E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

খেলাপি ঋণ আদায়ে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল গঠনে বিলম্ব কেন

২০২৫ ফেব্রুয়ারি ০৩ ১৭:১৫:৩৩
খেলাপি ঋণ আদায়ে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল গঠনে বিলম্ব কেন

চৌধুরী আবদুল হান্নান


“বিবাদী গ্রাহকের প্রতি ট্রাইবুনালের দৃষ্টিভঙ্গি যদি এমন থাকে যে, টাকা পরিশোধ করুণ, অন‍্যথায় কারাগারে যেতে হবে, তাহলে তারা ব‍্যাংকমুখী হতে বাধ‍্য হবেন।”

দেশের বর্তমান বিচার ব‍্যবস্থায় ব‍্যাংক খাত দখলে রাখা দুষ্ট চক্রকে আটকানো সম্ভব হচ্ছে না, অনেক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি রয়েছেন যারা ব‍্যাংকের মামলার কোনো পরোয়া করেন না। তারা দেখেন, তাদের নামে মামলা হলে কিছু সুবিধাও আছে। অনেক মামলা ১০ বছরেরও বেশি সময় চলতে দেখা যায়।বিবাদীর (ঋণ গ্রহীতা) পক্ষে নানা অজুহাত দেখিয়ে আদালতের কাছে বার বার সময় প্রার্থনা করেন, অন‍্যদিকে বাদী ব‍্যাংকের পক্ষে মামলা পরিচালনায় জোরালো ভূমিকা না থাকায় মামলা বছরের পর বছর চলতেই থাকে।

সুযোগ সন্ধানী এ সকল চতুর খেলাপিরা এক সময় নাম মাত্র ডাউন পেমেন্ট জমা দিয়ে বা না দিয়েই সুদ মওকুফসহ দীর্ঘ মেয়াদে পুনঃতফশিল করে নিতে সক্ষম হন। তাছাড়া, তাদের প্রতি যদি কেন্দ্রীয় ব‍্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের বাড়তি আনুকূল‍্য খাকে, তাহলে তো লুটপাটের অভয়ারণ‍্য হতে বাধ‍্য; হয়েছিলও তাই। বিপুল অঙ্কের মাসোহারার বিনিময়ে অনেককে অবাধে ব‍্যাংকের টাকা বের করে নিতে সুযোগ করে দিয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব‍্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ মাথায় নিয়ে তাদের মধ‍্যে দুই সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর এবং মাসুদ বিশ্বাস বর্তমানে কারাগারে আছেন। আসলে বেড়ায় যখন ক্ষেত খায়, সে ক্ষেত রক্ষা করা যায় না।

এদিকে ব‍্যাংকের ঋণ আদায়ের সকল স্বাভাবিক পথ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সেই কারণে, ব‍্যাংকের টাকা আত্মসাতকারী এবং বিদেশে পাচারকারী সকল প্রবল ক্ষমতাধর ব‍্যক্তিকে পাকড়াও করতে অবিলম্বে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল গঠন করতে হবে।

আমার জানা মতে, এমন প্রস্তাব ব‍্যক্তি পর্যায়ে প্রথম দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম তাঁর ৩ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধের মাধ‍্যমে। সেখানে বলা হয়েছে, আর বিলম্ব না করে প্রতিটি ব‍্যাংকের শীর্ষ দশ ঋণখেলাপিকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জন‍্য “খেলাপি ব‍্যাংক ঋণ আদায় ট্রাইবুনাল” গঠন করা হোক।

তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ ব‍্যাংক ও আর্থিক খাতের নানা সমস‍্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। ‘‘এ প্রফাইল অব ব‍্যাংক লোন ডিফল্ট ইন দ‍্য প্রাইভেট সেক্টর ইন বাংলাদেশ” নামে ২০১০ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি বই রয়েছে এবং তাতে দেশের শীর্ষ ৩১ রাঘববোয়াল ঋণখেলাপির হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠনের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলামের মতামত গ্রহণ করা হলে ব‍্যাংক ও আর্থিক খাত বিষয়ক সমস‍্যা মোকাবিলা করা সহজ হবে।

১৯৯৮ সালে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদও ট্রাইবুনাল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কারণ প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি প্রচলিত বিচার ব‍্যবস্হায় দীর্ঘসূত্রতার সমস‍্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন।

বর্তমান সরকার খুনিদের বিচার নিয়ে যতটা তৎপর, অর্থ পাচারকারীদের পাকড়াও করতে ততটা মনোযোগী নয়।

হত‍্যার চেয়ে অর্থ পাচার বেশি গুরুতর, কারণ মানুষ হত‍্যা করলে একটি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর অর্থ পাচার করলে পুরো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এটা স্বীকৃত যে, বিগত পতিত সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব‍্যাংক খাতে। অর্থ লুন্ঠন এবং অর্থ পাচারে কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না। মানুষ বলছে, যদি লুন্ঠিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত না করা যায়, তাহলে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের স্বার্থকতা রইলো কোথায়?

