E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

জীববৈচিত্র্য হারালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

২০২৫ মে ২৪ ১৭:৩৫:৪৫
জীববৈচিত্র্য হারালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

ওয়াজেদুর রহমান কনক


আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবসের তাৎপর্য বাংলাদেশে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দেশটি জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, জলবায়ু এবং মৌসুমি চরিত্রের কারণে বহু প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী ও মাইক্রোঅর্গানিজমের আবাসস্থল। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই বৈচিত্র্য আজ চরম হুমকির মুখে।

বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গেলে প্রথমে উল্লেখ করতে হয় দেশের মূল চারটি জীববৈচিত্র্য অঞ্চল: সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, হাওর-বাঁওড় অঞ্চল এবং সিলেট ও চট্টগ্রামের চিরসবুজ বনাঞ্চল। এই অঞ্চলে বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ এবং গাছপালা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, নানা প্রজাতির মাছ ও কাঁকড়া, এবং ম্যানগ্রোভ গাছের অগণন প্রজাতি বাস করে। কিন্তু সামুদ্রিক জলস্তরের পরিবর্তন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অবৈধ বন উজাড়, এবং জেলেদের অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরার কারণে এই অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশের হাওর ও বিলে শীতকালে আগত পরিযায়ী পাখিদের উপস্থিতি জীববৈচিত্র্যের একটি মূল্যবান দিক। কিন্তু নির্বিচারে শিকার, জলাশয়ের দখল, কীটনাশকের দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাখিরা দিন দিন হাওর অঞ্চল পরিহার করছে। একইভাবে চিংড়ি চাষের জন্য মিঠা পানির কৃষিজমিতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করানোর ফলে অনেক স্থানীয় মাছ ও উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে।

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ‘Convention on Biological Diversity (CBD)’ তে স্বাক্ষর করে। এরপর ‘জাতীয় জীববৈচিত্র্য কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (NBSAP)’ প্রণয়ন করা হয়, যেখানে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কৌশল, নীতিমালা এবং বাস্তবায়নের পথনির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, বন অধিদপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো এই লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায়, নীতিমালাগুলো অনেকাংশেই বাস্তবায়নের অভাবে বা রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতির কারণে কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না। যেমন, পাহাড়ি বনভূমি দখল করে বসতি স্থাপন ও কৃষি সম্প্রসারণের ফলে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক বনাঞ্চল নষ্ট হয়ে গেছে। বিলুপ্ত হয়েছে বহু পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী। নদ-নদীগুলোর দখল ও দূষণে জলজ প্রাণীর বাসস্থানও সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

শিক্ষা ও গণসচেতনতার অভাবও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বড় বাধা। অধিকাংশ মানুষ জানে না একটি কীট পতঙ্গ কিংবা একটি ছোট গাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কী ভূমিকা রাখে। মধু সংগ্রহ বা মাছ ধরা যেমন জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয়, তেমনি এসব কাজের মাধ্যমে প্রকৃতির ওপর অনিয়ন্ত্রিত চাপ দিলে তা দীর্ঘমেয়াদে সকলের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আরও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এটি শুধুমাত্র পরিবেশগত বা নৈতিক দায় নয়; বরং টেকসই উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গেও সরাসরি সম্পর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, দেশজ ধানের জাত এবং বিভিন্ন সবজির ঐতিহ্যবাহী প্রজাতি সংরক্ষণ না করলে ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদন ও কৃষি খাত সংকটে পড়বে। এছাড়া, জীববৈচিত্র্য ভিত্তিক পর্যটনের অপার সম্ভাবনাও রয়েছে, যেমন সুন্দরবন বা পার্বত্য অঞ্চলে ইকো-ট্যুরিজম।

আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস আমাদের এই বিষয়গুলো পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি কেবলমাত্র দিবস পালনের বিষয় নয়; বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের অংশ, যার মাধ্যমে আমরা পরিবেশের সঙ্গে সহাবস্থান শিখি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে হলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ যদি নিজের ঐতিহ্য, সম্পদ ও প্রাকৃতিক শক্তিকে সঠিকভাবে রক্ষা ও ব্যবহার করতে চায়, তাহলে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার হিসেবেই নিতে হবে।

আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস প্রতি বছর ২২ মে তারিখে পালিত হয়, যা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে বিবেচিত। এই দিবসটি জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব, সংকট এবং সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা।

জীববৈচিত্র্য বলতে বোঝায় পৃথিবীতে বিদ্যমান সব জীবন্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্য—যেখানে ব্যাঙ, মৌমাছি, গাছপালা, জীবাণু থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত। জীববৈচিত্র্য আমাদের খাদ্য, ওষুধ, পানীয় জল, আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ এবং জীবিকা নির্বাহে সরাসরি প্রভাব ফেলে। এটি প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে, এবং একটি টেকসই পরিবেশ নির্মাণে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। অথচ আধুনিক সভ্যতার লোভ, বাণিজ্যিক লালসা ও দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা এই জীববৈচিত্র্যকে বিপন্ন করে তুলেছে।

১৯৯২ সালে রিও ডি জেনেইরোতে অনুষ্ঠিত ‘আর্থ সামিট’-এ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি গৃহীত হয়, যেটি ‘Convention on Biological Diversity (CBD)’ নামে পরিচিত। এই চুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব সম্প্রদায় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা প্রকাশ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘ ২২ মে তারিখকে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এই দিনটি বেছে নেওয়ার পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব—এই তারিখেই জীববৈচিত্র্য চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়েছিল।

বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, অরণ্য ধ্বংস, দূষণ, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন এবং একচেটিয়া কৃষিকাজ জীববৈচিত্র্যের ওপর বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক প্রজাতি ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং আরও অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির মুখোমুখি। উদাহরণস্বরূপ, বন উজাড় করে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানো, কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার, এবং নদী ও জলাশয়ের দখল ও দূষণ বাংলাদেশের মতো দেশেও প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।

এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস আমাদের শুধুমাত্র একটি প্রতীকী উদযাপন নয়, বরং এটি একটি নৈতিক ও বাস্তব দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়—আমরা যেন প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার করি, ভোগ না করি; যেন মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে এক ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলি। শিক্ষা, সচেতনতা, গবেষণা ও নীতিনির্ধারণ—এই চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

প্রতি বছর দিবসটির জন্য একটি নির্দিষ্ট থিম নির্ধারণ করা হয়, যার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের নির্দিষ্ট দিক নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। যেমন, বিগত বছরগুলোর থিমগুলোতে ছিল 'Our solutions are in nature', 'Building a shared future for all life', ইত্যাদি। থিমগুলো শুধু শব্দ নয়, এগুলো নীতি, গবেষণা ও কর্মকৌশলের দিকনির্দেশক।

আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস শুধু পরিবেশবাদী বা সরকারি পর্যায়ের বিষয় নয়; এটি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং প্রতিটি মানুষের দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত। আজকের এই সংকটপূর্ণ সময়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলা। একে অবহেলা করার সুযোগ নেই, বরং এটাই আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের একটি প্রধান অধ্যায়।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

পাঠকের মতামত:

১৯ জুন ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test