E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

গুজবে গজব এবং জনমানসিকতা

২০২৪ অক্টোবর ১৪ ১৭:৫৩:৫০
গুজবে গজব এবং জনমানসিকতা

মীর আব্দুল আলীম


আমরা হুজুগে বাঙাল। গুজবে ভাসি। কান চিলে নিয়েছে কেউ বলছেতো, তার পিছু ছুটি। হাল সময়ে দেশে 'ফেসবুক' গুজবের আগুন লাগেছে। কেউ একজন কিছু একটা লেখেছেতো দেশ শুদ্ধ হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। বিজ্ঞানের উন্নতির কল্যাণে মুঠোফোন ও ইন্টারনেট এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। যোগাযোগ ক্ষেত্রে জীবনযাপনে ইতিবাচক প্রভাব থাকলেও ক্ষতির পরিমাণও নেহায়েত কম নয়। সাইবার জগৎ’এ ভুয়া তথ্য ছড়ানোর গুজব বড় বেশি ক্ষতির কারনে হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অসচেতন, অজ্ঞমানুষকে গুজবে ভাসিয়ে ফয়দা লুটছে সাইবার অপরাধীরা। গুজবে দেশের ক্ষতি যা হবার হচ্ছে; রোধ হচ্ছে না।গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। তাদের জনগণকে বোঝানোর দায়িত্বেও মাঠে নামতে হবে। গুজব মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। গুজবের প্রতিকার সচেতনতা ও কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই সম্ভব। তাতে পরিস্থিতি পুরোটা সামাল দেয়া না গেলেও যথেষ্ট উন্নতি হবে।

গুজবে বহু প্রাণও ঝড়েছে এদেশে। গুজবের শিকার হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তি জানে না, কোন অপরাধে তাকে মারা হলো। আর যারা মারছে তারাও জানে না, কেন তাকে মারছে। এভাবেই গুজবে ভর করে কোনো ঘটনার সত্য-মিথ্যার তোয়াক্কা না করে নিরপরাধ মানুষকে কখনো পিটিয়ে, কখনো আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে। সাবাবার জগতে গুজব, হুজুগ, অলীকতা, বিবেকহীনতা, মূর্খতা, নির্বুদ্ধিতা, অন্যায় হত্যা, বিচারহীনতা ও সত্য-মিথ্যার ইত্যাদি রোধ করা না গেলে দেশ এবং ব্যক্তির ক্ষতি অনিবার্য।

চারদিকে গুজব। ব্যাক্তিস্বার্থ, রাজনৈতিক স্বার্থসহ নানা স্বার্থে যে যার মতো ছড়িয়ে দিচ্ছেন গুজবের ডালপালা। যা আতংকিত করছে দেশের মানুষকে। আমাদের প্রিয় কবি শামসুর রাহমানের ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতায় কবি লিখিয়াছেন- ‘এই নিয়াছে ঐ নিল যা! কান নিয়েছে চিলে/ চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে’। বাংলাদেশের মানুষের দশাও তাই হয়েছে। বিশ্রে কোন দেশে এভাবে গুজব ছড়ানোর রেওয়াজ বোধ করি নেই। ফেসবুক, উইটিউবসহ অন্যান্য সামাজীক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করলেই গুজবের ছড়াছড়ি লখ্য করা যায়। সাইবার বিশ্লেষকরা বলছেন, গুজব সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। ১. বিনা স্বার্থে, যা কিনা অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে থাকে। এসব গুজব না বুঝে ছড়ানো হয়। যা কোনো অপরাধ বা অরাজকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয় না। ২. অরাজকতা, অপরাধ ও অরাজকতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই এসব গুজব ছড়ানো হয়ে থাকে। আমরা দেখছি মানুষ তিলকে তালে পরিনত করছে। এ প্রবণতার কারণ দেশে অশান্তি সৃষ্টি হয়। দেশকেতো বটেই গুজব মানুষকে ধংশ করে দেয়। গুজব যে কোনো মুহূর্তে সমাজের পরিস্থিতি আরও সংকটের দিকে টেনে নিয়ে যায়। হুজুগে বাঙ্গাল খবি প্রচলিত শব্দ। গুজব ছড়ানোর ইতিহাস বাংলাদেশে নতুন নয়।

সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত গুজব হলো ৮ অক্টোবার ‘খবর’ বেরিয়েছে, সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস মধ্যরাতে পদত্যাগ ছেন। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনী নাকি তার বাসভবন ‘যমুনা’ ঘেরাও করে রেখেছিলো। সেনাবাহিনী এবং বিক্ষুব্ধ সেনা সদস্যরা বিভিন্ন বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন। এমন কি সেনা প্রধানের সাথে তার তর্কবিতর্ক হাতাহাতিও নাকি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে যে গুজবটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে সে বিষয়ে বেশকিছু পোস্ট করতে দেখা গেছে মুফাসসিল ইসলাম নামক একটি অ্যাকাউন্ট থেকে। সেখানে দাবি করা হয়েছে- যে প্রধান উপদেষ্টা, সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে পরিবর্তন করার একটি পরিকল্পনা করেছিলেন এবং পরবর্তীতে সেনাপ্রধান তা জেনে যান। এ নিয়েই নাকি সেনাদের মাঝে খোব তৈরি হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন পোষ্টে পোস্টে দাবি করা হয়, এটা নিয়ে নাকি সেনাপ্রধান ও ইউনূসের মাঝে ভালোমন্দ অনেক কথাবার্তা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ড. ইউনূসকে ঘিরে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রূদ্ধশ্বাস বৈঠক চলছে। বিক্ষুব্ধ আর্মি অফিসাররা ইউনূসকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। কিন্তু এমন দাবির কোনও সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর সবটাই ছিলো গুজব।

অতীত নিকটের যোগাযোগ মাধ্যমে আরেকটি ‘গুজব’ হলো- বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে নয়, এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে অবস্থান করছেন। আলোচিত সমালোচিত এমপি শামীম ওসমানের বাসায় নাকি তিনি উঠেছেন। দেশবাসী তা বিশ্বাসও করে নিয়েছে। কিন্তু এটিরও কোনো সত্যতা মেলেনি। বরং ভারতের একাধিক সরকারি কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানিয়েছে এমন তথ্য ভিত্তিহীন। দিল্লির বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারা যায়, শেখ হাসিনা এখানে গত সপ্তাহে যেভাবে ছিলেন, এই সপ্তাহেও ঠিক একইভাবেই আছেন। ভারতের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানাও এমন তথ্য দিয়েছে। এছাড়া, দূর্গাপূজা ঘিরেও মন্দির ও প্রতিমা ভাঙা বিষয়ক কিছু গুজবও বিভিন্ন সময় সামনে এসেছে।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডির পর হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বাতাসে মিশে অ্যাসিড বৃষ্টি তৈরি ইত্যাদি গুজবের কথা এখনো আমাদের কানে বাজে। পাঠক নিশ্চয় মনে আছে পদ্মা সেতুতে নাকি রক্ত আর কল্লা (মাথা) লাগবে। এ থেকে আতঙ্ক; ছেলেধরা আর গণপিটুনি। একি অবস্থা দেশে! চোখের সামনে নিরীহ মানুষ মরছে। বড় লজ্জা লাগে। এ আতঙ্ক দূর করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিংয়ের জন্য গিয়েছি। প্রতি জায়গাতেই আমি শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করেছিলাম- 'তোমাদের কোনো বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে কি কোনো ছেলেধরা নিয়ে গেছে? কারো মাথা কেটে নিয়ে গেছে?' কেউই হ্যাঁ সূচক উত্তর দিতে পারেনি। বলেছিলাম- 'তোমরা আধুনিক যুগে বাস করছ। গুজবে কান দিচ্ছি কেন?' আরও বলছিলাম- সেতু বানাতে কি মাথা ও রক্ত লাগে? উত্তরটা আমি নিজেই দিচ্ছিলাম, শিক্ষার্থীদের বলছিলাম- "সেতুতে ভালোমানের রড লাগে, সিমেন্ট, বালু, কংক্রিট লাগে। আর লাগে মানুষের মাথার ব্রেইন অর্থাৎ বুদ্ধি। আর কত মানুষের ঘামঝরা শ্রম লাগে। সেখানে রক্ত আর মানুষের মাথার কেন প্রয়োজন হবে? শিক্ষার্থীদের বলেছি- এমন বাজে আতঙ্কে, গুজবে তোমাদের শিক্ষা থমকে যাবে। তোমরা পড়াশোনায় পিছিয়ে যাবে। আর এটাই হয়তো চায় গুজব রটনাকারীরা। বলেছি তোমরা সর্বাধুনিক জমানায় বাস করে এটা বিশ্বাস করবা কি না? সবাই এক বাক্যে বলেছে "না"। যখন বুঝালাম তখন সবাই বুঝল। আমরা বাঙালিরা যেমন সহজ সরল, সহসাই নেগেটিভ আবার পজেটিভও বটে! শুধু বুঝাতে হয়। আমরা যারা সচেতন মানুষ তাদের এই শিক্ষকতা কিংবা কাউন্সিলিংয়ের কাজটা করতে হবে সব সময়। তাহলে গুজবের গজব ছড়াতে পারবে না দুষ্টু চক্র।

