E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

এনএবিসি ঝড়ে উত্তাল মন্ট্রিয়লে প্রবাসীদের মিলন মেলা

২০১৬ সেপ্টেম্বর ০৮ ১৭:৪৭:৪৯
এনএবিসি ঝড়ে উত্তাল মন্ট্রিয়লে প্রবাসীদের মিলন মেলা

সদেরা সুজন, কানাডা থেকে : কানাডার মন্ট্রিয়লে  নান্দনিকতার অর্পূব ছোঁয়ায় পর্দা নামলো নর্থ আমেরিকা বাংলাদেশ কনভেনশনের (এনএবিসি) ৩০তম আসরের। মন্ট্রিয়লে এ যাবৎকালের সর্ববৃৎ ইনডোর আয়োজনে গত ৩-৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হলো ৩০তম নর্থ আমেরিকা বাংলাদেশ কনভেশন।

হাইটেক স্ক্রীনের সুবিশাল অত্যাধুনিক মঞ্চ, সুনিয়ন্ত্রিত সাউন্ড সিস্টেম, ‘দেশের খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পিদের পরিবেশনা, আমেরিকা ও কানাডার বিভিন্ন প্রদেশের জনপ্রিয় শিল্পিদের নাচ, গান, কবিতা ছাড়াও নতুন প্রজন্মের নবীন তারকাদের ঝলমলে পরিবেশনা দু’দিনের কনভেনশনটিকে একটি সর্বাঙ্গীন, সুন্দর ও সফল কনভেনশনে পরিনত করে। পার্ক এক্সটেনশনের ৪১৯ উইলিয়াম হিংস্টন ভবনটি রং বেরংয়ের পোস্টার, ব্যানার, পতাকা, আমন্ত্রিত অতিথিদের অফুরান কথা, তুমুল আড্ডা, চা-কফি, কেনাকাটা আর প্রিয়জনের সাথে আবারো দেখার আনন্দ সব মিলে হয়ে উঠেছিলো উত্তর আমেরিকার বৃহৎ বাঙালি মিলন মেলা মিনি বাংলাদেশে পরিণত হয়েছিলো। প্রবাসের কষ্টকঠিন সময়ের মাঝেও পরিবার পরিজন নিয়ে কিছুটা সময় আনন্দঘন পরিবেশে যাপন করতে পেরেছে অনেকেই।

বর্নাঢ্য উদ্বোধনী : ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭ টায় দু’দিনের কনভেনশনের বর্নাঢ্য উদ্বোধন করেন কুইবেক পার্লামেন্টের ডেপুটি হাউজ লিডার ও লরিও-ডরিয়নের এমএনএ জ্যারি স্ক্যালোভোনো কনভেনশন উপলক্ষে নির্মিত সুসজ্জিত মঞ্চে মোমবাতি জ্বালিয়ে। এরপর একে একে মোমবাতি প্রজ্জলন করেন এনএবিসির কনভেনর ও আয়োজক সংগঠন কানাডা বাংলাদেশ সলিডারিটির সভাপতি জিয়াউল হক জিয়া এবং এনএবিসির মেম্বার সেক্রেটারী ইয়াহ্ইয়া আহমেদ, এনএবিসির সকল সদস্য, এনএবিসি চেয়ারম্যান এম.জামান, সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত হোসেন আবু, কাজী এম রহমান, মঞ্জুর হোসেন, ড. ইবরুল চৌধুরী, গোলাম মুহিবুর রহমান, ইতরাদ জুবেরী সেলিম সহ অন্যান্যরা।

