E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

"বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ-শোক হোক শক্তি"

২০১৬ আগস্ট ১৭ ১৫:২৮:২২

সিকদার গিয়াসউদ্দিন : ধর্মান্ধ কিংবা ধর্মে বিশ্বাসী নয়-এমন লোকজনদের কথা বাদই দিলাম।যেটি সর্বজনবিদিত বা সর্বজনস্বীকৃত তা হচ্ছে-যে কোন ধর্মের ধর্মপ্রান লোকজন মাত্রই যে কোন কাজের শুরুতে উঠতে বসতে খেতে চলতে ফিরতে সর্বক্ষেত্রে একথায় জীবনাচারের প্রতিটি মুহুর্তে স্ব স্ব ধর্মের কোন না কোন শ্লোক অথবা যার যার ধর্ম মতে ধর্মবিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন কিছু না কিছু মনে মনে একান্তভাবে আওড়ান  আর দৈনন্দিন জীবনযাপন শুরু করেন।অনুরূপভাবে বাংলাদেশের নাম নিলেই সর্বপ্রথমেই যে নামটি চলে আসবে-তিনি আর কেউ নন-মুজিবর।

"বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।"১৯৭১'সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত 'শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের' গানটি সেদিন পূরো জাতিকে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো-সেটি দস্তুরমতো একটি ইতিহাস।দেশবন্ধু চিত্তরন্জন দাস,শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক,হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী,নেতাজী সুভাষ বোস,সূর্য্যসেন,মওলানা ভাষানী,মনিসিংহ সহ আরও আগের ও সমসাময়িক অনেকের প্রতি সর্ব্বোচ্চ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে যেটুকু বলা যায়-উনাদের অসমাপ্ত কাজকে সময় আর ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখে,ভাগ্যের বরপুত্র হিসাবে স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের একক নেতৃত্ব দেয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন কেবলমাত্র শেখ মুজিবুর রহমান।আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন আর স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যা শুরু হয়েছিল অবশেষে স্বাধীনতাকামী ছাত্রছাত্রীদের,শ্রমিক জনতার আন্দোলন,বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান ও পতাকা উত্তোলন সহ বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই ব্যাপক রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বিজয় ছিনিয়ে নেয়।

একজন বন্দি মুজিবর কত শক্তিশালী হতে পারে-১৯৭১'সালের মুক্তিযুদ্ধ আর তখনকার সময়ের বিশ্বমিডিয়া,বিশ্বনেতৃবৃন্দের বক্তব্য আর মানবতার মুক্তি আন্দোলনের দূত হিসাবে তখনকার সময়ের বিশ্বের শোষিত ও নির্যাতিত সাধারন মানুষের প্রতিক্রিয়া থেকে জানা যায়।ইদানিং প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্টি আর কিছু হাইব্রীড নামক দানবরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য নামটিকে যেভাবে ব্যবহার করছে-তা যে কোন বিবেকবান মানুষের কাম্য নয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামটি আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা আর মুক্তিসংগ্রামের নিরিখে কখনও কোনক্রমেই কোন ব্যক্তির,পরিবারের বা কোন একটি সুনির্দিষ্ট দলের একক সম্পদ হিসাবে গ্রহনযোগ্য বা বিবেচিত হতেই পারেনা।নামটি আমাদের পূরো দেশ আর জাতির সম্পদ।তাই কোন পরিবার কিংবা দল নামটিকে যাতে এককভাবে ব্যবহার করে নামটির গুনগত ও পবিত্র মাহাত্ম্যকে বিঘ্নিত না করে,রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের হাতিয়ারে পরিনত না করতে পারে-সেজন্য সমগ্র দেশে ব্যাপক জনসচেতনতার অন্য কোন বিকল্প নেই।