গুজব মানেই কিন্তু মিথ্যা রটানো। সমাজে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে এ গুজব। সেখানে সত্য অসহায় হয়ে পড়ে। বর্তমানে নানা গুজবের ভয়াবহতায় সারাদেশের মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। দীর্ঘ হয়েছে নিরীহ মানুষের মৃত্যুর মিছিল আর গণপিটুনি। বাড্ডায় মেয়ের জন্য চিপস আনতে গিয়ে গণপিটুনিতে খুন হন। রেনু নামে এক গৃহবধূ। নিহত রেনুর ছোট্ট মেয়ে তবা এখনো অপেক্ষা করে মায়ের জন্য। তার মমতাময়ী মা নাকি তার জন্য চিপস আনবে। সে আশায় এ ছোট্ট খুকুমণিটির অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। গণপিটুনিতে নির্মমভাবে নিহত তবার মা আর কখনই ফিরে আসবে না। তবাকে কি জবাব দেব আমরা? জবাব দেয়ার ভাসা আমাদের নেই। এ জন্য আমরা বড়ই লজ্জিত।

নারায়ণগঞ্জে বাকপ্রতিবন্ধী যুবক সিরাজকেও ওরা গণপিটুনি দিয়ে মেরেই ফেলল। প্রতিবন্ধী বলে সিরাজের বউ তার বড় আদুরে মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে বেশ ক'মাস আগে। প্রাণপ্রিয় মেয়েকে সিরাজ অনেক খুঁজেছে। মেয়েকে পায়নি। শেষতক খোঁজ পেল তার কলিজার টুকরো মেয়েটা নাকি নারায়ণগঞ্জে আছে। জানতে পেরেই সিরাজ আকুল হয়ে চিপস, পুতুলসহ তার মেয়েকে দেখতে নারায়ণগঞ্জে আসে। পরের ঘটনাটা ঘটে খুবই ভয়ঙ্করভাবে। এই সিরাজকেও গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলল কটা অসভ্য খুনি মানুষ।

গুজব ছড়িয়ে ওরা একদিন হয়তো আমাকেও মেরে ফেলতে পারে। এমনই গণপিটুনিতে হয়তো আমার প্রাণ বায়ুটা আর্তনাদ করতে করতে নীল আকাশে হারিয়ে যাবে। প্রতিবন্ধী সিরাজের মতো প্রমাণ হবে আমি ছেলেধরা নই। আমি পদ্মা সেতুর জন্য কারো কলস্না কাটতে আসিনি। ততদিনে আমার কবর রচিত হবে পারিবারিক কবরস্থানে। ছি: ছি: লজ্জায় মরে যাই আমরা। রড় বেশি লজ্জা পাই আমরা। প্রতিবন্ধী সিরাজেরও নিরাপত্তা নেই এ দেশে। আমরা গুম ও খুনের জন্য মাঝে মধ্যে সরকারকে দুষি। আমরা জনগণও কম কোথায়? সারাদেশে কত না হত্যাকান্ড হচ্ছে। মানুষ মানুষকে খুন করছে। জমির জন্য, অর্থের জন্য ও নানা কারণে কথায় কথায় মানুষ খুন হচ্ছে। লজ্জা, বড় লজ্জা লাগে আমার ওসব ভেবে।

