E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমাদের মুক্তি সংগ্রামের এক স্ফুলিঙ্গ শিব নারায়ণ দাস

২০২৪ এপ্রিল ২০ ১৬:১৭:৪৩
আমাদের মুক্তি সংগ্রামের এক স্ফুলিঙ্গ শিব নারায়ণ দাস

গোপাল নাথ বাবুল


স্বাধীন দেশের অস্তিত্ব জানান দিতে পত্ পত্ করে উড়া স্ত্রীবাচক একটি শব্দের নাম ‘পতাকা’। ভয়কে জয় করা ইংরেজি ফ্ল্যাগ বা বাংলায় নিশান কিংবা পতাকা বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন আকারে, বিভিন্ন রঙে ব্যবহার করে। পতাকা বা ঝান্ডা দেশের নাগরিককে দেশপ্রেমিক হতে শেখায়। শোক, আনন্দ ও বিপজ্জনক অভিব্যক্তি বোঝাতে পতাকা ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি দেশ শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিতে ‘পতাকা’ ব্যবহার করে।

অত্যন্ত পবিত্র এ ‘পতাকা’র প্রচলন হয় অনেক অনেক দিন আগে। একটি জাতি বা একটি দেশের পরিচয় তুলে ধরতে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে একটি দেশের সেনাবাহিনীর আত্মপরিচয় ও সাংকেতিক চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করতে পারস্যে খৃষ্টপূর্ব ৫৫০ হতে ৩৩০ অব্দে প্রথম পতাকার প্রচলন হয়। তারপর থেকে ধীরে ধীরে এ পবিত্র বস্ত্রখন্ডটির ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ১৩ শতকে ডেনমার্ক রাষ্ট্রের প্রতীক হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে ‘পতাকা’র ব্যবহার শুরু করে। তবে গতানুগতিকতার বাইরে এসে যুক্তরাষ্ট্র ১৪ জুন, ১৭৭৭ খৃষ্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা গ্রহণ করে এবং এক নতুন নিদর্শন স্থাপন করে। তাই যুক্তরাষ্ট্রকে পতাকার ইতিবাচক পরিবর্তনের অগ্রনায়কও বলা হয়। এরপর গতি-ক্ষিপ্রতা-বিচক্ষণতা নিয়ে ফ্রান্স ১৭৯৪ খৃষ্টাব্দে তাঁদের জাতীয় পতাকার উদ্ভব ঘটায়। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাটি সবুজ জমিনের ওপর লাল বৃত্ত খচিত।

দেশের সবুজ প্রকৃতি ও তারুণ্যের প্রতীক হল সবুজ রঙ এবং বৃত্তের লাল রঙ উদীয়মান সূর্য ও মুক্তির লড়াইয়ে শহীদদের রক্তের প্রতীক। ৬ জুন, ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ১১৭ ও ১১৮ নম্বর কক্ষের (তৎকালীন ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর কক্ষ) এক সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে সবার আলোচনার শেষে সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। সভায় উপস্থিত ছাত্রদের দল রাত ১১টার পর পুরো পতাকার এ নকশা তৈরি করেন। তাঁদের মধ্যে উপস্থিত তৎকালীন কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শিব নারায়ণ দাস ওই পতাকার লাল বৃত্তের মাঝখানে তাঁর নিপুণ হাতে আঁকলেন বর্তমান বাংলাদেশের মানচিত্র। মানচিত্রে ব্যবহার করলেন সোনালী রঙ। সে হিসেবে তিনি প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পতাকার প্রথম অঙ্কনকারী।

কুমিল্লার আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক সতীশচন্দ্র দাসের ঘরে ১৯৪৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া এবং প্রথম ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে রাজনীতিতে আসা শিব নারায়ণ দাস আজ ১৯ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় অচিন দেশে পাড়ি জমান। আমি বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার নকশাকারীদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের মৃত্যুতে তাঁর পরিবারের সঙ্গে গভীরভাবে শোকাহত এবং তাঁর বিদেহী আত্মার সদ্গতি ও শান্তি কামনা করছি। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর তিনি ছিলেন মিছিল-মিটিংয়ের সামনের কাতারে। তিনি ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার দায়ে কারাবরণ করেন।

‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র’ বইয়ের ১২৮ পৃষ্টায় মনিরুল ইসলাম লেখেন, ‘এইসব কিছুর মধ্য দিয়ে ৬ জুনের রাতের দ্বিতীয় প্রহরের প্রায় শেষ প্রান্ত উপস্থিত। বলাকা ভবনে ছাত্রলীগ অফিস হওয়ার কারণে নিউ মার্কেটের পাশের কাঁচা বাজার সংলগ্ন এক রঙের দোকান থেকে, দোকানিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে, সোনালী রঙ ও তুলি জোগাড় করা হলো। মানচিত্রের নকশা অঙ্কন এবং রঙ করার জন্য একজন শিল্পীর প্রয়োজন দেখা দেয়। সে সমস্যাও সহজেই সমাধান হয়ে গেল। সলিমুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলন উপলক্ষে ব্যানার, ফেস্টুন আঁকার জন্য কুমিল্লা ছাত্রলীগের নেতা শিবনারায়ণ দাশ তখন সেখানে ছিলেন। শুধু ছাত্রনেতা নন, তিনি ছিলেন একজন ভালো শিল্পীও। ফলে তাকে নিয়ে আসা হয় সবুজ জমিনের মধ্যখানে লাল বৃত্তের মাঝে সোনালি রঙ দিয়ে পূর্ব বাঙলার মানচিত্র আঁকা হল।’

সেই রাতেই নিউমার্কেট এলাকার বলাকা বিল্ডিংয়ের তিনতলার ছাত্রলীগ অফিসের পাশে ‘নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্স’-এর এক বিহারী টেইলার্স মাষ্টার খালেক মোহাম্মদী পতাকার নকশা বুঝে কাজ শুরু করে ভোরের মধ্যেই কয়েকটি পতাকা তৈরি করে দেন। এ পতাকা দিয়ে দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেন। কিন্তু স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাত্র ২৭ দিনের ব্যবধানে ১২ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের পতাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় মাঝের লাল বৃত্তের ভেতর হলুদ রঙের মানচিত্রটি। কারণ মানচিত্রটি পতাকার উভয় পাশে একইভাবে প্রদর্শিত হচ্ছিল না। পতাকার যে পৃষ্টে মানচিত্রটি আঁকা হয়েছিল তার বিপরীত পৃষ্টে পতাকাটি উল্টো দেখাচ্ছিল। অর্থাৎ পতাকার উভয় পাশে সঠিকভাবে মানচিত্রটি ফুটিয়ে তোলা অসুবিধাজনক ছিল। তাই ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার পটুয়া কামরুল হাসানকে পতাকাটি পরিমার্জিত করার নির্দেশ দিলে তিনি শিবনারায়ণ দাসের ডিজাইনকৃত পতাকার লাল বৃত্তের মাঝের মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ ও তার ব্যাখ্যা সম্বলিত একটি প্রতিবেদন দেন। বর্তমানে কামরুল হাসানের পরিমার্জিত রূপটিই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এবং ১৭ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে এ পতাকা সরকারিভাবে গৃহীত হয়।

স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস ছিলেন নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ। থাকতেন ঢাকার মণিপুরিপাড়ায়। গণমাধ্যমের কোনও কিছুতেই তিনি ছিলেন না। ইতিহাসে চাপা পড়া তাঁর জীবনটি নিরবে-নিভৃতে কাটিয়ে দেন স্ত্রী গীতশ্রী চৌধুরী এবং এক সন্তান অর্ণব আদিত্য দাসকে নিয়ে। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও সরকার তাঁকে কোনও স্বীকৃতি দেয়নি। পাননি কোনও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকার নকশাকারী হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে তাঁর বাবা সতীশ চন্দ্র দাসকে গাড়ির সঙ্গে বেঁধে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হায়েনারা। বাবার লাশটিও তিনি খুঁজে পাননি।