১৯৭১'পূর্ব সময়ে ৩২'নম্বর ধানমন্ডীর বাসভবনে বেগম ফজিলতুন্নেসা মুজিব,সিরাজুল আলম খান,শেখ ফজলুল হক মনি সহ বি এল এফ নেতৃবৃন্দ,চার খলিফাখ্যাত ছাত্রনেতাদের গোপন বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করা হয়-স্বাধীন দেশটি কি নামে অভিহিত হতে পারে?বঙ্গবন্ধু অনেক সময় নিয়ে যখন বলে উঠেন-''বাংলাদেশ"নামটি কেমন হবে!! তখন বেগম মুজিব সহ একত্রে একযোগে বলে উঠে আমরাও তাই ভেবেছিলাম।ঠিক করেছিলাম।বঙ্গবন্ধু সহ সকলেই একযোগে হেসে উঠেছিলেন সেদিন।বঙ্গবন্ধুর মূখ থেকে শুনার পর সেদিন সকলের মাথা থেকে দীর্ঘদিনের এক বিরাট বোঝা নেমে গিয়েছিলো।সেই থেকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শব্দটি সমার্থক।একটির থেকে আরেকটিকে কখনও আলাদা করা সম্ভব নয়।একটি ছাড়া অন্যটি অপূর্ণ।

বাঙালী জাতির ইতিহাসে পনেরোই আগষ্টে স্বপরিবারে ইতিহাসের বর্বরতম পৈশাচিক হত্যাকান্ডের দিনটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শোকের দিন হিসাবে বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতি স্মরন করবেই।তাই এমতাবস্থায় পনেরোই আগষ্টের শোকের দিনটিকে শক্তি অর্জনের অন্যতম উৎস হিসাবে পরিগনিত করতে হলে পারিবারিককরন এবং দলীয়করনের বিপরীতে কেবলমাত্র কাগজে কলমে না রেখে বঙ্গবন্ধুকে পুরো জাতির সম্পদ বা একক ইনষ্টিটিউশনের আলোকে সকলকে হৃদয় থেকে বলতে দিতে হবে।

পরিবার বা দলের বাইরের সাধারন আমজনতাকে ভালোবাসা প্রকাশের অধিকার দিতে হবে।দল ও পরিবারের সদস্যদের বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ এলেই নমনীয়তা প্রদর্শন করতে হবে।অন্যদের মূখ থেকে নামটির প্রতি ভক্তিপূর্ণ আচরনকে প্রাধান্য দিতে হবে।ভুলেও দলের কোন সদস্যরা 'বাংলাদেশ বা বঙ্গবন্ধু'কে একান্তভাবে তাদের ব্যক্তিগত সম্পদের মতো সাধারন মানুষের সামনে যেনো তুলে না ধরে এবং নামটিকে কেন্দ্র করে কোন ধরনের উদ্দত্যপূর্ন আচরণ না করতে পারে-সেদিকে কড়া দৃষ্টি দিতেই হবে।আমাদের স্মরন রাখতে হবে-কিছুসংখ্যক পাকিপ্রেমীদের বাদ দিলে ১৯৭১'খৃষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে দলমত নির্বিশেষে সাতকোটি বাঙালী ঐক্যবদ্ধভাবে জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।

"বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো রাজনৈতিক জনযুদ্ধ।বঙ্গবন্ধুর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে।"২০১৪ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরের 'বাংলাদেশ প্রতিদিন'নামক সংবাদপত্রে যেটি লিখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলক আ স ম আবদুর রব।যুগের বা কালের আবর্তন বিবর্তনে আওয়ামীলীগ বিলীন হয়ে গেলেও বঙ্গবন্ধু,১৯৭১'এর মহান জনযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার সংগ্রাম অবশেষে স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ যা কখনও কোনদিন বিশ্বের মানচিত্র থেকে আর মুছে যাবেনা।

