E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

শিল্প খাতের বিপর্যয়: নীতির ভুল নাকি রাজনৈতিক প্রভাব?

২০২৫ জানুয়ারি ২৭ ১৭:০০:২৯
শিল্প খাতের বিপর্যয়: নীতির ভুল নাকি রাজনৈতিক প্রভাব?

মীর আব্দুল আলীম


দেশের শিল্প খাত এক গভীর সংকটের মুখে পড়েছে। একের পর এক কারখানা বন্ধ হওয়ার ফলে বেকারত্বের হার বাড়ছে, শ্রমিক অসন্তোষ তীব্র হচ্ছে এবং অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। গত এক বছরে ১৪০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে কর্মহীন হয়েছে প্রায় ৯৪ হাজার শ্রমিক। গত এক দশকে, প্রায় ১২০০ কারখানা বন্ধ হওয়ার ফলে বেকারত্বের শিকার হয়েছে লক্ষাধিক শ্রমিক। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকরা অনেক সময় অসহায় হয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এই সংকট শুধু শ্রমিকদের জীবনকে বিপন্ন করেনি, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর একটি বড় চাপ সৃষ্টি করেছে।

সমস্যার মূলে কী?

কারখানা বন্ধ হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ বিদ্যমান। এর মধ্যে অন্যতম হলো শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ ও হস্তক্ষেপ। শিল্প খাতকে রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়ে প্রতিহিংসামূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে শ্রমিক ও উৎপাদনের ওপর। সরকারি নীতির অদূরদর্শিতাও একটি বড় কারণ। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার জন্য স্থিতিশীল নীতিমালা, নিরপেক্ষ প্রশাসনিক সহায়তা এবং কর কাঠামোর সংস্কার অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা ঠিক বিপরীত।

সম্প্রতি গাজী টায়ার কারখানার উদাহরণটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ৫ আগস্টের পর কারখানাটিতে ব্যাপক ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর ফলে পরিবহন টায়ারের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। গাজী টায়ারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কারখানার ধ্বংস শুধু শ্রমিকদের জীবিকায় আঘাত করেনি, বরং স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থায়ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে। এ ধরনের কারখানাগুলো দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখন এই টায়ার আমদানির মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে, যা একদিকে আমদানির খরচ বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিটি টায়ারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষও সমস্যায় পড়ছে।

গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের পোশাক শিল্পে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ছেন। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ৫০টির বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে প্রায় ৩৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। বিভিন্ন কারণে এই কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ, ঋণের উচ্চ সুদহার, কাঁচামাল আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় এলসির (ঋণপত্র) অভাব, জ্বালানি সংকট, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের অভাব এবং শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি। এসব কারণে অনেক উদ্যোক্তা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না এবং শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষ করে, বেক্সিমকো গ্রুপের ১৬টি পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ায় প্রায় ৩৮ হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। এছাড়া, গাজীপুরের নায়াগ্রা টেক্সটাইল, কেয়া গ্রুপসহ আরও বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যা শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

এই পরিস্থিতিতে, বন্ধ কারখানার শ্রমিকরা কাজের অভাবে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন বলে জানা গেছে। ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের একাধিক পোশাক কারখানার মালিক জানিয়েছেন, কয়েক মাস ধরে একাধিক চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় শ্রমিকরা জড়িত। পুলিশ আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে তারা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। আটকদের অনেকে বন্ধ পোশাক কারখানার চাকরিচ্যুত শ্রমিক বলে জানা গেছে। শ্রমিক ও নারী অধিকার নেত্রী তাসলিমা আখতার লিমা বলেছেন, "বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। বেতন-ভাতা পরিশোধ না করা কারখানাগুলোর শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত না করে অন্য জায়গায় কাজের সুযোগ দিতে হবে।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ না করেই কারখানা বন্ধ করে দেওয়া এসব কারখানা অবিলম্বে খুলে দেওয়া উচিত। এ বিষয়ে সরকারের তদারকি করতে হবে। কারখানা বন্ধ করলে শ্রম আইন অনুযায়ী পাওনা পরিশোধ করতে হবে।" এই পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারখানা বন্ধ ও শ্রমিক বেকারত্বের এই সংকট মোকাবিলায় সরকার, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

গত এক দশকের চিত্র

গত দশ বছরে প্রায় ১২০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে ৭ লক্ষাধিক শ্রমিক তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে। এসব কারখানার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিল পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের, যা দেশের রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ। বিদেশি ক্রেতাদের আস্থার অভাব, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া—এই সব কারণেই এসব কারখানা টিকে থাকতে পারেনি।

