংস্থা এবং ১৫টি বড় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে চামড়া শিল্প গঠিত। দেশে বছরে ৩১০ মিলিয়ন বর্গফুট চামড়ার কাঁচামাল উৎপাদিত হয়। দেশের প্রায় ৭৬ শতাংশ ট্যানারি রফতানিমুখী। বর্তমানে আমাদের রফতানি আয় ১ বিলিয়নের বেশি এবং এটি আরএমজির পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত হিসেবে তৈরি হয়েছে। গত এক দশকে দেশের চামড়া শিল্পের রফতানি ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ উৎপাদনে বিশ্বে ৬ষ্ঠ স্থান এবং বিশ্বব্যাপী রফতানিতে ২০তম স্থান অর্জন করেছে। বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে আরও ১০টি দেশে জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চামড়া শিল্পে রফতানি আয় হয়েছে রেকর্ড ১০১৯.৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে অন্যান্য পাদুকা (চামড়াবিহীন) শিল্পের রফতানি আয় ১১.২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২২ সালের মধ্যে এ খাত থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় করা সম্ভব হবে।

বিশ্বে বাংলাদেশি চামড়াজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হলো জাপান। মোট রফতানি পণ্যের ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশই যায় জাপানের বাজারে। এর অন্যতম কারণ হলো, বাংলাদেশি চামড়ার জুতার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই জাপান ‘ডিউটি ফ্রি’ ও ‘কোটা ফ্রি’ সুবিধা দিয়ে আসছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ১৩৭ কোটি ডলারের বিপরীতে আয় হয়েছে ১০৮ কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছওে ২০১৮-২০১৯এ এ খাতের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২৮ কোটি ডলার। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ কোটি ৬৫ লাখ পিস কাঁঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ছাগলের চামড়া ১ কোটি, গরু ৫০ লাখ এবং ভেড়া ও মহিষ মিলে ১৫ লাখ পিস। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়।

আর এই চামড়ার প্রায় অর্ধেকই পাওয়া যায় কোরবানি ঈদের সময়। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রতি বছর ২০০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন জোড়া জুতা তৈরি হয় বাংলাদেশে। বলা বাহুল্য আভ্যন্তরীণ চাহিদার শতকরা ৫০ ভাগই মেটানো হয় দেশে তৈরি জুতা দিয়ে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে। বিশাল ওই বাজারে বাংলাদেশ মাত্র ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি করে। বাংলাদেশ এ শিল্পের কাঁচামাল সমৃদ্ধ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। উৎকৃষ্ট মানের পশু চামড়া উৎপাদনে বহুকাল ধরে এদেশের সুখ্যাতি রয়েছে সারা পৃথিবীতে। চামড়া শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে এ খাতে ৫ বিলিয়ন ডলার রফতানির পাশাপাশি সম্ভাবনাময় এ শিল্প খাতে ৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব।

বর্তমানে বিশ্ববাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে। বিশাল ওই বাজারে বাংলাদেশ মাত্র ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি করে। বাংলাদেশ এ শিল্পের কাঁচামাল সমৃদ্ধ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। উৎকৃষ্ট মানের পশু চামড়া উৎপাদনে বহুকাল ধরে এদেশের সুখ্যাতি রয়েছে সারা পৃথিবীতে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পাদুকা ও চামড়াজাত পণ্যেরও রয়েছে বিপুল চাহিদা। পণ্যের মানোন্নয়ন এবং পণ্যের বহুমুখী ও বৈচিত্র্যকরণ করা সম্ভব হলে আমাদের চামড়াশিল্প যেমন আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাবে তেমনি রফতানিও বাড়বে। চামড়া শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে এ খাতে ৫ বিলিয়ন ডলার রফতানির পাশাপাশি সম্ভাবনাময় এ শিল্প খাতে ৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব। তবে বাংলাদেশের চামড়া শিল্প নিয়ে বড় অভিযোগ হলো, এটা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এবং এখানে অবাধ শিশুশ্রম দেখা যায়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের চর্মশ্রমিকদের অত্যন্ত ঝঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে হয়। যেখানে চামড়া শিল্প রয়েছে সেখানে বছরের পর বছর মাটি, পানি, বাতাস বিষাক্ত করছে। পরিবেশগত সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে চামড়া হবে রফতানির প্রধান পণ্য।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) বার্ষিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত অর্থবছরে চামড়া, চামড়ার তৈরি জুতা ও চামড়াজাত অন্যান্য পণ্য থেকে মোট রপ্তানি আয় এসেছে ১২২ কোটি ডলার, যা আগের বছরে ছিল ১২৪ কোটি ৫১ লাখ ডলার। সেই হিসাবে মোট রপ্তানি আয় কমেছে ১.৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে চামড়ার জুতা রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ৬.৯৩ শতাংশ এবং চামড়ায় কমেছে ১৮.৪৫ শতাংশ। তবে চামড়াজাত অন্যান্য পণ্য থেকে আয় বেড়েছে ১৭ শতাংশ। চামড়া শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে শিল্পটি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি এখন দেশের অন্যতম বৃহত্তম রপ্তানি খাত। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৯৪১ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৮ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই খাতে মোট রপ্তানির পরিমাণ তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানির ঊর্ধ্বমুখী ধারা বজায় রয়েছে।

সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে বার্ষিক রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার চেষ্টা করছে। লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিশেন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সূত্রমতে, ‘চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও পুরো চামড়া খাতের কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা না গেলে সামনে আরো বেশি সংকট তৈরি হতে পারে। এজন্য সরকার সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কাজ করে যেতে হবে।

চামড়া শিল্প থেকে বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশ বছরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি রোজগার করে থাকে। এ খাতে সম্ভাবনা দিন দিন বাড়ছেই। পরিবেশগত সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে চামড়া চলে আসবে সোনালি আঁশ পাটের জায়গায়। ট্যানারি শিল্প খাতের প্রধান কাঁচামাল চামড়া। আমাদের দেশে চামড়া শিল্প সম্ভাবনাময় এবং উল্লেখযোগ্য খাত হিসেবে চিহ্নিত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দীর্ঘদিন ধরেই ব্যর্থতার চক্করে ঘুরপাক খাচ্ছে এ শিল্প খাতটি। এ খাতের বিকাশ এবং স্থায়ীকরণের জন্য ২০০ একর জমিতে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলতে দীর্ঘ ১৬ বছর পার করেছে সরকার। এতে পর্যায়ক্রমে চামড়া রফতানির আয় কমে যাচ্ছে এবং কাঁচা চামড়ার দামের ধস নেমেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সারা বছর ট্যানারির জন্য চামড়া এলেও কোরবানির পশুর চামড়ার আধিক্য প্রতি বছরই পরিলক্ষিত হয়। অথচ চামড়া শিল্পের প্রধান এই কাঁচামাল চামড়ার দাম বাজারে সবচেয়ে কম। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকার কাঁচা চামড়ার দাম বেঁধে দিলেও দাম নির্ধারণে ব্যবসায়ীদের স্বার্থই সংরক্ষিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে চামড়ার দাম কমে যাওয়া অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। মধ্যসত্ত্বভোগী এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত করা গেলে চামড়া শিল্পে আমরা এগিয়ে যাব বহুদুর।

তাই চামড়া শিল্পের মানোন্নয়নে সরকারের আর্থিক সহযোগিতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির লক্ষ্যে আরো লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে হবে। চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ, চামড়া শিল্পের জন্য আলাদা শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা, চামড়া শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলা, ব্যবসায়ীদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানির বিপরীতে পাওনা শুল্ক ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব দূরীকরণ, চামড়া প্রক্রিয়াকরণে লবণ ও অন্যান্য ব্যবহৃত কেমিক্যালের মূল্য না বাড়ানো, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে আরো কার্যকর করা প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাছাড়া চামড়া শিল্পের উন্নয়নে অবশ্যই বড় আকারের খামার গড়ে তুলতে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।

চামড়া শিল্পকে টেকসই করতে নানামুখী উদ্যোগের পাশাপাশি চামড়া ও চামড়াভিত্তিক শিল্পের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত নীতিমালা থাকা দরকার। চামড়া আমদানিকারক দেশ থেকে প্রযুক্তি ধার করা যেতে পারে। চামড়ার মৌসুমে সরকারের পক্ষ থেকে সহজ শর্তে ঋণসহ চামড়া চোরাচালান বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশে কাঁচা চামড়ার বার্ষিক চাহিদার প্রায় শতকরা ৪৫ ভাগ আসে কোরবানির পশু থেকে। আসছে কোরবানির ঈদে সঠিক ব্যবস্থাপনা, বাজার মনিটরিং, দ্রুত সংরক্ষণ, পরিবহন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এ খাতের বিভিন্ন স্তরে ব্যবসায়ীরা যাতে লাভবান হতে পারেন এবং উন্নতমানের চামড়া প্রস্তুত করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শুধু চামড়া উৎপাদন নয়, বহুমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক অগগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে সম্ভাবনাময় চামড়া খাত উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।

লেখক : সাংবাদিক ও সমাজ গবেষক, সেক্রেটারী জেনারেল, কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

২৭ জুলাই ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test