চৈত্র সংক্রান্তির সেকাল-একাল

গোপাল নাথ বাবুল
মধ্য বয়সের ভাবনায় বেশ জাঁকিয়ে বসে ‘ফেলে আসা দিনগুলো’। নানা গল্পে, গানে, কাব্যে ধরা দেয় অতীতের স্মৃতিগুলো। প্রতিনিয়ত নাড়া দেয় মনের আবেগ মাখানো অনুভূতিগুলো। মনে ভেসে ওঠে শাহ আবদুল করিমের গান- ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাতাম’। সঙ্গে চলতে থাকে নস্টালজিক হওয়া। জেগে ওঠে ‘বার মাসে তের পার্বণ’ আমাদের প্রাণ, আমাদের মনন, আমাদের হৃদয়ের সুরমালিকা। যদিও বর্তমান সময়ে মনে থাকে না কোন সময় বাংলা মাস-তারিখ আসে-যায়। বাংলা ক্যালেন্ডার কেউ এখন দেখে না। হিন্দুদের প্রতি ঘরে ঘরে দিন পঞ্জিকা থাকে। কোনও বিয়ে-শাদী বা পূজা-অর্চনার সময় পঞ্জিকা দেখে দিন-তারিখ ঠিক করা ছাড়া অন্য কোনও কাজে এ প্রয়োজনীয় বইটি কেউ ব্যবহার করেন না। যখন চৈত্র শেষে হাওয়ায় ভাসে মিঠে জিরার গন্ধ। তখনই মনে পড়ে চৈত্র সংক্রান্তি কথা।
এবারও প্রতি বছরের ন্যায় চৈত্রের অবসানে বর্ষ পরিক্রমায় ঘুরে এলো চৈত্র সংক্রান্তি। অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিন। এ চৈত্র সংক্রান্তি আবহমান বাংলার চিরাচরিত বিভিন্ন ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে। উৎসব প্রিয় বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে চৈত্র সংক্রান্তির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এখন চৈত্র সংক্রান্তির রূপ পাল্টে গেছে। সময়ের সঙ্গে উৎসবের রঙ পাল্টানোর ফলে এবং আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আগেকার অনেক অনুষ্ঠান সূচী কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
ছোটবেলায় চৈত্র সংক্রান্তি মানে ছিল এক বিশাল আনন্দ। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যেত। শিব-পার্বতী ও বিভিন্ন ধরনের বহুরূপী সেজে ঢাকিরা ঢাকের বাদ্যি নিয়ে নেচে নেচে পাড়ায় পাড়ায় এবং প্রতি বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে চাল-ডাল-তরকারি তুলতেন আর আমরা ছোটদের দল মহানন্দে তাদের পিছনে পিছনে ঘুরে সময় কাটাতাম। কারণ, ছোটদের জন্য বিনোদন বলতে ছিল খেলাধুলার বাইরে সন্ধ্যাবেলায় কারও বাড়ির বৈঠক গানের আসর। এক কাপ চা আর একটা বেলা বিস্কুট গানের আসরের আনন্দ বাড়িয়ে দিত। তখন বছরে একবার গাজন নাচের অনুষ্ঠানগুলো ছোটদের জন্য ছিল অত্যাধিক আনন্দে বিষয়। তাই বছরের শেষ দিন হিসেবে পুরাতনকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করার জন্য প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে থাকত বিভিন্ন অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন। চৈত্র সংক্রান্তি ছিল বাঙালির আরেক বড় অসম্প্রদায়িক উৎসব পহেলা বৈশাখকে বরণ করার উৎসব। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা চৈত্র সংক্রান্তির দিন শাস্ত্র মেনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস-সহ নানা আচার-অনুষ্ঠান করতেন। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে মানে আগের সব পুরনো জঞ্জাল পরিষ্কার করে, শুচি-শুদ্ধ হয়ে পূজা-অর্চনা করে পুরনো হিসেব-নিকেষ চুকিয়ে পহেলা বৈশাখে নতুন হালখাতা খোলার প্রস্তুতি নিতেন।
চৈত্র সংক্রান্তির আগেরদিন অর্থাৎ ৩০ চৈত্র ভোরে ওঠে বিষু ফুল এবং নিমপাতা দিয়ে মালা গেঁথে ঘরের দরজা-জানালা এবং পূজার ঘর সাজানো হত। সন্ধ্যায় বিভিন্ন বনজ গাছ, ঔষধি গাছ ও লতাপাতা দিয়ে স্তুপ করে প্রত্যেক বাড়ির ঘাঁটায় আগুন জ্বালিয়ে পরিবারের ছোট-বড় সকলে স্তুপের চারপাশে ৭ বার ঘুরে ঘুরে ধোঁয়া গায়ে লাগাতেন। কারণ সবাই বিশ্বাস করতেন এ ধোঁয়া গায়ে লাগালে খোস-পাঁচড়া হবে না। ‘যাক্ যাক্ যাক্, মরো বাড়ি যাক্, আঁরো বাড়ির মশা-মাছি সাত দইরজা পার হয়ে যাক।’ এ গানটি উঁচু স্বরে গাইতে গাইতে সবাই আগুনের স্তুপের চারপাশে ঘুরত। পরেরদিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিন কাঁচা হলুদ, নিমপাতা, শস্য বেটে গায়ে মেখে স্নান করতে হত। একইভাবে গরু-ছাগল থাকলে এদেরও স্নান করানো হত এবং এদের গলায় ফুলের মালা পরানো হত। তারপর দরজায় লটকানো নিমপাতা মুখে দিয়ে বাড়ির বড়দের ও পূজা মন্ডব প্রণাম করে, নতুন জামা-কাপড় পরে চিড়া, মুড়ি, খইয়ের সঙ্গে দই মেখে খইয়ের নাড়ু, চালভাজার নাড়ু, নারকেলের নাড়ু, আটকড়ই (চালভাজা, বাদামভাজা, ছোলাভাজা, কড়ল ডাল, ফেলন ডাল-সহ আরও কয়েক পদের মিশ্রণ) প্রভৃতি খেয়ে কিছুক্ষণ পর পাঁচন (১০৮ প্রকার সব্জি দিয়ে রান্না করা নিরামিষ তরকারি) খেয়ে বের হতাম। পাঁচনে তিতকুটে খাবার থাকে প্রচুর। কারণ, এ সময় প্রচন্ড গরম থাকে বিধায় রোগবালাই দেখা দেয় বেশি। তাই এসব রোগবালাই থেকে বাঁচতে তিতা করলা, গিমা শাক, নিমপাতা ভাজি প্রভৃতি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তারপর ছোটদের দল এ বাড়ি ওই বাড়ি গিয়ে পাঁচন খেতাম। সেকি মহা আনন্দ!
ভোর থেকে আমাদের দোহাজারীর জমিদার ভগীরথ সিং হাজারীর বাড়ির উঠানে শুরু হত ক্ষেত্রপাল পূজা। ক্ষেত্রপালে ঢাকিদের বাজনার তালে তালে কিছু কিছু মহিলা চুল খুলে দিয়ে মাথা মাটিতে আছড়াত। চট্টগ্রামের ভাষায় ওদের বলা হত গাছা। বলা হত মায়ের কৃপায় ওদের এমন অবস্থা। এসময় ওরা নাকি মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন। অনেকে তাদের মুখের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে কান নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করতেন, গাছারা কি বলছেন। হাজারীর দিঘীর পূর্ব-দক্ষিণ কোণায় হরেক রকম পসরা সাজিয়ে বসত মেলা। মেলায় বিশেষ করে মাটির খেলনার জিনিসপত্র থাকত। যেমন- মাটি দিয়ে তৈরি ঘোড়া, হাতি, গরু, পাতিল ইত্যাদি। আরও থাকত বিভিন্ন রকমের খাবার, ঘুড়ি, বাঁশি, লাটিম-সহ নানা ধরনের পণ্য। থাকত দোলনা। বিকেলে বান্দরবান থেকে এঁকে-বেঁকে নেমে এসে দোহাজারীর পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া শঙ্খ নদীতে হত নৌকা বাইচ। কোনও কোনও জায়গায় হত ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগীতা, মোরগের লড়াই, বলী খেলা, লাঠি খেলা, সংযাত্রা ইত্যাদি। কোথাও কোথাও আবার যাত্রাপালা এবং পালাগানও হত। চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক পূজা। চড়ক গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ। একজন শিব ও একজন দুর্গা সেজে নৃত্য করে এবং অন্য ভক্তরা নন্দি, ভূঙ্গী, ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব সেজে শিব-দূর্গার সঙ্গে নেচে চলে। দিন দিন হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এ পূজা এখন বাংলাদেশে কমে গেলেও ঢাকার সাভার-সহ কিছু কিছু জায়গায় এখনও অনুষ্ঠিত হয় চড়ক পূজা। তবে পশ্চিমবঙ্গে ধুমধামের সঙ্গে চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
অনেক বছর পর এবার বিশেষ কাজ থাকায় দেশের বাড়িতে ছিলাম চৈত্র সংক্রান্তির দিন। আগের সেসব অনুষ্ঠান চোখে পড়েনি। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে পরিচিত নয়। দল বেঁধে হই-হুল্লোড় করে পাড়ার ছেলেমেয়েদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাঁচন খাওয়া ওঠে গেছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। ভগীরথ সিং হাজারীর বাড়ির ক্ষেত্রপাল পূজাও আর হয়না। তাদের সে দিঘী এখন মালিকানা বদল হয়ে শামসু সওদাগরের দিঘী নাম ধারণ করেছে। সুতরাং দিঘীর পূর্ব-দক্ষিণ কোণায় আর মেলাও বসে না অনেক বছর ধরে। ঢাকিরাও আর তাদের ঢাক বাজিয়ে শিব-গৌরি ও বহুরূপী নাচিয়ে পাড়ায় পাড়ায় চাল-ডাল তুলতে আসেন না। জানা যায়, বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তাদের ব্যবসা আর হয়না। তাই তারা এখন তাদের পেশা বদলে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
তারপরও বাঙালির এ প্রিয় উৎসবটি বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাই চৈত্র সংক্রান্তির মাধ্যমে পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে সফলতা ও সমৃদ্ধির প্রত্যাশা নিয়ে পালন করব পহেলা বৈশাখ। পুরনো বছরের সমস্ত জঞ্জালকে বিদায় জানিয়ে নবরূপে বাঙালি মিলিত হবে নববর্ষের উৎসবে। এমনটাই কামনা করি।