হুজুগের গজব বাংলাদেশে সব সময়ই দেখেছি। হুজুগের দাপটে হাল সময়ে শেয়ারবাজারের ২৭ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে গেছে শেয়ার লুটেরারা। সযং দরবেশ বাবার পক্ষ থেকেই এমন রটনা রটানো হয়। এ দেশে এটা নতুন নয়। বরাবরই ঘটছে। নিরীহ মানুষগুলো সর্বস্ব হারাচ্ছে। তবুও তারা হুজুগে আর লোভে শেয়ারবাজারে ছোটে যাই বারবার। ওদের বলতে গেলে লজ্জা নেই। এখানেই আমার বড় লজ্জা লাগে।

রাজধানী ঢাকায় নতুন একটা গুজব ছড়ানো হয়েছে। ডেঙ্গু মশা মারতে শুক্রবার জুমার নামাজের পর নিজ নিজ বেসিনে এক বোতল হারপিক, আর এক কেজি বিস্নচিং পাউডার ঢালার কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। তাতে নাকি ডেঙ্গু মশার ডিম ও লার্ভা ধ্বংস হয়ে যাবে। ভাবা কি যায় বিষয়টা কতটা ভয়ঙ্কর! এভাবে সবাই যদি হারপিক আর বিস্নচিং পাউডার ছেড়ে দেয় ড্রেনে তাহলে পরিবেশের কি হবে? নদীতে গিয়েও এই বিস্নচিং আর হারপিকের বিষ পড়বে। তখন পানিতে প্রাণের অস্তিত কি থাকবে? পাঠক আপনারাই বলুন ডেঙ্গু মশার ডিম কি ওসব ড্রেনে থাকে। ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার জন্ম নর্দমায় হয় না। বাড়ির পাশে পড়ে থাকা ডাবের খোসা, পলিথিন, টব এ জাতীয় পাত্রে জমা পানিতে এডিস মশার জন্ম হয়। না বুঝেই মানুষ হারপিক বিস্নচিং থিওরি ছড়াচ্ছে ফেসবুকে। মানুষের এমন মূর্খ আচরণে বড় লজ্জা লাগে।

এর আগে গুজব ছড়ানো হলো বিদ্যুৎ নিয়ে। একটি স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়াচ্ছে দেশে তিনদিন বিদ্যুৎ থাকবে না। তখন ছেলেধরার দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে পদ্মা সেতুর জন্য কলস্না কেঁটে নিয়ে আসবে। এটা পুরোপুরি গুজব। এমন আধুনিক সময়ে বাস করেও এ গুজবে কান দিয়ে আমরা আতঙ্কিত হচ্ছি। এমন লজ্জা কোথায় রাখি পাঠক আপনারাই বলুন।

এ দেশে গুজব নিয়ে আবার রাজনীতিও হচ্ছে। বিগত সরকার কোনো ব্যর্থতা ঢাকতে তা গুজব বলে চালিয়ে দিয়েছে এমনটা বহু দেখেছি। বলেছে গুজব ছড়াচ্ছে বিরোধী দলগুলো। তাতে বিভ্রন্ত ছিলো জনগন। দেখেছি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- ডেঙ্গু বিস্তারের ঘটনা নাকি গুজব। শিশু নির্যাতন, শেয়ারবাজারে লুট, খুন ও গুম কোনটা গুজব জাতির কাছে পরিষ্কার কথা বলছে বিরোধীদলের নেতারা। কোনো কিছু ঢাকতে তা গুজব বলে চালিয়ে দেয়ার অভ্যাসও কিন্তু আমাদের আছে। এসব থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।

শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সর্বত্রই গুজবের বিষয়ে জানি আমরা। ছড়াইতে দেখা যায়। আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, এশিয়ান কোথায় নাই গুজব? মৃত মাইকেল জ্যাকসনকে নিয়ে কি গুজবই না ছড়ানো হয়। তিনি বেঁচে আছেন, আর প্যারিসের রাস্তায় তাকে নাকি ঘুরতে দেখা গেছে। এমন গুজব সম্প্রতি খোদ উন্নত দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। করোনা ভাইরাস নিয়ে কি কান্ডটাই না ঘটে গেছে বিশে^। সংক্রমণের সময় সবচাইতে বড় গুজব ছিল, চীনের লোকজন বাদুড়ের স্যুপ খায়, সে কারণেই এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। পূর্বে সোশ্যাল মিডিয়ায় নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মৃত্যুর গুজব ছড়ানো হলে অনেকে শোক প্রকাশ করতে শুরু করেন।

গুজব দেশে বিদেশে সব জায়গাতেই আছে। তবে বাংলাদেশে এ প্রবণতা অনেক বেশি। তথ্য প্রযুক্তিবিদরা বলছেন-গত দু’মাসে বাংলাদেশে গুজবের পরিমাণ বেড়েছে। গুজব বৃদ্ধির একটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন তারা। তাদের মতে, দীর্ঘসময় বাংলাদেশের মানুষ বাকস্বাধীনতা পায়নি এবং গণমাধ্যমগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। তখন সাধারণ মানুষ নিয়মিত গণমাধ্যমের ওপর আস্থা হারিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে তথ্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে। সে কারণেই মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা দেখছে, সেটিকেই বিশ্বাস করতে চাইছে।
আগেও গুজবের গজব ছিল। তখন তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ত না। আঞ্চলিক সীমানার মধ্যে থাকত।

আধুনিক এ জমানায় গুজবের ডালপালা মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। গুজব ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই। অস্বীকার করা যাবে না যে, গুজব সব সমাজেই রয়েছে। বাংলাদেশেও এর শিকড় অনেক গভীরে বলেই 'চিলে কান নেয়া' প্রবাদের জন্ম হয়েছে বাংলা ভাষায়। রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক ক্ষেত্রে গুজব কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, তার ভয়াবহ নজির সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি। আর ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ২০১৭ সালে রংপুরে গুজব ছড়িয়ে হামলা চালানো হয়েছিল সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে। আমরা দেখেছি, এর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। স্বীকার করতে হবে- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিবাচক অনেক অবদানও রয়েছে। পাশাপাশি অনেক ক্ষতিকর সাইডও আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের। এটি ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচিয়ে মানুষকে যেমন কাছে এনে দিচ্ছে, তেমনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা ইস্যুতে গড়ে তুলছে ইতিবাচক উদ্যোগ। যা কিনা খুনখারাবির দিকেও গাড়াচ্ছে। গুজব এমন একটা বিষয় যা সহজেই রচনা ও রটনা করা যায়। একবার গুজব রটে গেলে তা সামাল দেয়া বড় কঠিন হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই। দেশের সরকার ও প্রশাসনের পাশাপাশি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। জনগণকে রটনার বিরুদ্ধে বাস্তবটা বোঝাতে হবে। বড় কথা, কোনো খবর শোনামাত্রই যাচাই-বাছাই ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেয়া কোনো সুবিবেচনার পরিচয় হতে পারে না।

গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। নয়া আইন তৈরি করতে হবে। ওদের চিহ্নত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। আমরা আশা করি, এ ব্যাপারে আরও কঠোর হবে সরকার। এ ছাড়া জনগণও এসব দেখে ভবিষ্যতে গুজবের পথে না হেঁটে অধিক সাবধান ও সচেতন হবে। গুজবের পিছু ছুটে মানুষ যাতে তার মূল্যবান সময়, অর্থ ও সম্মান না হারান, এই জন্য গুজব প্রতিরোধে আমাদের সচেতন ও সচেষ্ট হতে হবে। বিশেষত ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য মোকাবিলায় প্রচলিত গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইনভুক্ত এই সকল মিডিয়ার বিকাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করা জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব- কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

০৮ নভেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test