E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

৫০ বছরে পণ্যমূল্য বেড়েছে ৮০ গুণ!

২০২৪ মার্চ ০১ ১৫:১৮:১৬
৫০ বছরে পণ্যমূল্য বেড়েছে ৮০ গুণ!

মীর আব্দুল আলীম


ডিমের হালি ২৫ পয়সা, চাল ২ টাকা, ১ টা ইলিশ মাছ ৭/৮ টাকা, গরুর মাংস ২০/২৫ টাকা! অবাক হওয়ার মতো অবিশ্বস্য দাম। না এ কালে নয় আরও ৫ দশক আগে এসব পণ্যেও দাম এমনই ছিলো। কিন্তু এসব পণ্যেও মূল্য কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? এখন ৫০ টাকায় এক হালি ডিম, ১ কেজি চাল ৫০ থেকে ৯০ টাকা, ১ টা ইলিশ (মাঝারি) ১ হাজার টাকা আর ৭ শ’টাকা কেজিতে কিনতে হয় গরুর মাংস। এ হিসেবে ৫০ বছর পর ১ হালি ডিমের সম্ভাব্য দাম কত হবে? ৮০ গুন বাড়বে ডিমের দাম। ৫০ বছর পর ১ কেজি চাল হয়তো কিনতে হবে ৮/৯ শ’টাকায়। ১ টি ইলিশের দাম ১৪৭ গুণ বেড়ে কত দাঁড়াবে এ অংকটা কষে দিলে পাঠক আপনাদের অবিশ্বাস হবে। আর ১ কেজি গরুর মাংস ৩৫ গুণ বেড়ে হবে ২৪ হাজার ৫ শ’ টাকা। টাকা মূল্যহীন হচ্ছে পণ্যেও কাছে। এ হিসেবে এখন থেকে ৫০ বছর পর ১ হালি ডিম, ১ কেজি চাল, ১টা ইলিশ আর ১ কেজি গরুর মাংস কিনতে গুনতে হবে কয়েক লাখ টাকা। আর এ অর্থ দিয়ে ৫ থেকে ৭ জন লোক এক বেলা খেতে পারবেন। তরকারি দাম এখানে না হয় যুক্ত নাই করলাম। আর এ পরিমানের খাবার কিনতে তখন বস্তা ভরে টাকা নিয়ে যেতে হবে বাজারে। আমার এ পরিসংখ্যান অবিশ্বাস্য বটে। তবে যে কেই ভালো করে হিসাব যন্ত্র নিয়ে হিসেব কষে নিলে অবিশ্বাস আর ঘোর কাটবে বৈকি!

এখন যাদের বয়স ৪৫ তাদের নিশ্চয় মেনে আছে তখন ১ পয়সারও মূল্যমান ছিলো। সে সময় ১ পয়সায় মিলতো ১টি বুনবুনি (ছোট গোল চকলেট)। এক পয়সায়ও তখন বেশ কেনাকাটা করা যেতো। আর আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে টাকার মূল্য মান। রিক্সাওয়ালা নুন্যতম ভাড়া ২০ টাকা এখন আর নিতে রাজি হয় না। ভিক্ষুককে এখন ১/২ টাকা দেয়া যায় না। ১০ টাকা ২০ টাকা ৫০ টাকা ১০০ টাকা, ৫০০ টাকা এখন মূল্যহীন। হাজার টাকা তারওতো একই দশা। আর হারিয়ে গেছে পয়সা! অভ্যন্তরীণ মুদ্রাবাজারে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে পয়সা। ক্রমাগত জীবন-যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে পয়সা এখন অচল। হারিয়ে গেছে প্রায় মুদ্রাবাজার থেকে। কালেভদ্রে দু’য়েকটি পয়সা কারো হাতে এলেও সেগুলো এখন আর কেউ নিতে চায় না। বাস কন্ডাক্টর এবং এমন কী ভিক্ষুকও এখন পয়সা দেখলে নাক সিঁটকায়। বস্তুত: মুদ্রাবাজারে পয়সা মূল্যহীন হয়ে পড়েছে প্রায় এক দশক আগেই। তবে মূল্যহীন হয়ে পড়লেও খুব সীমিত পর্যায়ে দু’য়েকটি ক্ষেত্রে (যেমন: বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল প্রদান) এগুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। কিন্তু এখন তাও নেই। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এক পয়সা, পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা ও পঞ্চাশ পয়সা ইত্যাদি বিভিন্ন মানের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। কিন্তু কালক্রমে জীবন-যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে এগুলোর ব্যবহার ক্রমশ: কমতে থাকে। মূলত: নব্বই দশকের গোড়া থেকেই পয়সার ব্যবহার ক্রমশ: কমতে থাকে। আর পয়সার ব্যবহার কমে আসায় এ সময় নতুন করে বাজারে পয়সার সরবরাহও বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিবর্তে এক টাকা সমমানের মুদ্রাবাজারে ছাড়া হয়। বর্তমানে এক টাকা, দুই টাকা ও পাঁচ টাকার সমমানের মুদ্রা বাজারে চালু রয়েছে।

