E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বাঙালি সংস্কৃতিতে দোল উৎসব সার্বজনীনতা লাভ করে কবিগুরুর কল্যাণে

২০২৫ মার্চ ১৪ ১৭:১২:০৩
বাঙালি সংস্কৃতিতে দোল উৎসব সার্বজনীনতা লাভ করে কবিগুরুর কল্যাণে

মানিক লাল ঘোষ



"দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ।
ধীরে ধীরে বহিতেছে মলয় বাতাস ।।
লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ।
করিতেছে নানা কথা সুখে আলাপন।।"

সনাতনী বাঙালিদের সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে দোলপূর্ণিমা। চাইলেও দোলপূর্ণিমাকে এই সংস্কৃতি থেকে আলাদা করার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাপী সকল সনাতনী বাঙালি ছোটকাল থেকেই "দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ" লক্ষ্মীর পাঁচালির এ লাইনগুলো গৃহের মা, মাসি, পিসি, দিদি, ঠাকুমা, দিদিমাদের অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পাঠ করতে দেখে আসছে। প্রতি বৃহস্পতিবার হিন্দু নারীরা গৃহে মঙ্গল কামনায় দেবী লক্ষ্মীর পূজা করে লক্ষ্মীর পাঁচালীর এই লাইনগুলো ভক্তিযুক্ত মনে উচ্চারণ করেন।

দোল পূর্ণিমা তথা দোলযাত্রার সংস্কৃতি কীভাবে চালু হলো তা নিয়ে রয়েছে বর্ণাঢ্য একাধিক ইতিহাস। বসন্তের পূর্ণিমার এ দিনে দীনের বন্ধু ভক্তের ভগবান শ্রী কৃষ্ণ কেশি ও অরিস্টাসুর নামক অসুরকে বধ করেন। অন‍্যায়কারী, অত‍্যাচারী এই অসুরদ্বয়কে বধ করার পর সকলে আনন্দ করেন। এই অন‍্যায়কারী, অত্যাচারী অসুরদের ধ্বংসের আনন্দ মহাআনন্দে পরিণত হয়। অঞ্চলভেদে হোলি বা দোল উদযাপনের ভিন্ন ব‍্যখ‍্যা থাকতে পারে। কিন্তূ উদযাপনের রীতি এক।

বাংলায় আমরা বলি দোলযাত্রা আর পশ্চিম ও মধ্যভারতে বলে হোলি। দোল আমাদের ঋতুচক্রের শেষ উৎসব। ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন পূর্বভারতে আর্যরা দোল উৎসব পালন করতেন। পুরাকালে বিবাহিত নারী পরিবারের মঙ্গল কামনায় রাকা পূর্ণিমার সময় রঙ খেলার উৎসব পালন করতেন। দোল হিন্দু সভ‍্যতার পুরাতন উৎসব।

ভারতবর্ষের সাথে নেপাল, বাংলাদেশ, মরিশাস, গায়ানা, সুরিনাম, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো, আমেরিকা, ফিজি, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, গ্রেট ব্রিটেনসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই যেখানে হিন্দু জনগোষ্ঠীর বাস রয়েছে সেখানেই দশেরা, দেওয়ালী এবং হোলি এ প্রধান তিনটি উৎসব পালিত হয় রঙিন বর্ণাঢ্যভাবে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান এ তিনটি আনন্দ উৎসবের মধ্যে রূপে-রসে-গন্ধে হোলি বা দোল উৎসব অনন্য।

'উত্তরভারত থেকে হোলি নামটির প্রচলন। সেখানে হোলির আরেক নাম 'ফাগোয়া'। এ ফাগোয়া বা হোলিকেই সনাতনী বাঙালিরা দোলযাত্রা নামে উদযাপন করে। স্থানভেদে সারা ভারতবর্ষে বিভিন্ন নামেই এ উৎসব পালিত হয় যেমন : ওড়িশায় দোলোৎসব, মধ্যভারতে হরি (হোলি), গোয়ায় শিমাগা, দক্ষিণভারতে মদন-দহন বা কামায়ণ নামে।

"দোল্যতে অস্মিন কৃষ্ণনেতি দোলি" অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণকে দোলারোহণ করে দোল দেয়া হয়, তাই এই উৎসবের নাম দোলযাত্রা। ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে এ উৎসব আয়োজিত হয়। যে দিন অরুণোদয় কালে পূর্ণিমাতিথি লাভ হবে, সে পবিত্র দিনেই হবে দোলযাত্রা।