পণ্যের ঘাটতি ও মূল্য বৃদ্ধি

কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে সরাসরি বাজারে পণ্যের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে পরিবহন টায়ার, কাগজ, টেক্সটাইল এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিয়েছে। আমদানির উপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ায় এসব পণ্যের দাম প্রায় ২০-৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, গাজী টায়ার কারখানা ধ্বংস হওয়ার পর পরিবহন টায়ারের আমদানি করতে হচ্ছে, যা পরিবহন ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রভাব

কারখানা বন্ধ হওয়ার ফলে শুধু শ্রমিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, স্থানীয় অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। যেসব এলাকায় কারখানাগুলো ছিল, সেসব এলাকায় বাড়িভাড়া কমে গেছে এবং দোকানপাটের বিক্রি কমে গেছে। মুদি দোকান, মুচি, চায়ের দোকান থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলো মন্দার সম্মুখীন। স্থানীয় বাসিন্দারা অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন, যার ফলে সামগ্রিকভাবে চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। এই প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে পুরো অর্থনীতির জন্য একটি বড় সংকট সৃষ্টি করতে পারে।

কারখানা বন্ধে ষড়যন্ত্র ও প্রভাব

বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কারখানা বন্ধ হওয়ার পেছনে ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ জড়িত রয়েছে। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে যখন স্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা পায় না। বিদেশি পণ্যের অনুপ্রবেশ, স্থানীয় পণ্যের ওপর উচ্চ কর এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব থেকে কারখানা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা শুধু স্থানীয় শিল্পখাত নয়, দেশের অর্থনীতির ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

শ্রমিক অসন্তোষ ও এর প্রভাব

একটি কারখানা যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন তার সরাসরি প্রভাব শ্রমিকদের ওপর পড়ে। কর্মহীন শ্রমিকরা অসহায় হয়ে পড়ে এবং হতাশার মধ্যে অনেক সময় তারা বিক্ষোভ ও ভাঙচুরে জড়িয়ে পড়ে। এতে সমাজে অস্থিরতা বাড়ে এবং দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট হয়। গাজী টায়ার কারখানার ধ্বংসের পর স্থানীয়ভাবে পরিবহন খাতে টায়ারের সংকট তৈরি হয়েছে। শ্রমিকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে এই ধরনের পরিস্থিতি আরও বাড়বে।

অর্থনীতিতে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

কারখানা বন্ধ হওয়া মানে শুধুই শ্রমিকদের কর্মহীন হওয়া নয়। এটি একটি বড় অর্থনৈতিক চক্রে প্রভাব ফেলে। কাঁচামাল সরবরাহ, স্থানীয় ব্যবসা, পরিবহন খাত—এসব কিছুই এই চক্রের অন্তর্ভুক্ত। একটি কারখানা বন্ধ হলে পুরো চক্রটি ভেঙে পড়ে। এর ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমে যায়। দীর্ঘমেয়াদে এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস করে এবং শিল্প খাতকে দুর্বল করে তোলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে।

করণীয়

১. রাজনীতিকে শিল্পখাত থেকে দূরে রাখা: রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকা উচিত। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করতে হলে এগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ এবং প্রতিহিংসামূলক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।

২. শ্রমিকদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। সেইসাথে, শ্রমিকদের জন্য দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যা তাদের নতুন কর্মসংস্থানে সহায়ক হবে।

৩. উদ্যোক্তাদের জন্য উৎসাহ প্রদান: শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু রাখতে উদ্যোক্তাদের জন্য কর-প্রণোদনা, স্বল্প সুদে ঋণ এবং প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

৪. নীতিগত স্থিতিশীলতা: শিল্প খাতের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পান। কর কাঠামো সংস্কার এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করাও অপরিহার্য।

৫. উৎপাদন খাতে গবেষণা ও উন্নয়ন: উৎপাদন খাতের মানোন্নয়নের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে।

৬. শ্রমিকদের জন্য কল্যাণ তহবিল: শ্রমিকদের জন্য একটি কেন্দ্রীয় কল্যাণ তহবিল গঠন করা প্রয়োজন, যা জরুরি সময়ে তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

শিল্প খাত দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এ খাতে যদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা না যায়, তবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। এখনো সময় আছে, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে একসাথে কাজ করে শিল্প খাতের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে। শ্রমিকদের কর্মসংস্থান রক্ষা করা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা এবং রাজনীতিকে শিল্পখাত থেকে দূরে রাখা—এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করতে পারলেই আমরা একটি টেকসই অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারব।

লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test