এসো মেতে উঠি ঐতিহ্যের উৎসবে : এসো মেতে উঠি ঐতিহ্যের উৎসবে বা ‘লেটস সেলিব্রেট আওয়ার হেরিটেজ’ ছিলো এনএবিসি ২০১৬’র শ্লোগান। গত দু’দিনের কনভেনশনে মানুষের ঢল দেখে মনে হয়েছিলো সবাই যেনো এ শ্লোগানটিকে স্বার্থক করতে চায়। ৩ তারিখ বিকেল ৪টা থেকেই মানুষ উৎসবের আঙিনায় আসতে শুরু করেন। সময়ের সাথে সাথে তা বাড়তে থাকে। রাত ৮ টায় বিপুল সংখ্যক দর্শক আসন বিশিষ্ট হল রুমটি। বাঙালির এ ঢল ছিলো পরেরদিনও। ৪ তারিখ রাত দু’টা পর্যন্ত হাজার হাজার দর্শকে ভরা ছিলো উইলিয়াম হিংস্টন।

ফ্যাশন শো : মন্ট্রিয়লে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এ প্রজন্মের ২০ জন কিশোর-কিশোরীর পরিবেশনায় ছিলো ৩০ মিনিট ব্যাপী নজরকাড়া ফ্যাশন শো। অনিন্দ্য সুন্দর এক আবাহন ফুটে উঠে ফ্যাশন শো’র উপস্থাপনায়। দর্শকনন্দিত এ ফ্যাশন শোর কো-অর্ডিনেটর লিমা চৌধুরীর কোরিওগ্রাফিতে অনুষ্ঠিত হয় ফ্যাশন শো।

ট্যালেন্ট শো : আগামী প্রজন্মের শিল্পিদের আরেকটি মননশৈলী আয়োজন ছিলো ট্যালেন্ট শো। ২ তারিখ রাতে মূল মঞ্চের বাইরে অর্ধ শতাধিক প্রতিযোগি নিয়ে প্রায় ৪ ঘন্টা ধরে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ট্যালেন্ট শো কো-কনভেনর নিরোজ বড়–য়ার তত্ত্বাবধানে চারজন বিচারকের রায়ে বিভিন্ন পর্বে যারা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করে, তাদেরকে সমাপনী অনুষ্ঠানে মূল মঞ্চে সার্টিফিকেট ও পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ‘ক’ গ্রুপের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন দুর্বা দাসকে মেডেল পড়িয়ে দেন এনআরবি টিভির প্রধান নির্বাহী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শহীদুল ইসলাম মিন্টু। ‘খ’ গ্রুপের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন দেবজানী সরকার তিথিকে মেডেল পড়িয়ে দেন দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মাহামুদুল হাসান মানিক।

নান্দনিক কাব্য জলসা : কর্মব্যস্ত জীবনে কবিতা কখনো কখনো আনে জীবনের নান্দনিকতা। কাব্য জলসার পরিকল্পনা ও উপস্থাপনায় শৈল্পিক এ পর্বে একক ও দলীয় কবিতা আবৃত্তি করেন সঞ্জীব দাস উত্তম, নাজমা আক্তার মনি, মুফতি ফারুক, ফারহা হোসেন, শামসাদ রানা, আবুল জাকের, তোতন আফাজউদ্দিন ও রোমিও প্রোবেইরা। স্বরচিত কবিতা পড়েন কবি সুলতানা শিরিন সাজী ও আলী মজিদ।

সেমিনার : ৪ তারিখ বিকেল ৫টায় কনভেনশন ভবনের আরেক মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সেমিনার। ‘প্রবাসে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা : সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারটিতে সভাপতিত্ব করেন, এনএবিসির এ্যাম্বাসেডর ও কনকোর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ওয়াইজ উদ্দিন আহমেদ। মূল প্রবন্ধ পড়েন আবুল জাকের। সেমিনার কো-অর্ডিনেটর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু হোসেন জয়ের সঞ্চালনায় মূল আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোকেয়া চৌধুরী রেখা । পাশাপাশি আলোচনায় অংশ নেন লেখক তাজুল মোহাম্মদ এবং লেখক ও সংগঠক হামোম প্রমোদ।