এই দিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা একে অন্যকে নানা রঙের আবিরে রাঙিয়ে দেন। এই দোল পূর্ণিমা উদযাপনের মাধ্যমে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয় শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধাকে।

দোলযাত্রা মূলত বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের একটি বিশেষ উৎসব। তাদের বিশ্বাস, রাধা এবং তার সখীদের সঙ্গে বৃন্দাবনে আবির খেলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। সেই ঐতিহ্য থেকেই দোল খেলার প্রথা শুরু। এ কারণে দোলযাত্রার দিন এ মতের বিশ্বাসীরা রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ আবিরে রাঙিয়ে দোলায় চড়িয়ে নগর কীর্তনে বের হন। এ সময় তারা রং খেলার আনন্দে মেতে ওঠেন।

আগে রাধা-কৃষ্ণের পুষ্পরেণু ছিটিয়ে দোল উৎসব পালন করা হলেও, সময়ের বিবর্তনে এখন ব্যবহার হয় নানা রঙের আবির। তবে উৎসবের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য অপরিবর্তিত আছে।

"কলিযুগে এই দোলোৎসব সকল উৎসবের মধ্যে অন্যতম প্রধান বলে মনে করা হয়। যথাবিধি নিয়ম ও আচার মেনে ভক্তিপূর্বক সাদা, লাল, গেরুয়া, হলুদ এই চারপ্রকারের ফল্গুচূর্ণ (আবির) দ্বারা এবং নানাবিধ সুগন্ধ দ্রব্য তাতে মিশ্রিত করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করার বিধান রয়েছে। এ দোলোৎসব কোথাও পাঁচদিন, তিনদিনব্যাপী উদযাপিত হয়। দক্ষিণাভিমুখে কৃষ্ণকে দোলযানে স্থাপন করতে হয়। এই দোলস্থ কৃষ্ণকে যারা দর্শন করে, তারা নিঃসংশয়ে সকল প্রকার পাপ হতে মুক্তিলাভ করে বলে বিশ্বাস করেন সনাতনীরা।

শাস্ত্রে প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি লাল, হলুদ, গেরুয়া এবং সাদা এ চারপ্রকারের ফল্গুচূর্ণ বা আবিরই ব্যবহার করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ফুলের পাপড়ি বা প্রাকৃতিক কোন উপাদান থেকেই আবির তৈরি করে, তবেই দোলোৎসবে ব্যবহার করার নিয়ম। চার রঙের আবিরের মধ্যেও অনেক অন্তর্নিহিত ভাব রয়েছে। একেক রঙের রয়েছে এক এক মাহাত্ম্য। যেমন লাল রাজসিকতার প্রতীক। আনন্দ উৎসব, বিবিধ অনুষ্ঠান এ সবই রাজসিকতার অংশ। হলুদ রঙ হল মায়ার প্রতীক। জগতে আমরা সকলেই মায়ার আবরণে আবদ্ধ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গায়ের বস্ত্র হলুদ। এর কারণ হল, হলুদ মায়ার আবরণকে উন্মোচিত করতে পারলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়া যায়। মায়ার আবরণ থেকে মুক্তির জন্যে আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে সাথে শাক্তমতে দেবী বগলামুখির উপাসনা করি। দেবী বগলামুখী পূজায় সকল পুষ্পাদি সহ অধিকাংশ উপাচারই থাকে হলুদ বর্ণের। হলুদ রঙের মায়ার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়ে মহামায়ার কাছে যাওয়ার জন্য। গেরুয়া রঙ হল ত্যাগ বৈরাগ্যের প্রতীক। সাদা হল সত্ত্বগুণ সম্পন্ন পরমেশ্বরের প্রতীক, সাত্ত্বিক ভাবের প্রতীক। শুধু পদ্মপুরাণ, গরুড়পুরাণ, নারদীয় পুরাণই নয় স্কনদপুরাণের বিষ্ণুখণ্ডের পুরুষোত্তম মাহাত্ম্যে দোলযাত্রার শাস্ত্রীয় বিধিমালা সুবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দোলোৎসবে গোবিন্দের পূজা করতে হয়। যারা দোলে পূজা অবস্থায় গোবিন্দের দর্শন করে, তারা মুক্তি লাভ করেন।

