E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নিউ ইয়র্কে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিলের স্মরণসভা

২০১৬ আগস্ট ০৩ ১৬:১৩:৫৪
নিউ ইয়র্কে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিলের স্মরণসভা

সাবিত্রী রায়, নিউ ইয়র্ক : নিউ ইয়র্কে প্রয়াত একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিলের মৃত্যুতে এক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয় সময় গত সোমবার সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের বাংলাদেশ প্লাজায় অনুষ্ঠিত উক্ত  স্মরণসভায় প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা বলেন, একাত্তরে পুরুষের বেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া কিংবদন্তি শিরিন বানু মিতিলকে তাঁর জীবদ্দশায় সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা বাংলা প্রেস।

স্বাধীনতার পর নারীমুক্তির আন্দোলন, ঘাতক-দালাল নির্মূলের আন্দোলন এবং বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে নিবেদিত ছিলেন তিনি। উন্নয়ন সংগঠক ও বহুমাত্রিক এই নারী শিরিন বানু মিতিলকে স্বাধীনতা পুরুস্কারসহ তাঁর নামে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের একটি ছাত্রীনিবাসের নামকরণ করার দাবি জানান হয়।

নিউ ইয়র্কস্থ পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের আয়োজনে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিলের স্মরণসভার পাশাপাশি পাবনা জেলা মুক্তিযুদ্ধের কথা বইয়ের পরিচিতি পর্বও অনুষ্ঠিত হয়। সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মুহাম্মদ ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে ও সাংস্কৃতিক কর্মি গোপাল সান্যালের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় বক্তারা বলেন, শিরিন বানু মিতিল একটি সাহসের নাম। যিনি প্রথা ও প্রতিরোধ ভেঙে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসী ভূমিকা রেখে এক অনন্যদৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন। তিনিই সেই অকুতোভয় একমাত্র নারী, যিনি মাত্র ২০ বছর বয়সে পুরুষের পোশাক পরে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। শিরিন বানু মিতিল একটি রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে।

রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোয় আলোকিত ছিল তাঁর পূর্ববর্তী দুই প্রজন্ম। নানা খানবাহাদুর ওয়াসীম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন পাবনার প্রথিতযশা আইনজীবী, সমাজসেবী এবং পাবনা পৌরসভার প্রথম সভাপতি ও জেলা বোর্ডের আজীবন সভাপতি। কথিত আছে, গরিব প্রজাদের মামলা বিনা পয়সায় করে তত্কালীন জোতদার জমিদারদের রোষানলে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু কখনোই আপস করেননি। যার জন্য সে সময় তাঁর মাথার দাম ধার্য করা হয়েছিল ১০ হাজার টাকা। গত ২০ জুলাই রাতে ৬৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহীয়সী নারী।

সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন ‘পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের কথা’ গ্রন্থের লেখক ও পাবনা পৌরসভার সাবেক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জহুরুল ইসলাম বিশু। এছাড়াও অন্যদের মধ্যে বক্তব্স্বাস,স্বীকৃতি বড়ুয়া, ফাহিম রেজা নুর, বীর মুক্তিযোদ্ধা মুকিত চৌধুরী, আহমেদ হোসেন, মিথুন আহমেদ, খোরশেদ আলম, অধ্যাপিকা হোসনে আরা, ওবায়দুল্লাহ মামুন, সুব্রত বিশ্বাস ও শিবলি সাদিক প্রমুখ।

উল্লেখ্য, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে সোভিয়েত রাশিয়ায় পড়াশোনা করতে যান মিতিল। সেখানকার গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের (পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি) পাঠ শেষ করে ১৯৮০ সালে দেশে ফেরেন তিনি।

১৯৭৪ সালে মাসুদুর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। নারীমুক্তি আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে তিনি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি স্টেপসের সাময়িকী ‘উন্নয়ন পদক্ষেপ’-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, খেলাঘর প্রভৃতি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে ও কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন আমৃত্যু।

শিরিন বানু মিতিল বেসরকারি সংস্থা প্রিপ ট্রাস্টের জেন্ডার অ্যান্ড গভর্ন্যান্স পরামর্শক ও চাইল্ড অ্যান্ড মাদার কেয়ার (সিএমসি) সেবাকেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ২০০৫ সালে ভারতের অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী কমলা ভাসিনের সঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত সহস্র সংগ্রামী নারীর তালিকায় বাংলাদেশের ১৬ জন ছিলেন।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাবনায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রবেশ করে কারফিউ জারি করে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করে। ২৭ মার্চ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়, এই যুদ্ধ ক্রমেই জনযুদ্ধে পরিণত হয়। ঘরে ঘরে মেয়েরাও এই প্রতিরোধে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই পরিস্থিতিতে উত্তাল রণক্ষেত্র শিরিনকেও অস্থির করে তোলে। ভাই জিঞ্জির তখন বলেছিল—বুবু, তুমি কি প্রীতিলতার মতো পুরুষের পোশাক পরে যুদ্ধ করতে পারো না। এ কথাটিই শিরিনকে উদ্বুদ্ধ করে। ২৮ মার্চ পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের দখলরত ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে যুদ্ধ হয়, যুদ্ধ হয় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট পুলিশ লাইনেও। সেই যুদ্ধে শিরিনও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। এই যুদ্ধে ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনা ও দুজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। সর্বত্র শুরু হয় খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ। মাত্র ৩০ মিনিট অস্ত্র চালনা শিখে এই যুদ্ধ করেন তিনি। ৩০ মার্চ পাবনা স্বাধীন হয়। ৩১ মার্চ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।

সার্বক্ষণিক কাজের সমন্বয়ের জন্য এই পরিষদের একটি কোর কমিটিও গঠন করা হয়। যার দায়িত্বে ছিলেন পাবনা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বাদশা। তিনিই জেলা প্রশাসককে শিরিনের ছেলের বেশে যুদ্ধ করার কথা জানিয়ে দেন।

পরবর্তী সময়ে স্টেটসম্যান পত্রিকায় শিরিনের ছবিসহ সাক্ষাত্কার ছাপা হলে শিরিনের ছেলে সেজে যুদ্ধ করার সুযোগটি বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদের সঙ্গে শিরিনকেও পাঠিয়ে দেওয়া হয় ক্যাম্পে। শিরিনকে আশ্রয় দেন নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্র। এখানেই নারীদের নিয়ে একটি ক্যাম্প গঠন করা হয়। সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬-এ।

সেই থেকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী সাজেদা চৌধুরী। একসময় এই ক্যাম্পের নারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৫০০-তে উত্তীর্ণ হয়; কিন্তু অস্ত্রের অভাব থাকায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই নারীদের হাতে তখন অস্ত্র তুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্ব শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে শিরিন বানুরা মুক্ত দেশে ফিরে আসেন। এখানেই শেষ হয় ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধের এক অদম্য সাহসী নারী যোদ্ধার কথা।

(এসআর/এএস/আগস্ট ০৩, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test