দর্শকদের মাতিয়ে রাখলেন স্থানীয় শিল্পিরাও : দু’দিনের কনভেনশনে মন্ট্রিয়ল, টরন্টো, অটোয়া, নিউইয়র্ক ও মায়ামী থেকে আসা নৃত্য ও কণ্ঠ শিল্পিরা তাঁদের অনবদ্য পরিবেশনা দিয়ে দর্শক মন জয় করেন। কণ্ঠশিল্পি অনুজা দত্ত ও তার দলের নবীন শিল্পিদের সমবেত কণ্ঠে ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ দেশের গানটি দর্শকদের মন কাড়ে। উদ্বোধনী পর্বে মৃত্তিকা ঘোষ মৌ, বিজা ভট্টাচার্য্য ও মেঘনা ব্যানাজীদের কত্থক নৃত্য উপস্থিত সকলকে মোহমুগ্ধ করে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। নৃত্য শিল্পি লোপা মুদ্রা তাঁর কলামন্দির নৃত্যানুষ্ঠানের শিল্পিদের বর্ণিল নাচ দারুণ প্রশংসা কুড়ায়। এছাড়া একক কত্থক নৃত্য পরিবেশন করেন রেমিও ফ্রান্সিস পেরেরা। মায়ামী থেকে আসা ব্যান্ড দল বাংলা মে-হার্ণ’র আনিডা ও ফিউশন নৃত্য দর্শকরা উপভোগ করেন। কনভেনশনে গান পরিবেশন করেন অনুজা দত্ত, আশিক বিশ্বাস, ফারহানা শান্তা, রুমা কর, ইলমা খন্দকার, মনিকা মুনা, রিদম হাসান ও মন্ট্রিয়লের লোকজ দল।

আমন্ত্রিত অতিথি শিল্পি : আনন্দে ভরিয়ে দিলেন সকল মন। দু’দিনের কনভেনশনে একে একে মঞ্চে এলেন পাঁচ জন দেশ বরেণ্য আমন্ত্রিত কণ্ঠ শিল্পি। গান করলেন, জয় করলেন দর্শক হৃদয়, আনন্দে মন ভরিয়ে দিলেন শ্রোতাদের। নিজেরাও আনন্দিত হলেন হলভর্তি হাজার হাজার ভক্তদের দেখে। প্রথম দিন মঞ্চে গাইলেন ‘আছেন আমার মোক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার বা একবার যদি কেউ ভালোবাসতো এমন অজ¯্র জনপ্রিয় গানের কণ্ঠশিল্পি বাংলা গানের লিজেন্ড সৈয়দ আব্দুল হাদী। একের পর এক গাইলেন শ্রোতাদের সব প্রিয় গানগুলো। এই প্রথম কানাডার কোনো মঞ্চে আব্দুল হাদীর গান শুনলো মন্ট্রিয়লবাসী। অফুরান ভালোলাগায় মুগ্ধ হলো দর্শক শ্রোতা। তাঁর গানের এক পর্যায়ে মঞ্চে আসেন তাঁর কন্যা তনিমা হাদী। বাবা মেয়ের দ্বৈত পরিবেশনা পুরো হলে নিয়ে আসে অন্যরকম ব্যঞ্জনা। যেওনা সাথী চলেছো একলা কোথায়’ গানটি দু’জনে মিলে যখন গাইছিলেন, উৎফুল্ল দর্শক তুমুল করতালি দিয়ে তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে।

৪ তারিখ রাত দেড়টা পর্যন্ত মন্ট্রিয়লবাসী নেচে গেয়ে আনন্দের সাথে শুনতে থাকেন চিরকালের চিরসবুজ কণ্ঠশিল্পি কুমার বিশ্বজিতের গান। ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে বা তুমি রোজ বিকেলে আমার বাগানে ... এ ধরণের জনপ্রিয় গানগুলো গেয়ে যেতে থাকেন ভক্তদের তুমুল উচ্ছ্বাস আর হাততালির মধ্যদিয়ে।

এ প্রজন্মের হার্টথ্রব আঁখি আলমগীর মঞ্চে আসার সাথে সাথেই পুরো হলে যেনো বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। শুধু তরুণ প্রজন্ম নয়, বয়সের কথা ভুলে গিয়ে অনেকেই হয়ে উঠেন তরুণ। আঁখির গানের সাথে সাথে মেতে উঠেন নৃত্যে। মধ্যরাতের ক্লান্তি বা ঘুম ছিলো না কারো চোখে মুখে।