৯০ দশকের কথা তখন ১ টাকার নোট দিয়ে কম করে হলেও ৮টি লজেন্স পাওয়া যেত, সিঙ্গারা ছিল ৫০ পয়সা। আইক্রিম ছিল ২৫ থেকে ৫০ পয়সা, দুই টাকায় ৫০ গ্রাম চানাচুর বা বাদাম পাওয়া যেত। ১টাকায় ৪০টি মার্বেল পাওয়া যেত। এখন আপনাকে যদি দুই টাকার মূল্যায়ন করতে বলা হয় তবে ১টার নোটের মূল্য আপনার আমার কাছে মূল্যহীন। অথচ ছোট সময়ের এই এক টাকার নোট আপনাকে যে সুখের অনুভূতি দিয়েছে এখন পকেটে থাকা ২০০০ টাকাও সেই অনুভুতি দিতে পারে না। যখন আমরা ছোট ছিলাম তখন চাওয়া গুলো ছোট ছিল। এই কারণে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে ব্যবধান কম ছিল, বিধায় মনে অনেক সুখ অনুভূত হতো। কিন্তু এখন প্রত্যাশা অনেক বড়, প্রাপ্তি সেই তুলায় অনেক কম, তাই দুঃখের ভাগটাই বেশি। আসলে নামতে নামতে তলানিতে এসে ঠেকল টাকার দাম। বর্তমানে এশিয়াতে মুদ্রা হিসাবে সবথেকে খারাপ প্যারাফর্মেন্স করেছে টাকা। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট ও ক্রেডিট ডেফিসিটের জন্যই টাকার দামের এই রেকর্ড পতন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হস্তক্ষেপ করতে পারে বলে আশা করছে অর্থনৈতিক মহল।

প্রকৃতই টাকা সকলেরই প্রয়োজন এবং সকলেই টাকা পছন্দ করে। আমি সাধারণ মানুষের কথা বলছি। দেখতে খুবই সুন্দর কিন্তু নতুন কী পুরাতন টাকার নোট ধরলে হাত ধুইয়ে পরিষ্কার করতে হয়। নতুন টাকার নোটে রাসায়নিক থাকে আর পুরান নোট না জানি কতো আজেবাজে হাত হয়ে আপনি পর্যন্ত পৌঁছেছে। যত অপরিষ্কারই হোক টাকার প্রয়োজন আছে এবং প্রতিটি নোটের একটি মূল্যমান আছে। কী করে এই মূল্য নির্ধারণ হয়। একই সাইজের কাগজের টুকরার কোনো মূল নেই, টাকার আছে। সেক্রেটারি অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যে কোনো মূল্যমানের টাকায় দস্তখত করে সত্যায়িত করলেই টাকার একটি মূল্য হয়ে যায়। তাহলে ওই দস্তখতটাই টাকা তৈরির জন্য খুব প্রয়োজনীয়। টাকা হলো এক প্রকার অঙ্গীকারনামা। গভর্ণর সাহেব টাকার গায়ে যে অঙ্ক লিখে দিবে এবং বাহককে দেয়ার অঙ্গীকার করবে সে টাকার মূল্যমানের স্বর্ণ ব্যাংকে রাখা থাকে। প্রথমে মানুষ জিনিসপত্র বদলের মাধ্যমে কেনা-বেচা করতো। তারপর কড়ি কেনাবেচার মাধ্যম এবং বর্তমানে সরাসরি কাগজের টাকার মাধ্যমে আদান প্রদান হয়। আসলে গভর্নরের মূল্য এঁটে দিলে টাকা হবে মূল্যবান। যে মূল্য এঁটে দেবেন সেটাই তার মূল্য। নইলে মূল্যহীন কাগজ তো মূল্যহীনই। তবে টাকার এ মূল্য যে দিনদিন নির্ন্মমূখী তা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি। এভাবে টাকা মূল্যহীন হতে হতে কোথায় গিয়ে ঠেকে তাই এখন দেখবার বিষয়। আর আমাদের সে অপেক্ষায়ই আপাতত থাকতে হচ্ছে।

গত দু’বছর ধরে বৃদ্ধিও চিত্রটা তুলনামূলক অনেক বেশি। কোভিড আর রাশিয়ার যুদ্ধে যতটা না বাড়ার কথা তার চেয়ে অনেক বাড়িয়েছে এদেশের সিন্ডিকেটওয়ালারা। সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হার যেমন অনেক কম ছিল, তেমনই গ্রামের বাজারে জিনিসপত্রের দাম শহরের তুলনায় কম হারে বাড়ত, আর খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হারের তুলনায় অনেক কম। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল খুবই অল্প— ২০১৯-এর এপ্রিলে মাত্র ১.৩১%। মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়ে যাওয়ার ফলে মধ্যবিত্তের তো অবশ্যই নাভিশ্বাস উঠছে, কিন্তু দাম বাড়ার প্রকোপ গরিব মানুষের উপর পড়ছে সব থেকে বেশি। এর কারণ, প্রথমত, শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি গরিব মানুষ বাস করেন; দ্বিতীয়ত, অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের তুলনায় গরিব মানুষ খাবার-দাবারের পিছনে তাঁদের আয়ের আরও বেশি অংশ ব্যয় করে থাকেন, ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে তাঁদেরই সবচেয়ে ক্ষতি এবং কষ্ট অনেক বেড়ে যায়।

টাকার দাম ফি বছরই পড়ছে কেন? বিপরিতে পণ্যেও দাম বছর বছর বেড়েই চলেছে। কিছু দিন আগেও একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে বাজারে গেলে যতটা চাল-ডাল-তেল-মশলা, আনাজ, ফলমূল, মাছ-মাংস কেনা যেত, এখন তার থেকে কম পরিমাণে কেনা যাচ্ছে। আজকে পণ্যেও দামের সাখে পরের বছরের দাম মিলছে না। বাড়ছে সীমহিীন গতিতে। টাকার দাম পড়ে যাওয়ার আর একটা মানে হল, বিদেশি মুদ্রার বাজারে টাকার নিরিখে আমেরিকান ডলারের দাম বাড়ছে সবসময়। অর্থাৎ, প্রতিটি ডলার কিনতে বছর ঘুরলেই বেশি টাকা লাগছে। তাই পণ্যমূল্য দিনদিন অসহনীয় হচ্ছে। এ বছরের চিত্রটা দেখলেই বুঝা যাবে বছরবছর কিভাবে দাম বাড়ছে। এপ্রিল মাসে দেশে খুচরো পণ্যের বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৭৯%। তার মানে, ২০২১ সালের এপ্রিলে খুচরো বাজারে জিনিসপত্রের দাম যা ছিল, তার তুলনায় ২০২২-এর এপ্রিলে জিনিসপত্রের দাম ৭.৭৯ শতাংশ বেড়েছে। তুলনার জন্যে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০২২-এর মার্চ মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৯৫%, আর ২০২১-এর এপ্রিল মাসে ৪.২৩%। সম্প্রতি বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে যে হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে তার তুলনায় বেশি হারে। ২০২২-এর এপ্রিলে শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হার ৭.০৯%, গ্রামাঞ্চলে ৮.৩৮%।

পাহাড়ী এলাকায় এ মূল্য বৃদ্ধিও হার আরও বেশি। সাম্প্রতিক কালে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার অনেক বেশি— গ্রামে, এবং শহরে। গ্রামে ৮.৫%, শহরে ৮.০৯%। অর্থাৎ, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিই মূলত খুচরো বাজারে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হারটাকে ঠেলে তুলে দিচ্ছে। এভাবেই বছরবছর বাড়ছে পণ্যেও দাম। একবার কোন কিছুর দাম কোন কারণে বাড়লে আর তা কমে না। তাই বছর যত যাচ্ছে পণ্যেও দামও বাড়ছে। বাড়ার হারটা যে বেশি এটা কেই খেয়াল রাখছে না। কষ্টের কথা হলো-বিভিন্ন পণ্যের শতকরা হারে কত ভাগ দাম বেড়েছে, তা হয়তো সার্বক্ষণিকভাবে হিসাব করে রাখার মতো কোনো সংস্থা নেই দেশে। বাংলাদেশের অর্থনীতি পরিচালনায় এমন নীতি কখনো গ্রহণ করা হয়নি। তাই দেশে চাল, ডাল, আটা, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যেই দাম বেড়েই চলেছে। টাকা যেন একবারেই মূল্যহীন হচ্ছে।

লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test