E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জীবনের বুঝি অতীতটাই সুন্দর!

২০১৭ মে ১৩ ১২:৪৭:০৮
জীবনের বুঝি অতীতটাই সুন্দর!

আম্বিয়া অন্তরা


ছোটবেলায় মেহেরপুরের গ্রামে প্রাইমারী স্কুলে পড়াকালে আমার শিক্ষক পাটকেলপোতার রুহুল আমীন স্যার তিন ছাত্রীকে দুরন্ত বলে হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এদের একজন আমি, অন্য দুজন আনু ও হাফিজা। সম্পর্কে আনু ও হাফিজার ফুফু আমি। কিন্তু ওরা দুইজনই আমার চেয়ে তিন/চার বছরের বড় ছিল। একই ক্লাসে পড়তাম সবাই। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, বর্ষা ও শীত মাথায় নিয়ে আমরা বিশ/ত্রিশ মিনিটের পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম। একসাথে খাওয়া, একসাথে নাওয়া-ঘুমানো-খেলা! আমরা কেউ কারো কাছে থেকে আলাদা হতে পারতাম না। যেন তিন দেহে এক আত্মা! এভাবেই চলছিল আমাদের সেই কৈশোর। এক সময় আমরা ক্লাস ফোর পাশ করে ফাইভে উঠলাম। ওই সময় পর্যন্ত পল্লী গ্রামের সরল জীবনযাত্রা আমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

আমাদের তিন জনেরই বাড়ির অবস্থান ছিল কাছাকাছি। তিন জনের তিন বাড়ির পাশেই ছিল তিন রাস্তার মোড়। ওই মোড়েই ছিল বিশাল বট-পাকুড়ের গাছ। সেই গাছের ছায়ায় আমরা মার্বেল খেলতাম। আমাদের সেই আনন্দময় দিনগুলো ছিল নির্মল ও প্রশান্তির। আমরা একদিন তিন বান্ধবী মিলে সেই বট-পাকুড় গাছের ছায়ায় বসে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমরা কখনোই বিয়ে করবো না, কখনো আমরা পৃথক হবো না। লেখাপড়া শিখে আমরা সবাই চাকরী করব। আমাদের তিনজনের টাকা এক বাক্সে জমা করবো, আর সেই টাকা দিয়ে আমাদের প্রতিদিনের খরচ মেটাবো, নতুন নতুন বাংলা সিনেমা দেখবো। বাকি টাকা দিয়ে গ্রামের হত-দরিদ্র মানুষের সেবা করবো ও তাঁদের জীবন-মানের উন্নতি ঘটাবো।

এভাবেই বেশ কেটে যাচ্ছিল আমাদের সোনালী শৈশব। হঠাৎ এক ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল আমাদের স্বপ্ন-সাধ। আনুর অভিভাবকরা ওর বিয়ে ঠিক করে ফেললো। ভালো পাত্র, হাতছাড়া করা যাবে না। কারণ পাত্র দেখতে রাজপুত্রের মত। কবি নজরুলের মত মাথায় ঝাঁকড়া চুল। মেহেরপুরের প্রথম সাংসদের ছোট ভাই বলে কথা! দুই পক্ষের অভিভাবকের সম্মতিতে বিয়ে হয়ে গেল আনুর। আমাদের সেই প্রতিজ্ঞা বলে ঠেকাতে পারলাম না আনুর বিয়ে! আনু নতুন বউ সেজে চলে গেল মেহেরপুর শহরে তার স্বামীর বাড়িতে। আমাদের একটি স্বপ্ন-ডানা ভেঙে গেল। আমরা শুধুই ছটফট করতে লাগলাম। সেই মুহূর্তের কষ্টগুলো যেন মৃত্যুর যন্ত্রণার চেয়েও বেশী কষ্টকর মনে হতে লাগছিল।

তিনদিন পর আনু বাপের বাড়ি এলো। এইবার সে বেঁকে বসলো স্বামীর বাড়ি আর যাবেনা। রাজপুত্রের মত সুন্দর স্বামীকে দেখে তার ভয় করে। বাল্যবিয়ে হলে যা হয়! স্বামীর বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য আনুর ভাইয়েরা আনুকে মারধর করতে লাগলো । আনু শেষ পর্যন্ত যেতে রাজি হল, কিন্তু শর্ত হল, ওর সাথে আমাদের দুইজনকেও যেতে হবে। আনুর পরিবার এই শর্ত মেনে নিল। আমরা আবার তিনজন এক হয়ে আনুর শ্বশুর বাড়ি গেলাম। নতুন কুটুম খাতির যত্ন ভালোই পাচ্ছিলাম। সেখানে দেখলাম, আনুর ভাশুর তাছির উদ্দীনের মেয়ে ডেইজি ছন্দ লিখে রুমাল সেলাই করছিল। আমরাও তার কাছ থেকে সেলাই শেখা শুরু করলাম।

লেখাপড়া বাদ দিয়ে আমরা আনুর কাছে বসে আছি। এই খবর আমার বড় ভাইয়ের কানে চলে গেল। ঢাকা থেকে ভাই এসে আমাকে নিয়ে গেল। সেই সাথে হাফিজাকেও নিয়ে গেল ওর পরিবার। এইবার আমরা তিন বন্ধু তিন ভাগ হয়ে গেলাম । ট্র্যাজেডি হল, শেষ পর্যন্ত ভেঙে গেল বিয়ে না করবার সেই প্রতিজ্ঞা। আমাদের তিনজনেরই বাল্যকালে বিয়ে হয়ে গেল।

আজীবন অবিবাহিত থেকে এক বাড়িতে বসবাস করে এক বাক্সে টাকা জমানো, বাংলা সিনেমা দেখা ও সমাজ সেবার স্বপ্ন-সাধ স্বপ্নই রয়ে গেল।

আমাদের সময়ে বাল্যবিয়ের যদিও প্রচলন ছিল। অনেক মেয়ে সামাজিক সম্মান রক্ষায় সংসার জীবনকে মেনে নিয়ে সুখে থাকার ভান করেছে। আবার কেউ কেউ সুখে থাকার ভান করতে না পারায় নরক যন্ত্রণা সয়েছে। এই বয়সে মার্কিন মুলুকে এসে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি, সেদিন আমাদের সঙ্গে কি ভয়ংকর অন্যায় কাজটি করেছিলেন আমাদের অভিভাবকরা! এখন তো আর সেই সোনালী অতীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তবু সেই স্বপ্ন নতুন ধারায় বহমান রাখতে এখন আবার স্বপ্ন দেখি, অবশ্যই এমন দিন আসবে, যেদিন আমার জন্মভূমি বাংলাদেশে আর কোনো মেয়ের আমাদের মতো বাল্যবিয়ে হবে না; ওরা ওদের মতো করেই ওদের জীবনে নিজেদের স্বপ্ন-সাধ পূরণ করবে, করবেই।

লেখক : আমেরিকার নিউইয়র্ক প্রবাসী।

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test