এখন তো অপসাশন উৎখাত হয়ে গেছে, তবু কেন দুষ্টচক্রকে ধরতে এখনই সর্বাত্মক উদ‍্যোগ নেওয়া হচ্ছে না ? বর্তমানে তো আর সেই সমস‍্যা নেই যে, ধরতে গেলে নিজের লোকই ধরা পড়বে।

বর্তমান পরিস্হিতিতে খেলাপি ঋণ ও পুঁজি পাচার মোকাবিলায় আর কালবিলম্ব না করে ট্রাইবুনাল গঠনের কোনো বিকল্প নেই।

ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না, মামলায় অযৌক্তিক দীর্ঘসূত্রতাও থাকবে না। তাই রায় বাস্তবায়নে বিলম্ব হবে না।

ট্রাইবুনাল গঠন পদ্ধতি ও কার্যাবলী কী হবে?

আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং বিচার বিভাগীয় ব‍্যক্তিদের পরামর্শক্রমে এই বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করতে হবে। দীর্ঘদিনের ব‍্যাংকিং অভিজ্ঞতার আলোকে, এর কার্য প্রক্রিয়া বিষয়ে আমার কিছু মতামত রয়েছে:

(ক) টাকা আদায়ের স্বাভাবিক সকল পদক্ষেপ সম্পন্ন হওয়ার পর মামলা দায়ের করার পূর্বে ঋণ গ্রহিতাকে চূড়ান্ত‍ নোটিশ দিতে হবে।

(খ) জামিন অযোগ‍্য গ্রেপ্তারি পরোয়ান জারি করতে হবে, তবে শর্ত থাকতে পারে যে, জামিন পেতে দাবিকৃত টাকার আংশিক অবশ‍্যই পরিশোধ করতে হবে।

(গ) জামিন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব‍্যাংকের পক্ষ থেকে মতামত রাখার সুযোগ থাকতে পারে।

(গ) “ওয়ানটাইম এক্সিট” — এই প্রক্রিয়ায় গ্রাহকের আবেদনের প্রক্ষিতে ব‍্যাংকের বেঁধে দেওয়া স্বল্প সময়ের মধ‍্যে সম্পূর্ণ বকেয়া পরিশোধের শর্তে সর্বোচ্চ সুদ মওকুফের সুযোগ রয়েছে।

(ঙ) প্রয়োজনীয় ডাউনপেমেন্ট জমা দিয়ে পুনঃতপশিল করার মাধ‍্যমে ঋণ হিসাবটি নিয়মিত করণ এবং ঋণ গ্রহীতার ব‍্যবসা চালু থাকা সাপেক্ষে ঋণের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় গ্রাহক-ব‍্যাংকার সম্পর্কের ভিত্তিতে তাকে নতুন করে ঋণ দেওয়া যেতে পারে।

(চ) বিবাদী গ্রাহকের প্রতি ট্রাইবুনালের দৃষ্টিভঙ্গি যদি এমন হয় যে — “টাকা পরিশোধ করুণ, অন‍্যথায় কারাগারে যেতে হবে।”

গ্রাহকগণ আদালতের এমন কঠোর বার্তা পেলে তারা ব‍্যাংকমুখি হতে বাধ‍্য হবেন। যে কাজ স্বাভাবিক ও সহজ পথে না হয়, সেখানে শক্তি প্রয়োগ ছাড়া গত‍্যন্তর থাকে না।

ব‍্যাংক লুটেরা ও অর্থ পাচারকারীদের কঠোর শাস্তির মাধ‍্যমে ব‍্যাংক ব‍্যবস্থা থেকে বের হয়ে যাওয়া জনগণের টাকা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া অব‍্যাহত রাখতে হবে। এভাবেই ডুবে যাওয়া ব‍্যাংক ও আর্থিক খাত চাঙা হতে শুরু করবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব‍্যাংক।

পাঠকের মতামত:

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test