লেখক :শিক্ষক ও কলামিস্ট।
পাঠকের মতামত:
- ফরিদপুরে নয় দিনব্যাপী ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন
- সুন্দরবনে পুশইন করা ৭৮ জনকে থানায় হস্তান্তর করেছে কোষ্টগার্ড
- ভারতীয় দুই নাগিরককে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ায় নির্বাচন কর্মকর্তাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা
- আশাশুনিতে ট্রলির ধাক্কায় মোটরসাইকেল চালকের মৃত্যু
- ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে বাস-মাইক্রোবাসের সংঘর্ষ, শিশুসহ আহত ১০
- নাটোরে রুম টু রিডের কার্যক্রম পরিদর্শন করলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা
- শ্যামনগর থানায় কোস্টগার্ডের বিরুদ্ধে প্রেস ব্রিফিং’র নামে অতিরিক্ত ২৫ ঘণ্টা থানায় আটকে রাখার অভিযোগ
- এমপি আনার হত্যার এক বছর: মরদেহের খণ্ডাংশের আশায় পরিবার
- বাজারে এলো ‘পারফরম্যান্স কিং’‘রিয়েলমি ১৪ ৫জি’ এবং ‘রিয়েলমি ১৪টি ৫জি’
- ঈশ্বরগঞ্জে পরীক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিক শিক্ষামূলক লিফলেট বিতরণ
- পাল্টে গেছে ভূমি অফিসের চিত্র
- আমরণ অনশনে ববি শিক্ষার্থীরা অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি চারজন
- শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৬০০ হত্যা মামলার তদন্তই শেষ করতে পারেনি পুলিশ
- মাদারীপুর জেলা হাসপাতালের দরপত্রে অনিয়মের অভিযোগে দুদকের অভিযান
- জাপাসহ আরও কয়েকটি দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ চায় জুলাই ঐক্য
- গণহত্যা ও জেনোসাইডের যে ব্যাখ্যা দিলেন চিফ প্রসিকিউটর
- বাংলাদেশকে আইএমএফ’র সুখবর
- ভিয়েতনামে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সহায়তা দেবে রসাটম
- ৪ দিনের রিমাণ্ডে সাবেক এমপি মমতাজ
- ৩ দোকানে অগ্নিকাণ্ড, আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি
- ঈশ্বরদীর বিএনপি নেতা বিষ্টু সরকারের মাতার পরলোকগমন
- পিরোজপুর ইউনিয়ন কৃষি পরামর্শ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ
- ২ জনের যাবজ্জীবন, ৯ জনের ১০ বছর জেল
- গৌরনদীতে ৩ দিনব্যাপী কৃষি মেলার উদ্ধোধন
- গৌরনদীতে ইউপি চেয়ারম্যানদের বরখাস্ত ও গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ
- লোহাগড়ায় সাংবাদিক সৈয়দ সজিবুর রহমানের ওপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন
- ‘শেয়ারবাজারের উন্নয়নে সবাই মিলে কাজ করতে হবে’
- ঘরের মাঠেও হার, সেমিফাইনাল থেকে বিদায় মেসিদের
- ৩২ বছর পর বাল্যবন্ধুকে হত্যা মামলায় বন্ধুর যাবজ্জীবন
- ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন চান বাম দলের নেতারা
- নড়াইল ন্যাশনালিস্ট ব্লাড ব্যাংকের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত
- ‘আরব বিশ্ব চুপ থাকলেও বাঙালি মুসলমান চুপ করে নেই’
- 'আ'লীগের নেতা নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির জন্ম হয়'
- বাংলাদেশের স্থপতি মেরিনা পেলেন সম্মানজনক সন পদক
- মহেশখালী উপজেলার পুষ্টি সমন্বয় কমিটির সভা
- শাস্তি পেলেন কলকাতার স্পিনার বরুণ
- বছরে ২০ লাখ প্রিমিয়াম ইকোনমি আসন অফার করবে এমিরেটস
- রাজৈরে বিএনপি নেতা শেখ জাকিরের সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত
- সাতক্ষীরা টিভি ক্যামেরা জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি আরিফুলের সুস্থতা কামনা
- শ্রমিক সংকটে ধান কাটা নিয়ে শঙ্কিত নড়াইলের কৃষক
- সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে এমিরেটস’র ‘ডোনেশন ম্যাচিং’ ক্যাম্পেইন
- সুবর্ণচরে পানির সংকট নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপের আশ্বাস দিলেন কৃষি সচিব
- বিকেএমইএ নির্বাচন, নিরঙ্কুশ জয়ে আবারও হাতেম প্যানেল
- ‘সিগারেটে যথাযথ কর না বাড়ায় জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়েছে’
- ‘কোনো ফ্যাসিস্টের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই’