E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গৃহবন্দীদশা থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন কিশোর শেখ জামাল

২০২৪ এপ্রিল ২৮ ১৭:০৪:৪৬
গৃহবন্দীদশা থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন কিশোর শেখ জামাল

মানিক লাল ঘোষ


মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালির জীবনে আনন্দ বেদনার মহাকাব্য। কিন্তু এই সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের বীরত্ব গাঁথা এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের কাল রাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের পর ইতিহাস বিকৃতির নোংরা খেলায় নামে খুনি চক্রের দোসরা। বাঙালি ও বাংলার সংগ্রামী গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার নানামুখী ষড়যন্ত্র করে খুনিদের পৃষ্ঠপোষকরা। শুধু বঙ্গবন্ধু নয় মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু পরিবারের ভূমিকা ও যেনো কেউ জানতে না পারে এ লক্ষ্যে নানা ধরনের কুৎসা ও অপবাদ ছড়ানো হয় বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নামে। ঘাতকদের মূল লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ যেনো আবার ঘুরে দাঁড়াতে না পারে তা বাস্তবায়ন করা। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর বিভিন্ন ফরমেটে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির দোষরদের হাতে ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। আর এ কারণেই বঙ্গবন্ধু পরিবারের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান নতুন করে জাতির কাছে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা সময়ের দাবি।

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল ছিলেন একজন কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সন্তান, যার সাহসিকতা, দেশপ্রেম, মানুষকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় জয় করার শিক্ষা হতে পারে তরুণ প্রজন্মের প্রেরণার উৎস। ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

আট-দশ জন কিশোরের মতো স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা হয়নি শেখ জামালের। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ২ এপ্রিল মন্ত্রিসভা গঠন করে এবং ১৪ মে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। দুর্ভাগ্য হলো ৩০ মে পুনরায় গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। সাধারণ মানুষকে শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির আলোয় আনতে গিয়ে নিজের পরিবার-পরিজনের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। আর পিতার স্নেহ ও ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তার সন্তানরা।

আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে একজন রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে দিনের পর দিন কারাগারে কাটানো যে কত কষ্টের তা ভুক্তভোগী মুজিব উপলব্ধি করেছেন তিলতিল করে। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা আর তার আত্মীয়-স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা কতটা কষ্টের তা এক জীবনে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বেশি উপলদ্ধি করেননি কেউ। সেই দুঃসহ দিনগুলোতে ঠিক এরকম অনেক দিন চলে গেছে, যখন শিশু শেখ জামালকে নিয়ে বঙ্গমাতা তার দুঃসময় অতিবাহিত করেছেন। তবে এরপরই সকলে মিলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। শেখ জামাল ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক ও ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।

পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা শেখ জামালের গিটার শেখার প্রতি দুর্বলতা ছিল। একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে শখ পূরণ করেছিলেন কিশোর শেখ জামাল। একজন ভালো ক্রিকেটারও ছিলেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুকে অধিকাংশ সময় জেলে থাকতে হয়েছিল বলে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা এবং বড় বোন শেখ হাসিনার দিক নির্দেশনায় ছোটবেলা থেকেই মানবিক চেতনায় গড়ে তুলেছিলেন শেখ জামালকে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের নিজেদের বাড়িতে অবস্থানকালেই রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠেছিল তার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিভিন্ন সেনা কর্মকর্তার লেখায় জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ জামাল পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে গৃহবন্দী ছিলেন। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট ধানমন্ডির তারকাঁটার বেড়া দেওয়া পাকিস্তানী বাহিনীর বন্দী শিবির থেকে পালিয়ে ভারতে যান। ধরা খেলে মৃত্যু ছিল অনিবার্য। দুর্দান্ত সাহসী ও পিতার মতো দেশপ্রেমে জীবন বাজী রেখে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে ভারতের আগরতলা পৌঁছানো ছিল রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ। আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে কিশোর শেখ জামাল পৌঁছলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের কালশীতে। মুজিব বাহিনীর (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে শেখ জামাল ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ঝুঁকিপূর্ণ প্রশিক্ষণ শেষে ৯ নম্বর সেক্টরে যোগদান করেন।

দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর যুদ্ধের ফ্রন্ট থেকে যুদ্ধের পোশাকে দেশে ফিরেন শেখ জামাল। ভাইকে কাছে পেয়ে বড় বোন শেখ হাসিনা, ছোট বোন শেখ রেহানা আর ছোট ভাই শেখ রাসেলের মনে বয়েছিল আনন্দের জোয়ার, যেনো পুরো পরিবার জুড়েই ছিল সেদিন খুশির আমেজ। ঐ দিনই বিকালে পল্টনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম আয়োজিত জনসভায় উপস্থিত ছিলেন শেখ জামাল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে সামরিক পোশাকে পিতার সাথে দেখা করেন বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্র শেখ কামাল আর শেখ জামাল।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পূর্ণাঙ্গরূপে গঠিত হলে শেখ জামাল সেনাবাহিনীর লংকোর্সের প্রথম ব্যাচের কমিশন্ড অফিসার হন। ১৯৭৪ সালে শেখ জামাল যুগোশ্লাভিয়ার মিলিটারী একাডেমীতে ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্ট একাডেমী থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নিজেকে সেনা কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তোলার প্রবল আগ্রহ দেখে শেখ জামালকে বিদেশে প্রশিক্ষণের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করেছিলেন যুগোশ্লাভিয়ার সাবেক রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল টিটো।

প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে ঢাকা সেনানিবাসস্থ দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন শেখ জামাল।

সততা, দক্ষতা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ করে রেখেছিলেন সবাইকে। খুব অল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন সেনা সদস্যদের মাঝে। সৈনিক থেকে সিনিয়র অফিসার, সবারই হয়ে উঠেছিলেন নয়নমণি। কর্মজীবনের নৈতিকতা, সততা আর দেশপ্রেম এবং কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা আর অহংকারহীন জীবনযাপনে সবার হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নেন শেখ জামাল। ব্যক্তিজীবনের নানামুখী গুণ আর প্রতিভার কারণে শেখ জামাল আজ তার পরিচিতদের কাছে হয়ে আছেন ইতিহাসের উজ্জ্বল অংশ।

কর্মক্ষেত্রে সব সময়ই দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন শেখ জামাল। আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় কখনো প্রকাশ পায়নি তিনি বাংলাদেশের একজন মহান রাষ্ট্রনায়কের সন্তান। নিবাসে ব্যাটালিয়নের ডিউটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় এক সুবেদার তাকে রাতে থেকে যেতেও বলেন। যদি ঐ কালোরাতে তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ফিরে না যেতেন হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস আজ অন্যভাবে রচিত হতো। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! যে সেনা বাহিনী ছিলো তার চিন্তা-চেতনায় আর স্বপ্ন ও ভাবনায় , সেই বাহিনীরই কিছু বিপদগামী, পাকিস্তানী ও আমেরিকার মদদপুষ্ট গোষ্ঠীর হাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে নিহত হন শেখ জামাল।

১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট। কয় বছরের জীবন ছিলো শেখ জামালের? মাত্র ২২ বছরের জীবনে দেশপ্রেম আর কর্মদক্ষতার যে ছাপ রেখেছিলেন তিনি, তা আজ সবার মুখে মুখে। যদিও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইতিহাস বিকৃতির কারণে তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের সাফল্যগাঁথা অজানা অধ্যায় ছিলো। শহীদ শেখ জামাল আজ শুয়ে আছেন বনানী কবরস্থানে, তার পাশেই আছেন স্ত্রী রোজী জামাল। যিনি ওই রাতেই শহীদ হয়েছিলেন সকলের সঙ্গে। তাদের বিয়ে হয়েছিল আগের মাসে ১৭ জুলাই। ঘাতকের বুলেট তাদের স্মৃতিকে বিলুপ্ত করতে পারেনি বরং মৃত্যু অমর করেছে তাদের অবদানকে। সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সন্তান হিসেবে সবার মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল দুঃসাহসী দেশপ্রমিকের প্রতীক হয়ে। তার প্রতি বাঙালির বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা বহমান, যে গতিধারা অব্যাহত থাকবে যুগ থেকে যুগান্তর।

লেখক : ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সহসভাপতি ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য।

পাঠকের মতামত:

১২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test