স্বাধীন-বাংলার পতাকার বিষয়ে আলোচনাতেও তাঁর নাম উচ্চারণ হত না। এতে তাঁর কোনও আক্ষেপ ছিল না। কোনও সাংবাদিককেও এ বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিতেন না এ অভিমানী বীর মুক্তিযোদ্ধা। অনেক চেষ্টার পর দৈনিক ভোরের কাগজের প্রতিবেদক ঝর্না মণিকে বলেছিলেন, ‘আমি কিছুই চাই না। আমার কোনও চাওয়া নেই। যারা এসব বিক্রি করে চলে, তাদের কথা আলাদা। আমি ওই দলে নেই। আমি প্রচার বিমুখ। নিভৃত থাকতে ভালোবাসি। ঢাকঢোল পিটিয়ে কোনও কাজ করতে পছন্দ করি না। ক’দিন আর বাঁচব ? শুধু একটাই চাওয়া-পতাকা ভালো থাকুক। দেশ ভালো থাকুক।’

সাক্ষাৎকারের প্রতিটি কথায় ও বাক্যে ঝরে পড়েছিল বুকে জমানো আত্মাভিমান। ৩ মার্চ, ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে আয়োজিত ‘চতুর্থ জাতীয় পতাকা উৎসব-২০১৪’ এ উপস্থিত হয়েছিলেন স্বাধীন-বাংলার প্রথম পতাকা তৈরির মূল কারিগর। সেদিন জাতীয় পতাকা তৈরির ইতিহাস বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, সবুজ রঙ দ্বারা নির্দেশ করা হয়েছিল এই সবুজ বাংলার চিত্র এবং লাল রঙটি দেয়া হয়েছিল সংগ্রাম এবং জীবনের প্রতীক হিসেবে। আর মানচিত্রটি সোনালি রঙ দিয়ে আঁকা হয়েছিল এই সোনালি বাংলার প্রতীক হিসেবে। কারণ বাংলাকে তখন সবাই সোনার বাংলা হিসেবে উল্লেখ করত।

পতাকার মাঝে মানচিত্র আঁকার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছিলেন, পূর্ববাংলা এবং পশ্চিমবাংলা আলাদা করে নির্দিষ্ট ভূখন্ড বোঝাতে মানচিত্রটি দেয়া হয়, যাতে করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়। কারণ আমাদের বাংলা বলতে বুঝিয়েছি আমাদের নিজস্ব ভূ-খন্ডকে। পশ্চিমবঙ্গের ভূখন্ড অন্য একটি রাষ্ট্রের ভূখন্ড। আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত নয়। মানচিত্র সরানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, পতাকা সঠিকভাবে তুলে ধরা জাতির কর্তব্য। কিন্তু মানচিত্র থাকায় পতাকাটি আঁকা অনেক কঠিন এবং বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সহজ করে পতাকা আঁকার জন্য মানচিত্রটি সরানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

দেশের প্রতি এতবড় অবদান থাকা সত্ত্বেও অভিমানী এ বীর মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনও স্বীকৃতি পাননি। এজন্য তাঁর কোনও ক্ষোভ বা আক্ষেপ ছিল না কারও প্রতি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পতাকার প্রতি ভালোবাসা ও দেশমাতৃকার প্রতি প্রেম ছিল অটুট। নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ শিবনারায়ণ এজন্যই বলতে পেরেছিলেন, ‘আমি চাই জীবন বাজি রাখা দেশটির সার্বিক মঙ্গল। মানুষের মঙ্গল। এর চেয়ে আর কোনও বেশি চাওয়া নেই আমার।’ নিজেকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ হওয়া স্ফুলিঙ্গ জীবন এমনই। অনেক আলোর উপস্থিতির পর তার অস্তিত্ব থাকেনা। সুতরাং শিবনারায়ণ দাসের মৃত্যুতে বাঙালি হারাল এক নির্লোভ ব্যক্তিত্বকে। আমরা পুনরায় তাঁর বিদেহী আত্মার চির শান্তি কামনা করি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test