E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ফিরে দেখা, ঘুরে দেখা: নিঃসঙ্গ এক কবির কথা

২০২৫ জুন ০৭ ১২:২১:০৬
ফিরে দেখা, ঘুরে দেখা: নিঃসঙ্গ এক কবির কথা

রহিম আব্দুর রহিম


জেলা ঠাকুরগাঁও।রুহিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত পল্লী কানি-কশালগাঁও। এই গ্রামের তাহমিদ নামের এক শিক্ষার্থী আমার নাট্যকর্মী। পড়ালেখা করে পঞ্চগড় বিষ্ণুপ্রসাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। অষ্টম শ্রেণি'র এই শিক্ষার্থী, মাঝে মধ্যে আমাকে শোনাতো তার এক দাদু কবিতা লেখেন। দাদু এখন বুড়ো হয়ে গেছেন। ওর সাথে আলাপ প্রসঙ্গে ওদের গ্রামে যাবার আগ্রহ। সেই সুবাদে কানি-কশালগাঁও যাওয়া। ২০২৫ এর ৩ জুন মঙ্গলবার, রওনা হলাম বেলা সাড়ে তিনটার লোকাল ট্রেনে পঞ্চগড় থেকে রুহিয়া উদ্দেশ্যে। ঘড়ির কাটায় চারটা ঊনিশ, রুহিয়া থেকে ব্যাটারি চালিত একটি ভ্যানের যাত্রী। 

চলছে ভ্যান কানি-কশালগাঁও এর দিকে। আঁকাবাঁকা পিচঢালা পথ, দু'ধারে সারিসারি আম কাঁঠালের গাছ। গাছে গাছে ঝুলছে ফলাদি। পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত কানি-কশালগাঁও। ঘরে ঘরে ব্যুরো ফসল তুলার ধুম। তাহমিদ তার বাবার বাইকে উঠিয়ে ঘুরে দেখালো ওই গ্রামের অলিগলি। ফসল আবাদের বিস্তরমাঠ। নিচু এলাকা হওয়ায় বছরে দুটি মাত্র ফসল হয়। এর একটি 'আমন' অন্যটি 'ব্যুরো'। এই গ্রামের হাজ্বী রাজ মাহমুদ এস্টেড এর মুতায়াল্লিহ ৮২ বছর বয়ষ্ক মোঃ বদরুল ইসলাম। এবার তাঁর সানিধ্যে সম্মৃদ্ধ হবার পালা। বসে গেলাম খড়ের তৈরি বৈঠকখানার বাঁশের তৈরি মাচায়। নানাবিধ গল্প, কখনও শৈশবের নাট্যপালায় অভিনয় করার কথা, কখনও খড় দিয়ে ফুটবল বানিয়ে ফুটবল খেলার কথা আবারও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বৈঠক খানায় রেডিওর খবর শোনতে আসা শত মানুষের ভীড় জমানোর কাহিনীসহ পাকবাহিনীদের দিনলিপি। আশ্চর্য! ৮২ বছর বয়ষ্ক এই প্রবীন ব্যক্তি একের পর এক, তাঁর স্মৃতি চারণ করছেন তো করছেন। কোন ছন্দপতন নেই। তাঁর ব্যঞ্জনাময় স্মৃতি চারণে মুগ্ধ হলাম। শোনালেন কানি-কশালগাঁও গ্রামের নামকরণের ইতিকথা। গ্রামের উত্তরে পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারি উপজেলার সীমান্ত, পশ্চিমে বালিডাঙ্গির নাগেশ্বর বাড়ির কোনা-কোনিতে অবস্থিত হওয়ায় গ্রামের নাম কানি-কশালগাঁও হয়েছে বলে তাঁর ধারণা। এবার তিনি আমাকে গবেষক হিসেবে আখ্যায়িত করে জানতে চাইলেন 'কশালগাঁও' এর নামকরণ কিভাবে হতে পারে? আমি তাঁকে জানালাম, এই এলাকায় হয়তোবা সম্ভ্রান্ত কোন ব্যক্তি ছিলেন, যার নাম ছিলো 'কশাল' , সেই ব্যক্তির নাম অনুসারে গ্রামের নাম 'কশালগাঁও হতে পারে। তবে এলাকার মাটি,প্রাকৃতিক পরিবেশ- প্রতিবেশ থেকে স্পষ্ট হয়েছে, এঁটেল মাটির এই এলাকায় একসময় ঘরবাড়ি নির্মান হতো মাটির দ্বারা। কুমারদের কাছেও এই এলাকার মাটির চাহিদা ছিলো প্রচুর। কারণ, মাটি 'কশালো' অথাৎ পানিতে 'নরম' এবং শুকনো অবস্থায় (কশা)শক্ত।যে কারণে এই এলাকার নামকরণ হয়েছে 'কশালগাঁও।'

শুধু এই গ্রাম নয়,ঠাকুরগাঁও তথা উত্তরাঞ্চলের প্রতিভাবান, লেখক, শিক্ষক, সমাজসেবী মোঃ বদরুল ইসলাম ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৫মে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হাজ্বী আব্দুর রব এবং মা মোছাঃ ছালেহা খাতুন ছিলেন ধার্মিক এবং ধনাঢ্য। জনাব বদরুল ইসলাম ১৯৬০ সালে রুহিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৬২ সালে কারমাইকেল কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৬৪ সালে দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রী পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন। দীর্ঘ সময়ব্যাপী তিনি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।সর্বশেষ ১৯৮৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি রুহিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শেষে অবসর গ্রহণ করেন। শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী এই গুণী ব্যক্তি ১৯৭২ সালের দিকে তাঁর এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন পলাশ বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়। পলাশ মানে 'রক্তরাঙা' ফুলের প্রতীক। লেখেছেন কবিতা, শৈশব-কৈশোরে অভিনয় করেছেন নাটকে। তাঁর রচিত কবিতাগুলোর মধ্যে কৃষাণ, আমরা কৃষক, শুভ্রবসন, জুম'আ-বার, মাগো, মহাসুখ ইত্যাদি। এই জ্ঞানী গুণি কবি'র অর্ধাঙ্গীনি রায়হানা বেগম বকুল মারা যান ২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর। বর্তমানে কবির দেখা শোনা করছেন তাঁর এক পুত্রবঁধূ। নিঃসঙ্গ এই কবির বৈঠকখানায় ২০২৫ এর ৪ জুন সকালের আড্ডা শেষে পঞ্চগড় ফিরেছি ভরদুপুরে।

শিক্ষক : নাট্যকার, কলামিস্ট ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

১৫ জুন ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test