ঋতুরাজ বসন্তের পূর্ণিমাতিথি সৌন্দর্যময়তায় অনন্য; এই বসন্তপূর্ণিমাতে প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে যুবক-যুবতীর চির আকাঙ্ক্ষিত কামদেব মদনের উপাসনা। অসংখ্য সংস্কৃত গ্রন্থে এর বিবরণ পাওয়া যায়। সপ্তম শতাব্দীর প্রখ্যাত কবি স্থাণীশ্বরের রাজা মহারাজ হর্ষবর্ধনের বিখ্যাত নাটকত্রয়ীর অন্যতম রত্নাবলীতে সেই সময়ের বসন্ত উৎসবের একটা প্রামাণ্য দলিল বলা চলে। এই বসন্তোৎসবই বর্তমানে হোলি উৎসবে পরিনত। বাঙালির দোলোৎসব বর্তমানে হোলি নামেই বেশি পরিচিত হয়ে যাচ্ছে। হোলি শব্দটি সর্বভারতীয় শব্দ হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও, দোলোৎসব শব্দটিই বাঙালির সমাজ সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত। কিন্তু হোলি শব্দটি গণমাধ্যম ও লোকমুখে এত বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে যে আজ বাঙালিরাও দোলযাত্রার পরিবর্তে হোলি শব্দটিই বেশি ব্যবহার করছে।

বাঙালি সনাতনীদের প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেব দোল পূর্নিমা তিথিতে জন্ম গ্রহণ করে।এর কারনে দোলযাত্রা বা হোলি আধ্যাত্মিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল কারণ ছাপিয়ে বাঙালি জীবনে তৈরি করেছে এক অনন্য স্থান। শ্রী চৈতন্যদেবের জন্মস্থান নবদ্বীপে দোলযাত্রায় অতুলনীয় হোলি উৎসবের আয়োজন করা হয়।

শ্রীচৈতন্যদেবের সাথে সাথে বাঙালির আবেগ ও ভালোবাসার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ও জড়িয়ে গেছে এই উৎসবের সাথে। কেননা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই এ দোলকে ধর্মের আবরণ থেকে মুক্ত করে এক সর্বজনীন উৎসবে পরিণত করেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্মৃতিবাহী শান্তিনিকেতনে তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বজনীন দোল পূর্ণিমা উৎসবের প্রবর্তন করেন। দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ যোগদান করেন শান্তিনিকেতনের এ উৎসবে। শান্তিনিকেতনের গৌড় প্রাঙ্গণে বৈতালিকের মাধ্যমে শুরু হয় এ উৎসব। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকসহ বিশিষ্টজনের অংশ গ্রহণে সার্বজনীনতা লাভ করে এই উৎসব। বাসন্তী রঙের শাড়ি ও পাঞ্জাবী পরে হাতে বিভিন্ন রংয়ের আবির নিয়ে বসন্ত উৎসবে মেতে ওঠেন ছাত্র-শিক্ষক সহ সবাই। গানের সুর আর নৃত্যের তালে দিনভর চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দেশ-বিদেশের অসংখ্য শিল্পীরা অংশ গ্রহণে মুখরিত হয়ে ওঠে বিশ্বভারতীর গৌরপ্রাঙ্গন।

"ওরে গৃহবাসী খোল্‌, দ্বার খোল্‌, লাগল যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌॥
রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে,
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে,
নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।
দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌॥
বেণুবন মর্মরে দখিন বাতাসে,
প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে।
মউমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিনা,
পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা,
মাধবীবিতানে বায়ু গন্ধে বিভোল।
দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌॥"

স্থান, কাল ভেদে দোল পূর্নিমা বা দোল উৎসব উদযাপনের ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস থাকলেও এ দিনটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের উদযাপনের শুভবার্তা। কালের বিবর্তনে এই উৎসব এখন আর শুধু সনাতনীদের নয়। সমাজের সব স্তরের মানুষ এক হয়ে দোল খেলে। রঙিন আবিরে একে অন্যকে রাঙিয়ে দেয়, যা সমাজের মধ্যে শান্তি, ঐক্য এবং ভালোবাসা বাড়ায়। দোল উৎসব শুধু ধর্মীয় চেতনা নয়, বরং আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এই সম্পর্কের মেল বন্ধন সৃষ্টি করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

লেখক : ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সহ সভাপতি, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক এবং বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সহ সম্পাদক।

পাঠকের মতামত:

৩০ এপ্রিল ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test