E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জাপান এবং বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক প্রসঙ্গে

২০১৬ আগস্ট ১৬ ২১:৪৩:৫৭
জাপান এবং বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক প্রসঙ্গে

প্রবীর বিকাশ সরকার :


জাপান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে সম্পর্ক সেটা অবশ্যই গবেষণাসাপেক্ষ। আপাতদৃষ্টিতে যা প্রতীয়মান হয় তা হলো, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জাপানের সম্পর্কটা হঠাৎ করেই হয়নি। এর পেছনে সুদীর্ঘকালের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইতিহাস কাজ করে গেছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয় বঙ্গবন্ধুকে জাপান সরকারের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জাপানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতাসহ সাধারণ নাগরিকরা শরণার্থীদের সাহায্যার্থে অর্থ তহবিল গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রী হায়াকাওয়া তাকেশি, অধ্যাপক-গবেষক ৎসুয়োশি নারা, বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা, শ্রীমতী হায়াশি তাকাকো, তানাকা তোশিহিসা, তিব্বতী নাগরিক পেমা গিয়ালপো, লায়ন তাসুগি কিয়োশি প্রমুখ নেতৃত্ব দিয়েছেন। একাধিক প্রচারমূলক প্রকাশনাও প্রকাশিত হয়েছিল। তারা বঙ্গবন্ধু তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম জানতেন বলাই বাহুল্য।

কিন্তু তারও অনেক বছর আগে, যখন শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার হয়ে বিচারের মুখোমুখি, তখন সুদূর জাপানে পাকিস্তান সরকারের এই মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। এমন ঘটনা বিদেশের আর কোনো দেশে ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। সেই ছাত্র বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইশিকাওয়া তামোন। যিনি বর্তমানে জাপানের প্রধান রাজনৈতিক এবং ক্ষমতাসীন দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ইবারাকি-প্রিফেকচার শাখার বর্ষীয়ান নেতা। ২০০০ সালে যখন তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে, তখন তিনি এই ঘটনা আমাকে বলেছিলেন। তিনি জানালেন, তখন তারা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য বিক্ষোভ করেছিলেন। আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন?

তিনি বেশ বলিষ্ঠকণ্ঠে বলে উঠলেন, কেন নয়! মি. রাহমান (শেখ মুজিবুর রহমান) হচ্ছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর শেষ অনুসারী! তুমি তো ভালো করেই জানো টেগোর (রবীন্দ্রনাথ), নেতাজি, বিহারী বোস (বিপ্লবী রাসবিহারী বসু), পাল হানজি (বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল) এদের সঙ্গে জাপানের কী গভীর বন্ধুত্ব বহু বছর ধরে। তাদের দেশ না বাংলাদেশ! সে দেশের অবিসংবাদিত নেতা, এশিয়ার লায়নহার্ট ছিলেন মি. রহমান। সুতরাং মি. রহমানের মুক্তি ছিল আমাদের একান্তই কাম্য।

ইশিকাওয়ার বক্তব্যের পূর্ণ সমর্থন পাওয়া যায় যায় ১৯৭২ সালে যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাকুয়েই তানাকা বঙ্গবন্ধুকে জাপান সফরের আমন্ত্রণবার্র্তা পাঠান তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মাধ্যমে। এরা হলেন হায়াকাওয়া তাকাশি দলীয় নেতা এবং দুজন সদস্য যথাক্রমে তানাকা মাসাআকি এবং মেজর ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি। বলাই বাহুল্য, ইশিকাওয়া, কাকুয়েই তানাকা, হায়াকাওয়া, তানাকা মাসাআকি এবং ফুজিওয়ারা এরা কট্টর ‘ন্যাশনালিস্ট’ হিসেবে সুপরিচিত। বঙ্গবন্ধুকে এরা একজন বলিষ্ঠ ‘বাঙালি ন্যাশনালিস্ট’ হিসেবেই দেখেছেন। বাঙালি জাতির বহু যুগের প্রত্যাশার আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির কাক্সিক্ষত নেতা হিসেবেই বিবেচনা করেছেন তাকে।

অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী কাকুয়েই তানাকা বঙ্গবন্ধুর সম্মানার্থে ভোজসভায় যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা শুরু করেছিলেন জাপানের মনীষী ওকাকুরা তেনশিন এবং রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্বের সম্পর্ক দিয়ে। সুতরাং বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই বিরল জাপানি-বাঙালি মৈত্রীর ধারাবাহিক সম্পর্কের উত্তরসূরি।

বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ জাপানিদের কাছে প্রিয় হওয়ার একাধিক কারণ বিদ্যমান। প্রথম কারণটি বিধৃত করেছি এর আগে যে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সুযোগ্য উত্তরসূরি এবং বাংলাদেশ নেতাজির স্মৃতিবিজড়িত দেশ।

দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, বাঙালি বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর (১৯৪৬-৪৮) টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের যা আয়োজন করেছিল মিত্রশক্তিপ্রধান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে সেই বিচারকে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশে জন্ম কলকাতা উচ্চ আদালতের বিচারপতি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. রাধাবিনোদ পাল তার বিচক্ষণ রায় দিয়ে নাকচ করে দেন; একে বলেন বিচারের নামে প্রহসন, বিজিতের প্রতি বিজয়ীর উল্লাস! তার রায় এক ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দেয় বিশ্বব্যাপী। এই তাৎপর্যপূর্ণ রায়ের ফলে জাপান হয়ে যায় নির্দোষ। এতে করে পরোক্ষভাবে জাপানের বিশুষ্ককণ্ঠে জলদান করেন বিচারপতি পাল। যে কারণে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, গবেষক, গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, প্রকৌশলী সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ বিচারপতি পালের ভূমিকাকে সশ্রদ্ধচিত্তে আজও স্মরণ করেন। আনত প্রণত তার কাছে। জাপানের টোকিও এবং কিয়োতো শহরে রয়েছে বিচারপতি পালের সুদৃশ্যমান দুটি স্মৃৃতিফলক। যা এক বিরল সম্মান এই দেশে! সুতরাং, যেহেতু বিচারপতি পাল জাপানিদের অপহৃত মানসম্মানকে উদ্ধার করার জন্য বিশেষ এক সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মূল্যায়ন করত স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছিল জাপানের সরকার।

তৃতীয় কারণটি প্রচ্ছন্ন। যেহেতু জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় বরণ করেছিল আমেরিকার কাছে, তাই সেই পরাজয়ের গ্লানি অনেকটা কাটিয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের বীরোচিত বিজয়ের আলোকে। কারণ এই বিজয়টা ছিল সরাসরি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে মদদদাতা ও সাহায্যকারী আমেরিকা ও চীনের বিরুদ্ধেও। জাপানি জনগণ এই দুটি দেশের রাজনৈতিক ভূমিকাকে মনেপ্রাণে অপছন্দ করে থাকে। কাজেই মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় জাপানি জনগণের মধ্যে বিপুল আলোড়ন তুলেছিল বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। এদের অনেকেই স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশের গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং নিরক্ষর দূরীকরণ প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করে আজও কাজ করে চলেছেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ও জাপানের তরুণসমাজ ব্যাপক প্রতিবাদ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও আন্দোলন করেছিল আমেরিকার বিরুদ্ধে।

বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালী জাপানিরা যে কী গভীরভাবে বাংলাদেশকে ভালোবেসেছিলেন তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে! যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির সার্বিক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তারা, যা জানা যাচ্ছে আবিষ্কৃত একাধিক উৎস থেকে। ১৯৭৩ সালে যেভাবে লালগালিচা বিছিয়ে বিপুল রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে জাপানে, তা এক বিরল ঘটনাই বলতে হবে! শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও জাপানি জনগণ রাজপথের দুপাশে দাঁড়িয়ে এই বীর বাঙালিকে এক নজর দেখার জন্য ভিড় করেছিলেন। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা একদিনের টিফিনের পয়সা জমিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছিল বাংলাদেশের শিশুদের সাহায্যার্থে।

মোদ্দাকথা, জাপানিরাও বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, চীনের অনেক আগেই বাংলাদেশ এশিয়ায় উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে যেত জাপানি সাহায্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু বড় দুর্ভাগ্য, ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ তো বটেই, জাপানের ভবিষ্যৎ স্বপ্নকেও ধূলিসাৎ করে দেয়! বিস্ময়াভিভূত! মর্মাহত! স্বপ্নভঙ্গ হয় জাপান!

বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, জাপান রেডক্রস সোসাইটির প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক পতাকা গবেষক ফুকিউরা তাদামাসার সঙ্গে ২০১০ সালে সাক্ষাৎকালে তিনি আমাকে বলেছিলেন, স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর বাঙালিকে বিশ্বাস করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ ছিল অবিশ্বাস্য আমাদের কাছে!

উল্লেখ্য যে, ফুকিউরা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় কয়েক মাস বাংলাদেশে জাপান রেডক্রসের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন এবং যুদ্ধের সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থও রচনা করেছেন। ফুকিউরা বাংলাদেশকে এতই ভালোবাসতেন যে, ১৯৭৪ সালে জাপানের বর্তমান সম্রাট আকিহিতোকে বাংলাদেশ ভ্রমণে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তখন সম্রাট আকিহিতো ছিলেন প্রিন্স।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের যে দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে সেটা আজও স্বাভাবিক হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতারাও কোনোদিন বঙ্গবন্ধুর জাপানি ভক্তদের খোঁজখবর নেওয়ার আগ্রহ পোষণ করেননি। এমনকি, জাপানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে এদের আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। এই ধারা এখনো অব্যাহত। বঙ্গবন্ধুর জাপানি ভক্তদের প্রায় সবাই এখন এই ধরায় অনুপস্থিত।

লেখক : জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test