৩ তারিখ মঞ্চে সঙ্গীত পরিশেন করেন ‘আমি বাংলার গান গাই’ খ্যাত গণ মানুষের শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু। তিনি তাঁর বিখ্যাত সিডি মৃত্তিকার গানগুলো দরাজ কণ্ঠে পরিবেশন করেন। দু’দিনের মঞ্চে যন্ত্র সঙ্গীতে ছিলেন মন্ট্রিয়লের লিটন ডি কস্তা, শফিউল ইসলাম ও মেহেদী ফারুক এবং বাংলাদেশ থেকে আসা বাপ্পী, মিথুন ও চঞ্চল।

উপস্থাপনায় যারা ছিলেন : দু’দিনের কনভেনশনের সার্বিক উপস্থাপনায় ছিলেন শামসাদ রানা, মিন্টু হাওলাদার, সুলতানা শিরিন সাজী, আবুল জাকের, শামীমা চৌধুরী ও নূরে আসফিয়া চৌধুরী।

দুই দেশের দুই প্রধানমন্ত্রীর বানী : এনএবিসি ২০১৬ কে শুভেচ্ছা জানিয়ে বানী পাঠান কানাডার প্রধানমন্ত্রি জাস্টিন ট্রুডো ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রি ট্রুডোর বানী পড়ে শোনান সৈয়দ মাহিদুল ইসলাম ও নাবিলা জুবেরী। শেখ হাসিনার বানী পাঠ করেন ইতরাদ জুবেরী সেলিম। বাংলাদেশ বিমান ও পর্যটন মন্ত্রি রাশেদ খান মেননের বানী পড়েন ফারিহা ইসলাম। কানাডা সরকারের হেরিটেজ মিনিস্টার মেলোনী জলির বানী পাঠ করেন রিশকাত খান এলি।

শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন মূলধারার রাজনীতিকরা। দু’দিনের কনভেনশনে কানাডার মূল ধারার ব্যক্তিত্বরা অতিথি হিসেবে আসেন অনুষ্ঠানে এবং সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন। অতিথিদের মধ্যে ছিলেন এমএনএ জ্যারি স্ক্যালোভোনো, সিটি কাউন্সিলর ও ডেপুটি মেয়র মেরি ডেরোস, লিবারেল পার্টির এমপি হাউজ ফাদার, এমপি মার্ক মিলার, বাংলাদেশ হাই কমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারী মকসুদ খান।

স্যুভেনির : কনভেনশন উপলক্ষে প্রকাশিত সম্পূর্ণ রঙিন স্যুভেনিরটির শৈল্পিক প্রচ্ছদ, ঝকঝকে প্রিন্টিং ও মননশীল লেখার জন্য সকলের কাছে প্রশংসিত হয়। স্যুভেনির সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন শামসাদ রানা।

অসংখ্য স্টল : কনভেনশনের পুরো লবি জুড়ে ছিলো স্টল আর স্টল। বাহারী পোশাক আর রকমারী গহণার স্টলগুলো দেখে অনেকেই হয়তো ক্ষনিকের জন্য থমকে গিয়েছিলেন। খাবারের স্টলেও ছিলো উপচে পড়া ভিড়।

বলাবাহুল, সাম্প্রতিক সময়ে মন্ট্রিয়লে বেশ কয়েকবার ফোবানা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও সেভাবে দর্শক প্রাণ পায় নি। অথচ দীর্ঘ বিরতিতে এবার মন্ট্রিয়লবাসী এনএবিসির এই নান্দনিক উৎসব উপভোগ করলো যেনো তারিয়ে তারিয়ে। কথা মতো, সব শিল্পির উপস্থিতি নিশ্চিত করে আয়োজক সংগঠন কানাডা বাংলাদেশ সলিডারিটি দর্শকদের বিশ্বাসের দরজায় নিজেদের অবস্থানকেও করলো সুদৃঢ়।

(এসএস/এএস/সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test