এসব কিছু বিবেচনায় রেখে আমাদের মনে রাখতেই হবে-বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর নামটিকে সামনে রেখে একাত্তরের ব্যাপক রক্তক্ষয়ী মহান জনযুদ্ধকে ভক্তিভরে স্বীকার করে বা মেনে নিয়ে কিংবা সম্মানচিত্তে মুক্তিযূদ্ধের মূল্যবোধের সামগ্রিক প্রেক্ষাপঠকে বুকে ধারন করে রাজনীতির আবর্তন বিবর্তন ব্যতিরেকে অন্য কোন বিকল্প আদৌ আছে কি?যারা তা করবেনা কিংবা অবহেলা করবে-তারা ক্রমশ:ধারাবাহিকভাবে অস্থিত্বহীন হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত সকলের স্মরন রাখা দরকার যে,একটি জাতির জন্ম বা অভ্যূদয়কে কেন্দ্র করে আগামী দিনগুলোতে কেবলমাত্র Pro Liberation বা Pro Independent শক্তিগুলো সরকার আর বিরোধী দলকে নিয়ন্ত্রন করবে।বাঙালী জাতির ইতিহাস বলে-ধর্মের নামে কিংবা উগ্র ধর্মান্ধতার বিষবাস্প ছড়িয়ে অথবা ধর্মের নামে তালবাহানা করে বেশ কিছুদিনের জন্য শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখলেও কোন না কোন সময় ব্যাপক জনরোষের মূখে শাসন ক্ষমতার পরিবর্তন আসবেই।কারন একথা সকলেই জানে-অর্থ ও ক্ষমতা কারো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারেনা।বিশেষ করে ধর্মের নামে প্রহসনমূলক শাসনক্ষমতার অবসান অনিবার্য।বাঙালী জাতির বারবার জেগে উঠার ইতিহাস আছে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা-রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হলেও বঙ্গবন্ধু ঘোষিত 'মুক্তির সংগ্রাম এখনও সূদুর পরাহত।বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশকে সত্যিকারঅর্থে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে হলে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে।

জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে মহান জনযুদ্ধের প্রেক্ষাপঠকে, মূল্যবোধকে সামনে রেখে শোককে শক্তিতে পরিনত করতে হবে। অব্যাহতভাবে জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে 'মুক্তির সংগ্রাম' চালিয়ে যেতেই হবে।দেশপ্রেম রাতারাতি তৈরী করা যায়না।এটি ছোটবেলা থেকে প্রশিক্ষনের বিষয়।১৯৭১'খৃষ্টাব্দ পরবর্তি প্রজন্ম ১৯৭৫'খৃষ্টাব্দ পরবর্তি সময় থেকে কনফিউজড ইতিহাস কিংবা বিকৃত ইতিহাসের সাথে যেভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে-তাতে রাতারাতি মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের প্রতিষ্টা সম্ভব নয়।

অবশ্য ১৯৭১'পরবর্তি প্রজন্মদের দোষারূপ করাও যাবেনা। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূর্ণীতি,শিষ্টাচার আর মূল্যবোধের পচন বিস্তৃত হয়ে গেছে। ধর্মের নামে ভন্ডামীর আর মিথ্যাচারের বহি:প্রকাশ সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে।এসবের মূল কারণ খতিয়ে দেখলে দেখা যায় যে,কেবলমাত্র বিকৃত ও কনফিউজড ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশিক্ষিত-তাদের মাঝে একদিকে যেমন দেশপ্রেম গড়ে উঠেনি-তেমনি এদের মধ্য দিয়ে দুর্নীতি বিস্তৃত হয়ে পুকুর চুরি থেকে সাগর চুরিতে গিয়ে ঠেকেছে। শিষ্টাচার আর মূল্যবোধের পচনতো দস্তুরমতো তলানীতে।তাই আর দেরী না করে যতদ্রুত সম্ভব নতুন প্রজন্মকে আমাদের মহান স্বাধীনতার সত্যিকারের ইতিহাস জানাতে হবে। যাঁর যা অবদান-শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে জনজীবনের সর্বত্র এককথায় জাতীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গোপনে আর প্রকাশ্যে আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ধারাবাহিকভাবে তা জনযুদ্ধে রূপান্তরের বিষয়টি তুলে ধরতে হবে-জানাতে হবে।

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।শুধু তাই নয়-এভারেষ্ট শৃঙ্গসম মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে সম্মানিত করতে হলে,সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর পবিত্র আত্মার শান্তির জন্য হিমালয়ের চতুর্পাশের পর্বতরাজিকেও সুশোভিত করে তুলতেই হবে।লোকালয়ের পাহাড়গুলোকেও সাজিয়ে দিতে হবে।মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠাকল্পে শোককে শক্তিতে সমৃদ্ধ করতে হলে অন্য কোন বিকল্প নেই।

(এসজি/এএস/আগস্ট ১৭, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test